আধারহীন বায়বীয় প্রেতই কোন জীবশরীরে ঢুকে ভুত হয়ে যায়। ভূত নিয়ে রহস্যের যেমন অন্ত নেই, তেমনি মানুষের কৌতুহলেরও অন্ত নেই। প্রচলিত বিশ্বাস অনুসারে কোন ব্যক্তি যদি হত্যা, আত্মহত্যা , আকস্মিক দুর্ঘটনা ইত্যাদি অপঘাতে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে মৃত্যুবরণ করলে সেই ব্যক্তির অতৃপ্ত আত্মা ভুত হয়ে যায়। মৃত্যু পরবর্তীতে যদি তার আধ্যাত্মিক পারলৌকিক কৃত্যাদি যথাযথ সম্পন্ন করা না হয়, তবে তাদের আত্মা অতৃপ্ত থাকে। সেই অতৃপ্ত আত্মাই বায়বীয় আধারে বিচরণ করে ভূত, প্রেত, অশরীরী আত্মা ইত্যাদি নামে পরিচিত হয়। সেই প্রেত জড় কোন বস্তু বা চেতন কোন প্রাণীকে অবলম্বন করে মানুষের সামনে আসতে পারে। বায়বীয় আধার অবস্থায় তার অন্তঃকরণ সক্রিয় থাকে। সেই অন্তঃকরণের চিত্তে যদি তামসিকতা ক্রুরতা সঞ্চিত থাকে, তবে সেই প্রেত মানুষের ক্ষতি করতে পারে বা ক্ষতি করার নিরন্তর প্রচেষ্টা করে। পক্ষান্তরে প্রেতের মধ্যে যদি সাত্ত্বিক গুণের আধার বেশি থাকে তবে সে মানুষের কল্যাণ করে। ভুত নাম ধারণ করে বিভিন্ন মৃত ব্যক্তির আত্মা জীবিত ব্যক্তিদের সামনে দৃশ্যমান হতে পারে, আকার গ্রহণ বা অন্য কোনো উপায়ে নিজের উপস্থিতি প্রকাশ করতে পারে।
ভুত যতই ভয়ংকর হোক না কেন, বাঙালির সাহিত্য সংস্কৃতিতে ভুতের ছড়াছড়ি। স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর পর্যন্ত ভুত নিয়ে গল্প লিখেছেন। প্রাচীন কাল থেকে বাঙালি শিশু বড় হয় ভুতের গল্প শুনে। পল্লীগ্রামে এখনও ভুতের গল্প বলা দাদু-ঠাকুমাদের কাছে বাঙালি শিশু তন্ময় হয়ে ভুতের গল্প শোনে।
আশেপাশের প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতার সাথে কাল্পনিকতার রঙ চড়িয়ে গল্পগুলো তৈরি। ভয়ে জুবুথুবু হয়ে গল্পগুলো শোনে শিশুরা। গল্প শুনে ভয় পেলেও গল্পগুলো তাদের শোনা চাই। পল্লীগ্রামের অধিকাংশ মানুষের জীবনেই কোন না কোন ভৌতিক অভিজ্ঞতার গল্প শোনা যায়। এ ভৌতিক বিবরণীতে ভুত কখনও অদৃশ্য বায়বীয় আকারে সকলের সামনে উপস্থিত হয়। তখন ভুতের উপস্থিতি টের পাওয়া গেলেও দেখা যায় না। আবার কখনও মানুষ বা কোন কাক, কালো কুকুর, কালো বিড়াল ইত্যাদি প্রাণীর আকারে শরীর ধারণ করে দৃশ্যমান হয়। জগতের আমরা যা দেখি তার সকলই সত্য নয়, আবার যা দেখি না তার সকলই অস্তিত্বহীন মিথ্যা নয়। ভুতকে অনেক শিক্ষিত মানুষই আধিভৌতিক বা অতিলৌকিক জনবিশ্বাস উড়িয়ে দেন। এরাই আবার বাসায় একলা থাকতে ভয় পান। অমাবস্যার রাত্রে শ্মশানে যেতে ভয় পান। বিজ্ঞান বরাবরই ভুতকে একটি মানসিক রোগ বলে অভিহিত করে এর অস্তিত্ব অস্বীকার করে। কিন্তু ধর্মগ্রন্থে ভুতের অস্তিত্ব পাওয়া যায়।শ্রীচণ্ডীর দেবীকবচে ভুতের হাত থেকে রক্ষার পেতে দেবীকবচ পাঠের কথা বলা হয়েছে।
অভিচারাণি সর্বাণি মন্ত্রযন্ত্রাণি ভূতলে ।
ভূচরাঃ খেচরাশ্চৈব কূলজাশ্চোপদেশিকাঃ ॥
সহজা কুলজা মালা ডাকিনী শাকিনী তথা ।
অন্তরীক্ষচরা ঘােরা ডাকিন্যশ্চ মহারবাঃ ॥
গ্রহভূতপিশাচাশ্চ যক্ষগন্ধর্বরাক্ষসাঃ ।
ব্ৰহ্মরাক্ষসবেতালাঃ কুষ্মাণ্ডা ভৈরবাদয়ঃ ॥
নশ্যন্তি দর্শনাৎ তস্য কবচেনাবৃতাে হি যঃ ।
মানােন্নতির্ভবেদ্রাজ্ঞস্তেজোবৃদ্ধিঃ পরা ভবেৎ ॥
(শ্রীচণ্ডী:দেবীকবচ, ৫৩-৫৬)
"এই ভূতলে অভিচারমূলক মন্ত্র ও যন্ত্রসকল, ভূচর, খেচর, কূলজা (নদী বা সাগরকূলবাসিগণ) উপদেশিকা (ক্ষুদ্র দেবতা), সহজা (সহােদর), কুলজা (দুষ্ট দেবতা), মালা, ডাকিনী, শাকিনী, ঘােরা, অন্তরীক্ষচরা (উপদেবতা), মহারবা ডাকিনী, গ্রহ, ভূত, পিশাচ, যক্ষ, গন্ধর্ব, রাক্ষস, ব্রহ্মদৈত্য, বেতাল, কুম্মণ্ড ও ভৈরবাদি কবচাবৃত ব্যক্তির দর্শনে নষ্ট (অপসৃত) হয়। আর এইরূপ কবচাবৃত ব্যক্তির রাজসকাশে মানােন্নতি এবং অন্যত্র পরম তেজোবৃদ্ধি হয়।"
রাম দুআরে তুম রখবারে।
হোত না আজ্ঞা বিনু পৈসারে ।।
সব সুখ লহৈ তুমহারী সরনা।
তুম রক্ষক কাহূ কো ডর না ।।
আপন্ তেজ সমহারো আপৈ।
তীনৌঁ লোক হাঁক তেঁ কাঁপৈ ।।
ভূত পিশাচ নিকট নহিঁ আবৈঁ।
মহাবীর জব নাম সুনাবৈঁ ।।
নাসৈ রোগ হরৈ সব পীরা।
জপত নিরন্তর হনুমত বীরা ।।
সঙ্কট তেঁ হনুমান ছুড়াবৈ।
মন ক্রম বচন ধ্যান জো লাবৈ ।।
(শ্রীহনুমান চালীশা:২১-২৬)
ভুত বাংলা সংস্কৃতিতে বিশেষ করে বাংলা লোকসাহিত্যে একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান অধিকার করে আছে। বাংলা রূপকথায় ভুত থাকবেই। তা সে বোকা ভুত হোক আর চালাক ভুত হোক। বাঙালির ভুতচিন্তা খুবই মজার এবং স্বতন্ত্র। সেখানে ব্রাহ্মণ ভুত ব্রহ্মদৈত্য যেমন আছে, তেমনি আছে মুসলিম ভুত মামদো ভুত। নারী ভুতের মধ্যেও শাকচুন্নী নামক সধবা ভুত যেমন রয়েছে, তেমনি বিধবা ভুত রয়েছে। বাঙালির ভুতের এত বৈচিত্র্য এবং বাহার দেখে যেমন বিস্ময় জাগে তেমনি হাসিরও উদ্রেক করে।ভুত নিয়ে যে অসাধারণ শিশুতোষ কবিতা হতে পারে দৃষ্টান্ত সুকুমার রায়। তাঁর বিখ্যাত 'আবোল তাবোল' ছড়ার গ্রন্থে 'ভূতুড়ে খেলা' নামে একটি মজার কবিতা রয়েছে। কবিতাটিতে মা ভুত এবং শিশু ভুতের সম্পর্ক উঠে এসেছে। কিল দিয়ে, ঘুঁষি দিয়ে, কান মলে, মাটিতে আছাড় দিয়ে এমন বৈচিত্র্যময় পদ্ধতিতে ভুতের মায়ের সন্তানকে আদরের বহর দেখলে না হেসে কোন উপায় নেই।
"পরশু রাতে পষ্ট চোখে দেখনু বিনা চশমাতে,
পান্তভূতের জ্যান্ত ছানা করছে খেলা জোছনাতে।
কচ্ছে খেলা মায়ের কোলে হাত পা নেড়ে উল্লাসে,
আহলাদেতে ধুপধুপিয়ে কচ্ছে কেমন হল্লা সে৷
শুনতে পেলাম ভূতের মায়ের মুচকি হাসি কটকটে-
দেখছে নেড়ে ঝুনটি ধ'রে বাচ্চা কেমন চটপটে।
উঠছে তাদের হাসির হানা কাষ্ঠ সুরে ডাক ছেড়ে,
খ্যাঁশ্ খ্যাঁশানি শব্দে যেন করাত দিয়ে কাঠ চেরে!
যেমন খুশি মারছে ঘুঁষি, দিচ্ছে কষে কানমলা,
আদর করে আছাড় মেরে শূন্যে ঝােলে চ্যাং দোলা৷
বলছে আবার, 'আয়রে আমার নােংরামুখাে সুঁটকো রে,
দেখনা ফিরে প্যাখনা ধরে হুতােম-হাসি মুখ করে!"
দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের ঠাকুরমার ঝুলি (১৯০৬) রাক্ষস, খোক্কশের গল্প এই অনেকেই জানি। কিন্তু গত এক দুইদশকে আন্তর্জালের (Internet) ব্যবহার অত্যাধিক মাত্রায় বৃদ্ধি পাওয়ায় বর্তমান শিশুদের বিভিন্ন বিদেশি ভাষার কার্টুনের আসক্তি এত পরিমাণে বেড়েছে যে। এদের জন্যে আমাদের বাঙালি ঐতিহ্যের ভুতের গল্পগুলো একপ্রকার বিদায় নিতে বসেছে। এর কারণে বাঙালি সংস্কৃতি পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। শিশুদেরও মনজগত পরিবর্তিত হয়ে যাচ্ছে। আমার মনে আছে, একটি ভুতের গল্প শোনার জন্যে আমাদের দিদিমা, মামা, মামির পিছে পিছে ঘুরতাম। বাঙালির চিন্তায় অনেক প্রকারের ভূতের বিশ্বাস রয়েছে। এদের মধ্যে জনপ্রিয় ভুতেরা হল:
১.পেত্নী: খুবই জনপ্রিয় একটি ভুত। ভুতের নামের সাথেই ভূত-পেত্নী দ্বন্দ্ব সমাসভুক্ত করে আমরা পেত্নীর নাম নেই। সাধারণত সংস্কৃত প্রেত শব্দের স্ত্রীবাচক লিঙ্গান্তর করে পেত্নী শব্দটি ব্যবহৃত। পেত্নী বলতে সাধারণত নারী ভুতকেই বোঝায়। তবে অনেকে বলেন, অতৃপ্ত আশা আকাঙ্ক্ষা নিয়ে যদি কোন এবং অবিবাহিত নারী আত্মহত্যা বা কোন অপঘাতে মৃত্যুবরণ করে, তবে সে পেত্নীতে রূপান্তরিত হয়ে যায়। পেত্নী যে কোন রূপ ধারণ করতে পারে। অতৃপ্ত আশা আকাঙ্ক্ষা অপূর্ণ থাকার কারণে পেত্নীদের মধ্যে সাধারণত ক্ষতি করার মানসিকতা বেশি থাকে। জীবিত অবস্থায়ই কেউ যদি ক্ষতি করে থাকে এবং তার কারণেই যদি মৃত্যু হয়ে পেত্নীতে রূপান্তরিত হয়; পেত্নীরা যেহেতু ভীষণ বদমেজাজী এবং আক্রমনাত্মক হয়। তাই পেত্নীরা তাদের জীবিত অবস্থার ক্ষতি করা ব্যক্তিদের সর্বদা ক্ষতি করার চেষ্টা করে। পেত্নীদের পাগুলো পিছনের দিকে ঘোরানো থাকে। শেওড়া গাছ, তেঁতুল গাছ তাদের খুব প্রিয়। তবে শেওড়া গাছে বসবাস করতে পেত্নীরা খুবই স্বাচ্ছন্দ বোধ করে। পেত্নীরা নাকি নাকি গলায় মানুষকে ডাকে। সে ডাকে যারা সারা দেয়, তারাই তার শিকারে পরিণত হয়।
৩.চোরাচুন্নি ভুত: চোরা ভুত এবং চুন্নি ভুত অত্যন্ত দুষ্ট স্বভাবের অন্যের ক্ষতি করার মানসিকতা সম্পন্ন ভূত। এই ভুতের অকারণে সাধারণ মানুষের অনিষ্ট করে। কোন পুরুষ চোর আত্মহত্যা বা অপঘাতে মৃত্যুবরণ করলে সে চোরা ভুতে পরিণত হয়। চোরের স্ত্রী অথবা কোন নারী চোর অপঘাতে মৃত্যুবরণ করলে চুন্নি ভুতে পরিণত হয়। পূর্ণিমা রাত্রি এদের প্রিয়। এদের কারণেই অনেক পরিবার থেকে অকারণ গৃহের ব্যবহৃত দ্রব্য বা খাদ্যদ্রব্য উধাও হয়ে যায়। তবে এই চোরাচুন্নি ভুতেরা চুরি করা এবং গৃহের অনিষ্ট করা ছাড়া আর বড় ধরণের ক্ষতি করে না।এই চোরাচুন্নি ভুতেরা রামনাম এবং গঙ্গাজলকে অত্যন্ত ভয় পায়। তাই গৃহে যদি কখনো ভুতদের উপদ্রুত শুরু হয় তবে এদের হাত থেকে রক্ষা পেতে সারাগৃহে গঙ্গাজল ছিটিয়ে দিতে হয়।
৪. কবন্ধ ভুত: এ ভূতেদের শরীরে মাথা না থাকায় তাদের কবন্ধ,স্কন্ধকাটা বা প্রচলিত ভাষায় গলাকাটা ভুত বলে। যে সকল ব্যক্তিদের ট্রেন দুর্ঘটনা, বাস-ট্রাক দুর্ঘটনা বা অন্য কোন ভয়ংকর যান্ত্রিক দুর্ঘটনায় শরীর থেকে মাথা বিছিন্ন হয়ে যাত, তারাই মৃত্যুর পরে কবন্ধ বা গলাকাটা ভুত হয়ে তাদের দেহ থেকে বিচ্ছিন্ন মাথাকে সর্বত্র খুঁজে বেড়ায়। অত্যন্ত কষ্ট পেয়ে মৃত্যু হওয়ায় এই ভুতেরা খুবই নির্মম এবং ভয়ংকর হয়।
৫.পেঁচাপেঁচি: এ ভূতগুলোকে সচরাচর লোকালয়ে দেখা যায় না। এরা গভীর বনজঙ্গলে অবস্থান করে। পেঁচাপেঁচি হলো যুগল ভূত। এরা গভীর বনজঙ্গলে সাধারণত পেঁচার মত রূপ ধরে থাকে। পেঁচার মতন ডাকাডাকি করে। এ ভুতের পুরুষ ভুতের নাম পেঁচাভুত এর স্ত্রী ভুতের নাম পেঁচিভুত। এরা জোড়া ধরে শিকার করে থাকে। গভীর জঙ্গলে যখন কেউ দলচ্যুত হয়ে একাকী হয়ে পরে, তখন এ পেঁচাপেঁচি বিভিন্ন ছলনার আশ্রয় নিয়ে সেই নিঃসঙ্গ ব্যক্তির পিছু নেয়। পরে তাকে হত্যা করে তার শরীরের মাংস ছিড়ে ছিড়ে দুজনে মজা করে খায়।
৬.বেঘোভূত: পেঁচাপেঁচি ভুত যেমন পেঁচার রূপ ধারণ করে মানুষকে ভয় দেখায় বা হত্যা করে; তেমনি বেঘোভুত বাঘের রূপ ধারণ করে মানুষকে ভয় দেখায়। সুন্দরবনে বাঘের আক্রমণে যারা নৃশংসভাবে মৃত্যুবরণ করেছে, তদের অতৃপ্ত আত্মাই বেঘোভুতে পরিণত হয়। এরা কখনো বাঘের রূপ ধারণ করে, অথবা অদৃশ্য ভাবে বাঘের স্বরে গর্জন করে।সুন্দরবন এলাকায় এধরনের বেঘোভূত জঙ্গলে কাঠ, মধু সংগ্রহ করতে যে সকল মানুষেরা আসে তাদের ভয় দেখায়। বেঘোভুতেরা দুইপ্রকারের হয়। একপ্রকার ভুতেরা সাধারণত মানুষকে অদৃশ্য বিভিন্ন কৌশলে বাঘের হাত থেকে রক্ষা করে। আবার কিছু দুষ্ট প্রকৃতির বেঘোভুত সাধারণ মানুষকে ভুলিয়ে বাঘের মুখে নিয়ে যেতে চেষ্টা করে।
৭.মেছোভূত: বাংলা মেছো শব্দটি মাছের সাথে সম্পর্কিত। মেছোভুতেরা সাধারণত মাছ খেতে অত্যন্ত পছন্দ করে। ইলিশ মাছ তাদের খুব প্রিয়। ইলিশ মাছ সহ যেকোন মাছের মেছো গন্ধ পেলেই মেছো ভুতের গন্ধ শুকে শুকে সেখানে চলে যায় মাছ খেতে। মেছো ভুতেরা তাদের বড় হাত বাড়িয়ে মাঝে মাঝে রান্নাঘর থেকে মাছ চুরি করে। জেলেদের মাছধরার নৌকা এবং মাছের বাজার থেকেও এরা মাছ চুরি করে খায়। তবে মেছো ভুতেরা শান্ত স্বভাবের মাছচুরি করা ছাড়া এরা সাধারণত কারো কোন বড় ক্ষতি করে না। বাজার থেকে কেউ যদি ইলিশ মাছ কিনে নির্জন রাস্তা দিয়ে যেতে থাকে, তখনি এরা সেই ব্যক্তিকে ভয় দেখায়। পথচারী ব্যক্তিটি যখন ভয়ে মাছের ব্যাগ ফেলে বাবারে মারে বলে চিৎকার করে উর্ধশ্বাসে দৌড়ে পালায় তখনি এরা সেই মাছের ব্যাগকে আত্মসাৎ করে মহা আনন্দে মাছ খায়। এরা সাধারণত নির্জন বাঁশঝাঁড়ে থাকে।তবে নদীর ধারে, বিলের ধারে, পুকুর পাড়ে, লেকের ধারে সহ যেখানেই মাছের গন্ধ আছে সেখানেই মেছোভুতের বসবাস।
৮.দেওভুত: এ ভূতেরা নদীতে বা খালে বসবাস করে। কোন আবদ্ধ জলাশয় এই ভুতেরা পছন্দ করে না।যে জল চলমান সেই জল তাদের প্রিয়। প্রচলিত যে, যে সকল ব্যক্তি জলে ডুবে ভয়ংকরভাবে মৃত্যুবরণ করেন, তারাই মৃত্যুর পরে দেওভুত হয়।এই ভুতেরা মানুষকে অকারণে জলে ডুবিয়ে মারে।
৯.আলেয়া ভুত: রাতের অন্ধকারে জলাভূমি বা খোলা প্রান্তরে আলেয়া ভুতের দেখা মেলে। মাটি হতে একটু উঁচুতে আগুনের শিখা জ্বলতে থাকে। লোকবিশ্বাসে আলেয়াকে ভুতের আখ্যা দেয়া হলেও, বিজ্ঞানীদের দৃষ্টিতে আলেয়া কোন ভুত নয়। গাছপালা পচনের গ্যাস থেকেই আলেয়ার উৎপত্তি। জেলেরা এর শিকার হয়।
১০.নিশি: ভূতদের মধ্যে অন্যতম ভয়ংকর ভুত হলো নিশি। অন্যান্য ভূত সাধারণত নির্জন এলাকায় মানুষকে একা পেলে আক্রমণ করে, কিন্তু নিশিভুত গভীর রাতে শিকারকে তার প্রিয় মানুষের কন্ঠে তার নাম ধরে সুমধুর সুরে ডাকে। নিশিভুতের ডাক শুনে সেই ব্যক্তি যখন বাইরে বের হয়ে আসে তখন সে নিশির শিকারে পরিণত হয়। এই নিশিভুতের পাল্লায় পরে মানুষ সম্মোহিত হয়ে ঘরের দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে, আর কখনো ঘরে ফিরে আসে না। পরবর্তী সেই ব্যক্তিও একজন নিশি ভুতে পরিণত হয়ে যায়। প্রচলিত বিশ্বাস যে, এই নিশি ভুতেরা কোন মানুষকে এককণ্ঠে দুবারের বেশি ডাকতে পারে না। তাই গভীর রাতে বা নির্জন স্থানে তিনবার না ডাকা পর্যন্ত সাড়া দেয়া উচিত নয়। তিনবার ডাক শুনে বের হলে তবে আর নিশিভুতের আক্রমণের ভয় থাকে না। নিশিভুত মানুষকে গৃহছাড়া করে। প্রিয়জনের সাথে মিলিত না হওয়া অতৃপ্ত আত্মারাই নিশিভুতে পরিণত হয়।
১১.কানাভুলো ভুত : নিশিভুতের মতই একই শ্রেণীর ভূত হলো কানাভুলো ভুত। সে পথিকের গন্তব্য ভুলিয়ে দিয়ে তাকে বিভিন্ন রাস্তা ঘুরিয়ে একটি অচেনা স্থানে নিয়ে আসে। এই ভুতের পাল্লায় পরে অনেক সাধারণ মানুষ মাঝে মাঝেই একই রাস্তায় বারবার ঘুরপাক খেতে থাকে। শিকার ব্যক্তিকে পথ ভুলিয়ে কোন নির্দিষ্ট গন্তব্যে নিয়ে এসে তাকে হত্যা করে। এই ভূতেরা সাধারণত রাতেই শক্তিশালী হয় বেশি। গ্রামের মাঠের ধারে, বাঁশঝাড়ে, পথের মধ্যে এদের দেখা যায়। অতৃপ্ত দুষ্ট আত্মারাই কানাভুলো ভুত হয়ে মানুষকে বিভ্রান্ত করে।কোন কোন ক্ষেত্রে অকারণ হত্যাও করে।
১২.মামদো ভূত: মুসলমান ভুতকে মামদো ভুত বলে। মামদো ভুত মানুষের উপকার করে আবার ক্ষতিও করে। কবরস্থানের আশেপাশে এই ভুতেরা বসবাস করে।
১৩.ব্রহ্মদৈত্য: এই ভুতেরা সাধারণত কারো ক্ষতি করে না। কোন ব্রাহ্মণ আত্মহত্যা বা অপঘাতে মৃত্যুবরণ করলে ব্রহ্মদৈত্যে পরিণত হয়। বেলগাছ, অশ্বত্থ গাছ সহ বিভিন্ন পবিত্র গাছে এই ভুতেরা সাধারণত বসবাস করে। এদের পরণে থাকে সাদা ধূতি এবং গলায় থাকে সাদা পৈতা। অনেক ব্রহ্মদৈত্যের মাথায় আবার টিকিও থাকে।অত্যন্ত দয়ালু স্বভাবের এই ভুতেরা অদৃশ্যভাবে মানুষের অনেক উপকার করে। মন্দিরের আশেপাশে এই ভুতেরা সাধারণত বসবাস করে।
১৪.গেছোভূত: কিছু ভুত আছে সারাদিন গাছে গাছে চড়ে বেড়ায়, তাদের বলে গেছোভুত।এই ভুতগুলো মানুষের ক্ষতি করে না। শুধু গাছ এবং গাছের ফলকে নষ্ট করে। এই ভুতেরা অত্যন্ত দুরন্ত স্বভাবের।
মাদারীপুরে আমাদের বাড়ির পেছনে একটি বাগানে রয়েছে। আমাদের ছোটকালে এ বাগানে অনেক গাছপাল ছিলা। সে সূর্যের আলোও প্রবেশ করত না। প্রচুরসংখ্যক গাছপালায় ভয় করত, গা ছমছম করত। যখন ছোট ছিলাম আমাদের শিশুমনে বিশ্বাস ছিল, বাগানের এ গাছগুলোতে ভূত-পেত্নী বসবাস করে।বিশেষ করে তেঁতুল গাছে তো ভূত আছেই। গাছের নিচে দিয়ে যেতে গা ছমছম করত। প্রচণ্ড রকমের ভয় তাড়া করত। সে সময় আমরা ভূত-পেত্নীর ভয় তাড়াতে একটি ছড়া আত্মস্থ করি। ছড়াটি আমাদের মা-দিদিমায়েদের শেখানো। তারাও হয়ত তাদের মা-দিদিমায়েদের থেকে পেয়েছে। ভূত-পেত্নীর ভয় থেকে মুক্তি পেতে ছড়াটি এভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে চলে আসছে। সেই ছড়াটির বিষয়বস্তু হয়, ভূত-পেত্নীকে শ্রীরামের নাম শোনানো। তারা শ্রীরাম নাম শুনলে ভয়ে পালায়।
"ভূত আমার পুত, পেত্নী আমার ঝি;
রাম লক্ষ্মণ বুকে আছে করবি আমায় কি? "
এই ছড়াটির সাথে সাথে তারা শিখিয়ে দিয়েছিল, বেশি ভয় পেলে শ্রীরামের নাম জপ করতে।তাই যখনই বাগানের মধ্যে দিয়ে যেতে ভয় পেতাম ; কিংবা তেঁতুলগাছ, তালগাছের নিচে দিয়ে যেতাম তখনিই বুক ফুলিয়ে শ্রীরামনাম করতে করতে যেতাম। কারণ ভূত-পেত্নীরা শ্রীরামনামে অত্যন্ত ভয় পায়। তবে ভুতেরও বর্তমানে অনেক দুর্দিন চলছে। গ্রামগুলো শহর হয়ে যাচ্ছে, জঙ্গল পরিষ্কার হয়ে যাচ্ছে, পুরাতন ভবনগুলো ভেঙে আধুনিক বহুতল ফ্ল্যাটবাড়ি তৈরি হচ্ছে। ফলশ্রুতিতে বেচারা ভুতেদের আবাসস্থল সংকটে পড়ে যাচ্ছে। আগে ভুত দেখে ভয় পেত এবং তাদের থেকে বাঁচতে চাইতো। এখন হয়েছে উল্টা, বেচারা ভুতেরাই আধুনিক মানুষদের ভয় পেয়ে দূর থেকে বহুদূরে পলায়ন করছে। আগামীতে এই বিবিধ প্রকারের বৈচিত্র্যময় বাঙালি ভুতদের দেখা পাওয়া দুষ্কর হবে। তাই নগরায়ন নামক আধুনিকতা এবং স্বার্থপরতার পাল্লায় পরে বেচারা ভুতদের ভবিষ্যৎ ধীরেধীরে অন্ধকার বলা চলে।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।