বাংলায় ব্রতচারী আন্দোলনের প্রবর্তক গুরুসদয় দত্ত (১৮৮২—১৯৪১) তাঁর 'বাঙলি হ' নামক বিখ্যাত কবিতায় বাঙালিকে অনুকরণের খোলস ভেদ করে আগে মানুষ হতে বলেছেন। পরবর্তীতে শাশ্বত বাঙালি হতে বলেছেন। যদি ষোল আনা প্রকৃত বাঙালি হতে না পারলে, তবে কোনদিনও বাঙালি বিশ্বমানব হতে পারবে না। শুধুই খোলসের মধ্যেই আবদ্ধ হয়ে থাকবে।
"মানুষ হ' মানুষ হ'
আবার তোরা মানুষ হ'-
বাহ্যরূপে খোলস ভেদি'
সম্পূর্ণ বাঙ্গালি হ'।
শিখে নে দেশ-বিদেশের জ্ঞান
তবু হারাস নে মা'র দান
বাংলা ভাষার বুলি চেলে
বাংলা ধাঁজে নেচে খেলে
বাংলা ভাবে পরাণ মেলে
বাংলা সেবায় জীবন ঢেলে
কায়-মনে বাঙ্গালি হ'-
ষোল আনা বাঙ্গালি হ'।
বিশ্ব-মানব হবি যদি
শাশ্বত বাঙ্গালি হ'।"
এমন মানুষ হওয়ার কথা যেমন ঋগ্বেদের মধ্যে আছে তেমনি ভাবে মহাভারতে বনপর্বের মধ্যে আছে।
সেই ধারাবাহিকতায় মধ্যযুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বাঙালি কবি চণ্ডীদাস বলেছেন, "সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই"। আমরা সব হতে চাই, কিন্তু মানুষ হতে চাই না।মানুষের ঘরে জন্ম নিলেই কেউ মানুষ হয়ে যায়। মনুষ্যত্ব অর্জন করতে হয়। একটি কুকুরকে জন্ম থেকেই কুকুর বলে, একটি শূকরকে জন্ম থেকেই শূকর বলে, একটি বিড়ালকে জন্ম থেকেই বিড়াল বলে। শুধুই ব্যতিক্রম মানুষ। তাকে জন্ম থেকেই কেউ মানুষ বলে না, মনুষ্যত্ব অর্জন করলেই তবে তাকে মানুষ বলে। গুরুসদয় দত্ত মনুষ্যত্ব এবং বাঙালিত্বকে অনেকটা সমপর্যায় ভুক্ত করে প্রয়োগ করেছেন।তাই তিনি আগে মানুষ হতে বলেছেন, পরে যুগপৎভাবে দেহ-মনে ষোল আনা বাঙালি হতে বলেছেন।
বর্তমানে বাংলাদেশের কিছু পশ্চাদপদ দক্ষিণপন্থী মানুষ বাঙালি ঐতিহ্য এবং সংস্কৃতি থেকে দ্রতগতিতে দূরে চলে যাচ্ছে। গুটিকয়েক জ্ঞানপাপী সজ্ঞানে যাচ্ছে। কিন্তু অধিকাংশই অন্যের দ্বারা প্ররোচিত হয়ে অজ্ঞানে আবব্ধ হয়ে যাচ্ছে।দেশ ১৯৭১ সালে বাঙালি জাতীয়তাবাদের উপরে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু সেই জাতীয়তাবাদ তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের মধ্যে পৌঁছে দিতে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়া উচিত ছিলো। বিভিন্ন প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ নেয়া উচিত ছিলো। কিন্তু সেই নেয়া হয়নি। যতটুকু নেয়া হয়েছে সকলই নমঃ নমঃ করে দায়সারা গোছের। তাই আজকে দেশে রাজাকারি মানসিকতার দেশদ্রোহীদের প্রকাশ্য আস্ফালন প্রতিনিয়ত আমরা দেখছি। এদের কোষ্ঠী ঠিকুজী খুঁজলে দেখা যাবে, এদের বাবা এবং দাদারাই মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী ছিলো।এরা সর্বদাই থাকে সুযোগের অপেক্ষায়। তাদের দৃষ্টিতে এবং তাদের পরিভাষায় বাঙালি সংস্কৃতি মানেই হিন্দু সংস্কৃতি। তাই তা পরিত্যাজ্য।বিষয়টি অত্যন্ত দুঃখজনক এবং লজ্জার। এই বাঙালি নামক কুলাঙ্গাররাই ২০০১ সালের ১৪ এপ্রিল, ১৪০৮ বঙ্গাব্দের পয়লা বৈশাখের দিন ভোরে রমনার বটমূলে ছায়ানটের বর্ষবরণ অনুষ্ঠানস্থলে বোমা বিস্ফোরণ করে। তারা রমনা বটমুলে দুটি বোমা পুঁতে রেখে রিমোট কন্ট্রোলের সাহায্যে বিস্ফোরণ ঘটায়। সকাল ৮টা ৫ মিনিটে একটি ও ১০-১৫ মিনিটে আরেকটি বোমার বিস্ফোরণ করে। নৃশংস এ বোমা হামলায় ঘটনাস্থলেই প্রাণ হারান ৯ জন। পরবর্তীতে মৃত্যুবরণ করেন আরও একজন। মৃত দশজনের মধ্যে নয়জনই সাংস্কৃতিক কর্মী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের দর্শক। পাশাপাশি আহত হন আরো অগণিত মানুষ। মৃত প্রায় সকলেরই বয়স পয়ত্রিশ বছরের নিচে। এ মৌলবাদী শক্তি চেয়েছিলো ভয় এবং ত্রাশ সৃষ্টি করে সাধারণ বাঙালিকে নববর্ষ থেকে দূরে রাখা। কিন্তু তাদের সেই লক্ষ্য অপূর্ণই থেকে গেছে। পরের বছর ২০০২ সালে দেখা যায় আরও বেশি মানুষের সমাগম হয়েছিলো রমনার বটমূলে বর্ষবরণের অনুষ্ঠানে। এরা হয়তো জানে না, বাঙালিকে দাবিয়ে রাখা যায় না।
বাংলা ভাষা এবং সংস্কৃতির এ সংকুচন প্রসারণ থাকবেই। এর মধ্যেই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তা না হলে আমরা পথ হারিয়ে ফেলবো। বর্তমানে বাংলা ভাষায় বিদেশি ভাষার আধিপত্য দিনেদিনেই বাড়ছে। যা আমাদের জন্যে একটি বিপদসংকেত। বাঙালি সংস্কৃতি এক ক্রান্তিকালীন সময় অতিক্রম করছে। নববর্ষের পূর্বে নীলপূজা, চড়কপূজা, চৈত্র সংক্রান্তি এভাবে বাঙালির প্রত্যেকটি উৎসব অত্যন্ত রঙিন এবং বর্ণাঢ্য। চট্টগ্রাম সহ কিছু কিছু অঞ্চলে চৈত্র সংক্রান্তির পূর্বে বিভিন্ন ঔষধি লতাপাতা জ্বালিয়ে গায়ে ধোঁয়া দেয়া হয়। নববর্ষকে উপলক্ষ করে সারা বাড়ি পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়। ঘরের বিভিন্ন স্থানে নিমপাতা, ফুল বেঁধে দেয়া হয়। চৈত্র সংক্রান্তির দিন বিভিন্ন তরকারী ও ঔষধী তরিতরকারির মিশ্রণে ঘন্ট তৈরী করা হয়। বছরের নতুন দিন বয়োজ্যেষ্ঠদের প্রণাম করে আশীর্বাদ নেয়া হয়। খই, বুট, বাদাম, ছাতুর বিভিন্ন প্রকারের মোয়া এবং নাড়ু তৈরি করা হয়। যে সকল বাঙালি নামধারী শাশ্বত এই সংস্কৃতিকে হৃদয়ে ধারণ করেনা এবং পালনও করেনা; তারা বাঙালি নয়। কারণ বাঙালির পরিচয় শুধু তার ভাষাতেই সীমাবদ্ধ নয়।বাংলা বলতে পারলে সহজে বাংলাভাষী হওয়া যায়, কিন্তু বাঙালি হওয়া যায়না। বাঙালী হতে হলে আবহমান শাশ্বত সংস্কৃতির প্রতি মমত্ববোধ এবং ঐকান্তিক টান অনুভব করতে হয়।
সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, বাংলাদেশ।