বেদে জগতের সকল জীবকে মিত্রের দৃষ্টিতে দেখতে বলা হয়েছে। সকল জীবের মাঝে ঈশ্বরকে দর্শন এবং অনুভব করতে বলা হয়েছে। বৈদিক সমদর্শী শিক্ষা পৃথিবীর সর্বপ্রাচীন হলেও, বর্তমানকালের জন্য সমানভাবে প্রযোজ্য। এ যুগোপযোগী আধুনিক ও চিরন্তন শিক্ষা সাম্প্রতিক সাম্যবাদ ও সমাজতন্ত্রের ধারণার বহুপূর্বে অকৃত্রিম অপৌরুষেয় জ্ঞানগঙ্গার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত।
যস্তু সর্বাণি ভূতান্যাত্মন্নেবানু পশ্যতি।
সর্বভূতেষু চাত্মানং ততো ন বিচিকিৎসতি।।
(শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতা: ৪০.৬)
"যে ব্যক্তি সমস্ত জীবেই ঈশ্বরে অবস্থিত- এরূপ দর্শন করেন, অনুভব করেন এবং সমস্ত জীবের মধ্যে ঈশ্বরের বাস দেখেন তখন তিনি কারও প্রতি বিদ্বেষ করেন না।"
বৈদিক এ সমদর্শী শিক্ষা বাস্তব জীবনে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই কথার কথা রয়ে যায়। তত্ত্বগুলো খুব একটা প্রায়োগিকক্ষেত্রে ব্যবহৃত হয় না। এ কারণেই আমাদের সমাজে হিংসা বিদ্বেষের আগুন সর্বক্ষেত্রে। তবে জীবন চলার পথে প্রকৃত বন্ধু খুঁজে নেয়ার মত এমন বালাই আর নেই। জীবনে সুসময়ে বন্ধু নামে অনেককেই পাওয়া যায়। বন্ধুত্বের প্রথম অবস্থায় তাদের চেনা যায় না এদের অনেকের মুখই মুখোশের আড়ালে লুকায়িত থাকে। শত্রুরূপে প্রকাশের আগে পর্যন্ত সে বন্ধুরূপেই থাকে। স্বার্থের প্রশ্নে অথবা কখনো অকারণে যখন বন্ধুত্বের মুখোশটি খুলে পরে যায়, তখনই মানুষ বুঝতে পারে; যাকে এতদিন বন্ধুত্বের নিবিড় বন্ধনে জড়িয়ে ধরে ছিল, সে আসলে বন্ধু নয়, শত্রু।শত্রু কখনো বিশ্বাসঘাতকতা করে না, সে বিশ্বাসঘাতকতা করার সুযোগও খুব একটা পায় না। বিশ্বাসঘাতকতা করে বন্ধুর ছদ্মবেশে বহুরূপীরা। জীবন চলার পথে কাউকেই অপরিহার্য মনে করে বেশি পাত্তা দিতে নেই। তবে সে পেয়ে বসবে। সে ভালবাসাকে কলঙ্কিত করে প্রভুত্ব শুরু করবে। ভালবাসার প্রতি সমর্পিত মানুষকে তার করায়ত্ব মনে করে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করবে। জীবনে যেমন আশেপাশের প্রত্যেককেই প্রয়োজন; তেমনি কেউ অপরিহার্য নয়। শ্রাদ্ধশান্তি বিধিতে কাকের প্রয়োজন হয়।কিন্তু যে দেশে কাক নেই সেদেশে কি শ্রাদ্ধশান্তি হয় না? অবশ্যই হয়। তাই জীবন চলতে সকলেই প্রয়োজনীয়, আবার কেউ অপরিহার্য নয়।
মানুষের জীবনের সবচেয়ে বড় যে শত্রু তাকে কখনই সহজে চেনা যায় না। একসাথে চলতে চলতে অবশেষে স্বরূপ প্রকাশিত হয়।বন্ধু বা প্রিয় আপনজন শত্রু হলে এর থেকে ভয়ংকর আর কিছুই হতে পারে না। জগতের অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা গেছে পৃথিবীর অনেক বিখ্যাত বা কুখ্যাত ব্যক্তি বিপদে পরেছে শুধু আপনজনদের দ্বারা। ব্রিটিশ শাসিত ভারতবর্ষে চট্টগ্রাম যুব বিদ্রোহের মহানায়ক মাস্টারদা সূর্য সেনও সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশের ধরা পরে কাছের নিকটাত্মীয়ের বিশ্বাসঘাতকতায়। মাস্টারদা সূর্য সেন ১৯৩৩ খ্রিষ্টাব্দের ২রা ফেব্রুয়ারি পটিয়া উপজেলার গৈরালা গ্রামে আত্মগোপন করেন। সে সময়ে বিদেশি ব্রিটিশ সরকার তাঁর মাথার দাম প্রথমে পাঁচহাজার টাকা ধার্য করে ; পরবর্তীতে সেই টাকার অঙ্ক বাড়িয়ে দশহাজার টাকায় পরিণত করে দেয়। যাতে লোভে পরে মাস্টারদাকে কেউ ধরিয়ে দেয়। মাস্টারদা সূর্য সেন পটিয়ায় তাঁর এক আত্মীয় ব্রজেন সেনের ব্যবস্থাপনায় তাদের গ্রামের বিশ্বাস-বাড়ির গৃহবধু ক্ষিরোদাপ্রভা বিশ্বাসের ঘরে আশ্রয় নেন। ব্রজেন সেনের বাসা থেকে কার জন্য খাবার নিয়ে ক্ষিরোদাপ্রভা বিশ্বাসের ঘরে যাচ্ছে, তা জানার জন্য ব্রজেন সেনের ভাই নেত্র সেন বিশেষ আগ্রহী হয়ে ওঠে। পরে সূর্য সেনের অবস্থানের কথা জানতে পরে, টাকার লোভে দেশ ও জাতির সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করে ব্রিটিশ পুলিশকে মাস্টারদার অবস্থানের তথ্য পাচার করে দেয়। রাতেরবেলা আলোর সংকেত দেখিয়ে নেত্র সেন সৈন্যদের পথ দেখায়। বিষয়টি ব্রজেন সেন বুঝতে পেরে শেষ মুহূর্তে চেষ্টা করেও সূর্য সেনকে রক্ষা করতে পারেননি। মাস্টারদা গোর্খা ব্রিটিশ সৈন্যের হাতে ধরা পরে যায়।পরবর্তীতে ১৯৩৪ খ্রিষ্টাব্দের ১২ জানুয়ারিতে তাঁর ফাঁসি কার্যকর হয়। তাই বলা যায়,শত্রু শত্রুরূপের পূর্বে আশেপাশে বন্ধুরূপেই থাকে।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।