কৈবল্যধাম প্রচারিত পাঁচালীতে,
অশাস্ত্রীয় পীর-পয়গম্বর প্রসঙ্গ
চট্টগ্রামের ইতিহাস সংস্কৃতির সাথে অবিচ্ছেদ্যভাবে আছে শ্রীরাম ঠাকুরের স্মৃতির সাথে যুক্ত কৈবল্যধাম মন্দির। শ্রীরাম ঠাকুরের ভক্তদের কাছে মন্দিরটি অত্যন্ত পবিত্র এবং গুরুত্ববহ। এ কারণেই শ্রীরাম ঠাকুরের পরম্পরাগত মোহান্তরা এ কৈবল্যধাম মন্দিরেই বাস করেন। কৈবল্যধামে শ্রীরাম ঠাকুরকে উদ্দেশ্য করে যে সত্যনারায়ণ পূজা করা হয়ে ; সেই পূজায় মধ্যযুগের লেখা একটি পাঁচালী ব্যবহৃত। খুবই দুঃখজনক এবং আপত্তিকরভাবে সেই পাঁচালীতে সনাতন ধর্ম বহির্ভূত পীর-পয়গম্বর প্রসঙ্গ পাওয়া যায়; যা সম্পূর্ণভাবে অশাস্ত্রীয়।
অষ্টাদশ শতাব্দীর মঙ্গলকাব্য ধারার এক কবি ছিলেন রামেশ্বর ভট্টাচার্য। বাড়ি ছিলো তার পশ্চিমবাংলার মেদেনীপুর জেলার ঘাটাল মহকুমার বরদাবাটীর যদুপুর নামক এক পল্লীগ্রামে। তিনি ছিলেন তার নিজ গ্রাম থেকে বিতাড়িত এক ভাগ্যবিড়ম্বিত কবি।তিনি অনেক কাব্য লিখেছেন। তার মধ্যে শিব-সঙ্কীর্ত্তন বা শিবায়ন ও সত্যনারায়ণের পাঁচালী অন্যতম। তার মৃত্যুর প্রায় ২৫০ বছর পর তার লেখা একটা ছোট্ট পাঁচালী বৃহত্তর নোয়াখালী চট্টগ্রাম অঞ্চলে যে এতটা জনপ্রিয়তা পাবে তা হয়তো তিনি নিজেও কোনদিন কল্পনা করেননি!
আজ রামঠাকুরের শিষ্যদের কারনে মাত্র ৩২ শ্লোকের এ ছোট্ট বইটি এ অঞ্চলের ধর্মগ্রন্থে রুপান্তরিত হয়ে গেছে। ছোট্ট এ বইটি রামঠাকুরের খুব পছন্দ হয়। তাই তিনি তার শিষ্যদের মাঝে এ বইয়ের প্রচার করেন বলে জানা যায়। কিন্তু এই বইয়ের মধ্যে যে কি পরিমাণে সনাতন ধর্ম বিরোধী তথ্য আছে তা তার শিষ্যরা কখনো লক্ষ্য করেছে কিনা আমার ঠিক জানা নেই! নাকি শুধু গড্ডালিকা প্রবাহেই চলছে সবকিছু?
কোরাণ কেতাব্ আর কলমা-সংহতি।
সুফি খাঁ পীরের পায় প্রচুর প্রণতি।।
সাত শত আউলিয়া বন্দি করজোড়ে।
ফণীদ্র নগেন্দ্র ইন্দ্র কাঁপে যাঁর ডরে।।
যদি কোরাণ, হাদিস, পীর, ফকির, সাতশত আউলিয়াদের ভয়তে দেবরাজ ইন্দ্রসহ ফনীন্দ্র, নগেন্দ্র সহ সকল দেবদেবী সবাই ভয়তে( ডরে) তটস্থই থাকে, তবে আর আমাদের দেবদেবীদের পূজা করে কি লাভ?
সবার কোরাণ, হাদিসেরই অনুগত হয়ে যাওয়া উচিত!সবচেয়ে মজার ব্যপার এই বইয়ের শেষ শ্লোকে(৩২) বলা আছে, এই পূজার অর্থাৎ সত্যনারায়ণ পূজার ফলে আপনাকে দয়া করবে পীর-পয়গম্বরগণ। পূজা করবেন সত্যনারায়ণের আর দয়া করবে পীর-পয়গম্বরা! পাঁচালির সর্বশেষে সবাইকে মুজরা সেলাম (পাপ স্বীকার করে আল্লাহের কাছে ক্ষমা প্রার্থনা) করতে বলা হতেছে।
রামঠাকুরের ভক্তদের অনুষ্ঠিত সত্যনারায়ণ পূজায় অনেকেই দেখেছেন, পাঁচটি আসনে, পাঁচটি বাটিতে পাঁচপীরের সিন্নি দেয়া হয়। আপনি জানেন সেই পাঁচপীরের নামগুলো কি কি ?
আপনি অবাক হয়ে যাবেন, ড. শ্রীপুলিনরঞ্জন দাস রচিত শ্রীশ্রীসত্যনারায়ণের সেবাই পূজা গ্রন্থের ৩৪ পৃষ্ঠায় পাঁচপীরের তালিকা সম্পর্কে যা লেখা আছে আমি হুবুহু তা কোড করছি, "সেই আসনে বসবে সত্যপীরের পাঁচজন পয়গম্বর। তাঁরা পীর। তাঁরা হলেন -১. ইউনুস, ২. হূদ, ৩. ইব্রাহীম, ৪. নূহ এবং ৫. হজরত মোহম্মদ। "
আপনি বাংলাদেশের বর্তমান বাস্তবতায় একবার চিন্তা করুন ত, এই যে নবী হজরত মোহম্মদ সহ ইসলামের পাঁচজন পয়গম্বরদের আসন দিয়ে, তাদের নামে সিন্নি দিয়ে পূজা করা কতটা বিপদজনক একটা বিষয়!
ইসলাম ধর্ম কি নবীদের পূজা সমর্থন করে?
এককথায় না।
আমাদের সনাতন ধর্মে কি নবীদের পূজার কথা আছে?
এরও উত্তর না।
তাহলে ভাই এ সকল আত্মঘাতী তেলবাজি কাজ কেন করবো! অথবা এসকল কাজের কি প্রয়োজন আমাদের? হূদ নামে যে মুসলিমদের একজন নবী আছে সেটা আমি কেন অনেক মুসলিমই জানে না, অথচ এই হুদ নামক পয়গম্বরের নামেও আসন এবং সিন্নি দিয়ে পূজা করতে হবে আমাদের সত্যনারায়ণ পূজায়। আমি বিস্মিত বিষয়টাতে।
আপনারা গত ২০১৮ সালের ২০ এপ্রিল দেখেছেন চট্টগ্রামের পটিয়ার কালাবাবার আশ্রমে একটি সর্বধর্ম সমন্বয়ের অনুষ্ঠান বাতিল হয়; সেখানে অভিযোগ ছিলো পোস্টারে হিন্দুদেবদেবীদের ছবির সাথে আল্লাহু লেখা ছিলো। এতেই অসংখ্য মুসুল্লিরা বিরক্ত হয়ে প্রোগ্রামটি পণ্ড করে দেয়। রামঠাকুরের করা কৈবল্যধামের মনোগ্রামে দেখবেন সকল ধর্মের প্রতীকের সাথে সাথে ইসলামের বাঁকাচাঁদের প্রতীক দেয়া আছে। বাঁকাচাঁদের প্রতীকটি একটু নিচের দিকে দেয়া, যা যে কোন সময়ে কারো অনুভূতিতে আঘাত করে একটা তীব্র সাম্প্রদায়িক সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে।আমি কোন ধর্মের বিরোধী নয়, আমি চাই সকল ধর্মই বিশুদ্ধভাবে তাদের ধর্ম পালন করুক। কিন্তু কোন তেলবাজদের করা ভেজাল আমি পছন্দ করি না, তেমনিভাবে কোন সচেতন হিন্দু-মুসলিম ভাইয়েরাও তা পছন্দ করে না।
মাদারীপুর মহকুমা ভেঙে ১৯৮৪ সালের ১লা মার্চ শরীয়তপুর জেলা গঠিত হয়।শ্রীরাম ঠাকুরের সময়ে শরীয়তপুর জেলা বলতে কিছুই ছিল না। ফরিদপুর জেলার অন্তর্ভুক্ত মাদারীপুর মহকুমার মধ্যে ছিল শ্রীরাম ঠাকুরের জন্মস্থান ডিঙ্গামাণিক। তাই শ্রীরামঠাকুর বৃহত্তর মাদারীপুর অঞ্চলের হওয়ায়, আমি বাল্যকাল থেকেই লোকপরম্পরায় তাঁকে একজন মহাপুরুষ হিসেবেই জানি। সত্যিকারের একজন সাধক পুরুষের বৈশিষ্ট্য এবং দৃষ্টান্ত শ্রীরামঠাকুরের জীবনে পাওয়া যায়। কিন্তু তাঁর মৃত্যু পরবর্তী কৈবল্যধাম আশ্রম থেকে বিভিন্ন পূর্বে উল্লেখিত বিতর্কিত বিষয়েয় প্রবর্তন, তাঁর অনুগামীদের প্রশ্নবিদ্ধ করে ফেলছে।
মধ্যযুগের লেখা একটা পাঁচালী আর যাই হোক, অন্তত ধর্মগ্রন্থ হতে পারেনা। মধ্যযুগের কবিরা কোন পরিবেশে লিখেছে সবার আগে তা আমাদের অনুধাবন করা দরকার। বর্বর তুর্কি শাসনকালে তাদের শোষণের জাতাকলে পরে জীবনের মায়ায় অনেক কিছুই লিখতে হয়েছে তরোয়ালের ভয়তে। কিন্তু এখনতো সেই বাধ্যবাধকতা নেই। আমরা সত্যনারায়ণের পূজা উপলক্ষে শুধু সত্যনারায়ণেরই পূজা করবো। কি দরকার আমদের এই পূজোর আয়োজনে পাঁচপীরের (ইউনুছ নবী থেকে হযরত মোহাম্মদ) পূজা করা যা ইসলাম ধর্মাবলম্বীরাও অপছন্দ করে। বিষয়টা গভীরভাবে ভেবে দেখবেন।
চট্টগ্রামের কৈবল্যধাম মন্দির প্রসঙ্গ শ্রীরামঠাকুরের স্বহস্তে লেখা একটি নির্দেশনা আছে। সেখানে বলা আছে:
"কৈবল্যধামেতে সর্বদা ত্রিলোকস্থ, সমগ্র তীর্থাদি পবিত্র ক্ষেত্রসহ সকল দেবদেবী সর্বশক্তি সম্পন্ন হইয়া বিরাজ করিতেছেন। সময়মতে কোন মহাপুরুষ সকল সম্প্রদায়ের পরিচিত হইয়া এবং সকল সম্প্রদায়ের মাননীয়ভাবে আবির্ভূত হইয়া এই কৈবল্যনাথের মাহাত্ন সকল প্রকাশ করতঃ সকল সম্প্রদায়ের কৃতশক্তি দেখাইয়া প্রত্যক্ষভাবে জানাইয়া দিবেন।”
শ্রীরাম ঠাকুরের সেই নির্দেশনা অনুসারে চট্টগ্রামের কৈবল্যধাম মন্দিরে সকল দেবদেবী সর্বশক্তিসম্পন্ন হয়ে আজও বিরাজ করছেন। যে স্থানের এত আধ্যাত্মিক মাহাত্ম্য, সেই স্থান থেকে কেন পীর-পয়গম্বরের পূজা করার নির্দেশনা যুক্ত পাঁচালী প্রচারিত হচ্ছে। বিষয়টি মন্দিরে পবিত্রতাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের আধ্যাত্মিক তীর্থ হল গয়া, কাশী, বৃন্দাবন, চার ধাম, দ্বাদশ জোতির্লিঙ্গ, একান্ন দেবীপীঠ। এরসাথে গয়া, কাশী, বৃন্দাবন ইত্যাদি। পৌরাণিক শাস্ত্রে বর্ণিত এ সকল তীর্থক্ষেত্রকে পাশে রেখে চট্টগ্রামের পাহাড়তলীতে অবস্থিত কৈবল্যধাম মন্দিরেই কেন সকল দেবদেবী সর্বশক্তি সম্পন্ন হইয়া বিরাজ করতে করবেন? বিষয়টি বোধগম্য নয়। তবে এটাও ঠিক ঈশ্বর সর্বভূতেই বিরাজ করেন। উপনিষদে আছে, “সর্বং খল্বিদং ব্রহ্ম”।কৈবল্যধামে মন্দিরে শ্রীরাম ঠাকুরের নির্দেশনা অনুসারে দেবদেবীরা বিরাজই করার পরেও ১৯৭১ সালে সেখানে পাকিস্তানি বাহিনী দ্বারা মন্দিরের মোহন্ত সহ সকলেই নির্মমভাবে নিহত হন।
অধিকাংশ শ্রীরাম ঠাকুরের আশ্রম সত্যনারায়ণ মন্দির বা আশ্রম নামেই খ্যাত। সেই সত্যনারায়ণ মন্দিরে সত্যনারায়ণের বিগ্রহকেই পূজা পূজা করা উচিত। শ্রীরামঠাকুর গলায় তুলসীর মালাধারী একজন নিষ্ঠাবান বৈষ্ণব ছিলেন। তাই শ্রীরাম ঠাকুরের নামাঙ্কিত আশ্রমে তাঁর আরাধ্যদেবতা সত্যনারায়ণ বিগ্রহ পূজিত হলে, তিনিও প্রসন্ন হবেন। সত্যনারায়ণ পূজা পদ্ধতি স্কন্দ পুরাণ, ভবিষ্যপুরাণ সহ বিবিধ পুরাণে আছে। নারায়ণ পূজা পদ্ধতিও শ্রীমদ্ভাগবত পুরাণ, বিষ্ণু পুরাণ সহ বিবিধ পুরাণে আছে। সম্পূর্ণ সত্যনারায়ণ পূজা পদ্ধতিটি পুরোহিতদর্পণ গ্রন্থে আছে। এ সকল কোন গ্রন্থেই অন্য ধর্মাবলম্বীদের পীর-পয়গম্বরদের পূজা করার বিধান নেই। তাই সত্যনারায়ণ পূজাপদ্ধতিতে নব্য এই বিধানগুলো মানতে হিন্দু সম্প্রদায় বাধ্য নয়। বর্তমানে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের উচিত পূর্ববর্তী প্রজন্মদের ভুল-ত্রুটিগুলো সংশোধন করে শাক্ত, শৈব, বৈষ্ণব অথবা কর্ম, জ্ঞান, ভক্তিই নির্বিশেষে নিয়ে বৈদিক রাজমার্গে আসা।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
প্রথম পর্বের লিঙ্ক চট্টগ্রামের ইতিহাস সংস্কৃতির পুনর্পাঠ-১।