আমাদের মনের ইচ্ছা অনন্ত ; আমরা এক জীবনে সকল কিছুই করতে চাই, সকল কিছুই পেতে চাই।অনেক সময় অন্তরের প্রেরণায় কাজ শুরু করে দেই। কিন্তু এরপরে পরিবেশ পরিস্থিতিতে আমরা আবার "ব্যাক টু প্যাভিলিয়নে" চলে আসতে বাধ্য হই। আমাদের যাপিত জীবনের বিভিন্ন কাজে অধিকাংশ সময়েই হাজারটা প্রতিবন্ধকতা চলে আসে। যদি কাজটি মানুষের কল্যাণের হয়, তবে তো কথাই নেই। প্রতিবন্ধকতা আসবেই আসবে। এ প্রতিবন্ধকতা থেকে উত্তরণে প্রেরণা দিতে বাংলা ভাষায় অসংখ্য কবিতা এবং সংগীত রচিত হয়েছে।
"করিতে পারি না কাজসদা ভয় সদা লাজসংশয়ে সংকল্প সদা টলে,-পাছে লোকে কিছু বলে।আড়ালে আড়ালে থাকিনীরবে আপনা ঢাকি,সম্মুখে চরণ নাহি চলেপাছে লোকে কিছু বলে।"
কিন্তু বাংলাদেশ অনেকে আবার নিজেকে প্রকাশ করতে চাই না। বিষয়টি দেশের সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে বেশী দেখা যায়। নিজের নাম কেউ জিজ্ঞাসা করলে, আমরা নিজের কমন একটি নাম অথবা বাড়ির ছোট্ট ডাক নাম বলি। সম্পূর্ণ নাম তো বলিই না, অনেক সময়ে নামের মধ্যে যদি দেবদেবীদের নাম থাকে তবে, সে নামটিকেই বাদ দিয়ে; নিজেই নিজের একটি ডাকনাম দিয়ে দেই। যাতে নাম শুনে কেউ ধর্মীয় পরিচয় বুঝতে না পারে। নাম, অস্তিত্ব এবং ধর্মীয় পরিচয় গোপন করা বোকা ব্যক্তিরা নিজেরাও হয়ত জানে না, যতই গোপন করার প্রচেষ্টা করুক, বিষয়টি কখনই গোপন থাকে না। বরং তার নিজের অস্তিত্ব গোপন করার মানসিকতা থেকে বন্ধুদের মাঝে সে হাস্যরসের পাত্র হয়।এমনও দেখেছি, কারো নাম জনার্দন সে যখন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে গিয়েছে ; তখন নিজের নাম জনার্দন থেকে জন বানিয়ে নিয়েছে। এমনিভাবে কারো নাম মুকুন্দ, সে মাইকেল বানিয়ে নিয়েছে। গ্রামের গরীব কৃষক বাবার টাকায় চলা, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া এ ছেলেদের কাছে পরবর্তীতে যখন তাদের বাবা সহ পরিবারের লোকজন খুঁজতে আসে; তখন আর তাদের খুঁজে পায় না। খুঁজে পাবে কি করে? নিজের পিতৃদত্ত নামটি শুধু কাগজে-কলমে সার্টিফিকেটে সীমাবদ্ধ রেখে বন্ধুদের কাছে সে নিজের দেয়া পরিবর্তিত নামেই পরিচিত। এ নতুন নামটি তো পরিবার পরিজনরা জানে না। যখন ছাত্র ছিলাম এমন অসংখ্য গল্পের উদাহরণ আমি জগন্নাথ হলের আবাসিক ছাত্রদের মধ্যেই দেখেছি । তাই নিজে যা, তাই নিঃসঙ্কোচে প্রকাশ করতে হবে। আমি যেমন, তেমন করেই যদি আমি পরিচিত হই, তবে অন্যরাও সম্মান করবে। কবি কামিনী রায় কবিতাটির শেষ স্তোবকে আরও বলেছেন, চোখের সামনে যখন মহৎ উদ্দেশ্য থাকে, এরপরেও আমরা সকলে এক সাথে মিলে দলবদ্ধ হতে পারি না। পাছে লোকে কিছু বলে, এ চিন্তাতেই সদা ম্রিয়মাণ থেকে জীবনীশক্তি ধীরেধীরে নষ্ট করি।
"মহৎ উদ্দেশ্য যবে,এক সাথে মিলে সবে,পারি না মিলিতে সেই দলে,পাছে লোকে কিছু বলে।বিধাতা দেছেন প্রাণথাকি সদা ম্রিয়মাণ;শক্তি মরে ভীতির কবলে,পাছে লোকে কিছু বলে।"
কবি কামিনী রায় সংস্কৃত সাহিত্যের ছাত্রী ছিলেন। তিনি ১৮৮৬ সালে 'বেথুন ফিমেল স্কুল' থেকে বিএ পরীক্ষায় সংস্কৃতে দ্বিতীয় শ্রেণীতে অনার্স সহ উত্তীর্ণ হন। তিনিই ভারতের প্রথম মহিলা অনার্স গ্রাজুয়েট। সংস্কৃত সাহিত্যের ছাত্রী হওয়ার কারণে কবি কামিনী রায়ের লেখায় সংস্কৃত সাহিত্যের অসম্ভব প্রভাব পাওয়া যায়। কামিনী রায়ের বিখ্যাত "পাছে লোকে কিছু বলে" কবিতার অন্তর্নিহিত ভাবটি ভর্তৃহরি এবং বিশাখদত্ত এ দুজন খ্যাতিমান সংস্কৃত কবির রচনাতেই পাওয়া যায়। কবি ভর্তৃহরি এবং বিশাখদত্ত এ দুজনের সংস্কৃত রচনাতেই একটি বিখ্যাত শ্লোক আছে। শ্লোকটিতে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, অধমব্যক্তিগণ কাজে বাধা আসবে এই ভয়ে এবং দুশ্চিন্তায় কোন কাজ শুরুই করতে পারেন না।তবে মধ্যমসারির ব্যক্তিগণ ভাল কাজ আরম্ভ করেন বটে, তবে সামান্যতম বাধা পেলেই কাজটি পরিত্যাগ করে চলে যান। কিন্তু উত্তমব্যক্তিগণ পথে সহস্র সহস্র বাধাবিঘ্ন আসলেও, শুরু করা কাজ গন্তব্যে পৌছানো পর্যন্ত নিরবচ্ছিন্নভাবে করেই যান। উত্তমব্যক্তিগণ শুরু করা কাজ সমাপ্ত না হওয়া পর্যন্ত আমৃত্যু পরিত্যাগ করেন না।
প্রারভ্যতে ন খলু বিঘ্নভয়েন নীচৈঃপ্রারভ্য বিঘ্নবিহতা বিরমন্তি মধ্যাঃ।বিঘ্নৈঃ পুনঃ পুনরপি প্রতিহন্যমানাঃপ্রারব্ধমুত্তমজনা ন পরিত্যজন্তি।।( ভর্তৃহরির নীতিশতক:২৭)
"অধমব্যক্তিগণ বিঘ্নের ভয়ে কাজ আরম্ভই করেন না। মধ্যমব্যক্তিগণ কাজ আরম্ভ করে বটে, বিঘ্নের দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হলেই কর্ম থেকে বিরতি নেন। কিন্তু উত্তমব্যক্তিগণ বিঘ্ন দ্বারা বার প্রতিহত হয়েও, আরম্ভ কাজ পরিত্যাগ করেন না। অর্থাৎ বার বার বাধা পেয়েও উত্তমব্যক্তিগণ যে কাজে হাত দেন তা শেষ করে তবে ছাড়েন।"
সূর্য যেমন অবিচ্ছিন্নভাবে উত্তাপ দিয়ে যাচ্ছে, চন্দ্র যেমন অবিচ্ছিন্নভাবে কিরণ দিয়ে রজনীকে আলোকিত করছে। ঠিক একইভাবে যিনি উত্তমব্যক্তি তিনি সকল লজ্জা ভয়ের বন্ধন ছিন্ন করে নিজের কর্তব্যকর্ম যথাযথ করে যান। আপনার কর্মে মানুষ হাসি-ঠাট্টা করতে পারে, কিন্তু আপনার দৃষ্টিতে যা সঠিক মনে হবে, আপনার বিবেক যা বলবে তাই করবেন। এতেই জীবনে সফলতা আসবে। আমাদের আশেপাশের অনেকে নারীদের জন্মগত সংস্কারবশত তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে। নারী হয়ে চাকুরী করতে পারবে না, মোটরসাইকেল চালাতে পারবে না, খেলাধূলা করতে পারবে না, এটা করতে পারবে না, সেটা করতে পারবে না ইত্যাদি। কিন্তু সেই অসহায় নারীর যদি ঘরে দু'বেলা দুমুঠো খাওয়ার চাল না থাকে ; তবে সেই নিন্দুক ব্যক্তিরা একবারের জন্যেও কি সেই অসহায় নারীকে সাহায্য সহযোগিতা করেন? অধিকাংশই করেন না। লেকচার দেয়ার সময় আমাদের হুঁশ থাকে না। নিজেরা পালন না করলেও, অন্যকে জ্ঞান দেয়ার সময়ে ষোলকলা পূর্ণ করে আমরা জ্ঞান দেই। এটাই হল আমাদের জাতীয় চরিত্র। বিষয়টি নিয়ে বাঙালির একটি প্রবাদ আছে, "ভাত দেয়ার সাধ্য নেই, কিল দেয়ার গোসাঁই।" ভাত দেয়ার গোসাঁই না থাকলেও, কিল দেয়ার গোসাঁই আমাদের আশেপাশে অনেক আছে। তাই এদের থেকে যতটা দূরত্বে থাকা যায়, ততই সকলের কল্যাণ, জগতের কল্যাণ।
সহকারী অধ্যাপক, সংস্কৃত বিভাগ ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ, বাংলাদেশ।।