খুলনা জেলার রুপসা উপজেলার শিয়ালী গ্রামে ০৭.০৮.২০২১ ব্যাপকভাবে প্রস্তুতি নিয়ে সন্ধ্যা ছয়টার দিকে হামলা করে। সেই ধারাবাহিক নৃশংস হামলা চলে কয়েকঘন্টা ধরে। হামলাকারী মৌলবাদীদের অভিযোগ যে, মসজিদের পাশ দিয়ে কীর্ত্তণ করে কেন শ্মশানে যাওয়া হয়েছে। খুলনার রুপসার এই অঞ্চলটি হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত। এই অঞ্চল থেকে মুসলিম এলাকা এবং মসজিদ বেশ দূরে। এলাকার প্রত্যক্ষদর্শীদের মাধ্যমে জানা যায়৷ এলাকার কয়েকটা মন্দিরে নিয়মিত ধর্মানুষ্ঠান এবং নগর সংকীর্তন হয়। সম্পূর্ণ হিন্দু অধ্যুষিত এলাকায় নগর সংকীর্তন নিয়ে কেন দূরের মুসলিম প্রতিবেশীদের আপত্তি বোধগম্য নয়। তবে বিষয়টি আপাতদৃষ্টিতে বোধগম্য না হলেও, আমরা যদি ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাছিরনগর, সুনামগঞ্জের শাল্লাসহ নিকট অতীতে ঘটে যাওয়া ঘটনায় দিকে সামান্যতম দৃষ্টি দেই; তবে একটি বিষয় আমাদের চোখে সুস্পষ্ট। তা হল বর্তমানে আক্রমণ হচ্ছে সেই সকল সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলে, যে সকল অঞ্চলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ে ৪০ থেকে ৫০ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থাৎ এখানে প্রয়োজন জনবিন্যাস পরিবর্তন। আর কিছুই নয়। এর জন্যে কোন একটি ছুঁতায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে ভয় দেখিয়ে তাদের মাঝে আতঙ্ক সৃষ্টি করে স্বেচ্ছায় দেশত্যাগে বাধ্য করা। ১৯৪৭ সালের দেশভাগের সময়েও খুলনা একটি হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল ছিল। তখন হিন্দু সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা ছিল ৭৬% এবং মুসলিম সম্প্রদায়ের লোকসংখ্যা ছিল ২৪%। সেই খুলনায় বর্তমানে হিন্দু সম্প্রদায় মাত্র ৩০ শতাংশের কাছাকাছি। ভাবা যায় কি পরিমাণে মানুষ দেশত্যাগ করেছে? ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দের মুক্তিযুদ্ধের সময় অন্যতম বৃহত্তর গণহত্যা সংগঠিত হয়েছে, খুলনার চুকনগরে। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূগোল বিভাগের প্রাক্তন প্রধান অধ্যাপক Dr. S.P. Chatterjee একটি বিখ্যাত গ্রন্থ রয়েছে। গ্রন্থটির নাম 'The partition of Bengal A Geographical Study With Maps And Diagrams'. এ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যসমৃদ্ধ গ্রন্থটি 'Geographical Society Of India, Kolkata' থেকে প্রকাশিত হয়। গ্রন্থটিতে ১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের দেশভাগের সময়কালীন প্রত্যেকটি জেলা, মহকুমা এবং থানা স্তরের হিন্দু,মুসলিম এবং অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষের জনসংখ্যার শতাংশ উল্লেখ করা হয়েছে।সেই সুবিখ্যাত বইয়ের আলোকে আমরা যদি দেশভাগের সময়ে খুলনার হিন্দু-মুসলিম সম্প্রদায়ের মানুষের সংখ্যা এবং শতাংশের দিকে দৃষ্টি দেই তবে যে তথ্যগুলো পাওয়া যায়, তা হল:
খুলনা সদর সাবডিভিশন
আয়তন: ৮১২ বর্গকিলোমিটার
লোকসংখ্যা: ৬,২৯,৪১৮
মুসলিম জনসংখ্যা: ২,৬০,৮৬৯ (২৪%)
১.খুলনা সদর:
আয়তন: ৩৮ বর্গকিলোমিটার
লোকসংখ্যা: ৭০,৭৯৮
মুসলিম জনসংখ্যা: ২৫,৮৫৩ (৩৭%)
২. তারাকান্দা
আয়তন: ৮৩ বর্গকিলোমিটার
লোকসংখ্যা: ৬৬,৭৯০
মুসলিম জনসংখ্যা: ৩২,০৭০ (৪৮%)
৩. দৌলতপুর
আয়তন: ৩৪ বর্গকিলোমিটার
লোকসংখ্যা: ৫৭,০১২
মুসলিম জনসংখ্যা: ২৫,০০৮ (৪৪%)
৪.ফুলতলা
আয়তন: ২৯ বর্গকিলোমিটার
লোকসংখ্যা: ৩৩,২৫৫
মুসলিম জনসংখ্যা: ২২,০৬১ (৬৬%)
৫.বটিয়াঘাটা
আয়তন: ৯৭ বর্গকিলোমিটার
লোকসংখ্যা: ৯৭,৩২০
মুসলিম জনসংখ্যা: ১৭, ৬৫২ (৩১%)
৬.ডুমুরিয়া
আয়তন: ১৭৪ বর্গকিলোমিটার
লোকসংখ্যা: ১,০৯, ১২০
মুসলিম জনসংখ্যা: ৪৭,৮৪০ (৪৪%)
৭.পাইকগাছা
আয়তন: ২৪৭ বর্গকিলোমিটার
লোকসংখ্যা: ১,৭০,৮৩৪
মুসলিম জনসংখ্যা: ৭৯,৬৫৯ (৪৭%)
৮. দাকোপ
আয়তন: ১০০ বর্গকিলোমিটার
লোকসংখ্যা: ৬৪,২৮৯
মুসলিম জনসংখ্যা: ১০,৬৪৬ (১৭%)
(Chatterjee 2007 : 77)
১৯৪৭ সালে খুলনার ফুলতলা ছাড়া (৬৬%) আরও কোথাও মুসলিম সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠতা ছিল না। কিন্তু বর্তমানে দৃশ্যপট সম্পূর্ণ প্রায় অন্যরকম। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পল্লীতে সাম্প্রদায়িক আক্রমণের ক্ষেত্রে কয়েকটি বিষয় সাধারণ। বৃহস্পতিবার জুড়ে সাম্প্রদায়িক প্রচারণা করা, ধর্মী প্রতিষ্ঠানের মাইক থেকে বিবিধ প্রকারের সাম্প্রদায়িক উত্তেজক কথা বলে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করে লোক জড়ো করা এবং সেই জড়ো করা মানুষদের সাথে নিয়ে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের পল্লীতে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ করা। আক্রমণের সাথে সাথে সাধ্যমত লুটপাট এবং উপস্থিত সংখ্যালঘু নারীদের লাঞ্ছিত করা।এই সাম্প্রদায়িক আক্রমণকারীদের মধ্যে অনেকে হয়ত জানেও না, কোথায় আক্রমণ করতে যাচ্ছে বা কেন যাচ্ছে। কারণ তাদের নেতা বলেছে। নাছিরনগর, শাল্লাসহ গত কয়েকটি ঘটনার পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, সে নেতা ধর্মীয় মৌলবাদী গোষ্ঠীর যেমন হতে পারে; তেমনি রাজনৈতিক নেতাও হতে পারে। ক্ষমতাসীনের সাথে সাথে বিরোধী দলেরও হতে পারে ; অথবা যৌথ সর্বদলীয় হতে পারে। অর্থাৎ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের পল্লীতে আক্রমণের ক্ষেত্রে বিষয়টি কেন যেন, সর্বদলীয় হয়ে যায়; এটাই বড় আশ্চর্যের। খুলনার রুপসার ক্ষেত্রেও ঠিক একই প্রকারের পুরাতন নাটক মঞ্চায়ন হয়েছে। ঘটনাগুলো দেখতে দেখতে আমরা যারা একটু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অস্তিত্ব নিয়ে চিন্তাভাবনা করি; আমাদেরও ঘটনার প্রেক্ষাপট, মঞ্চায়ন এবং কলাকুশলীদের অভিনয় কৌশল একঘেয়ে মুখস্ত হয়ে গেছে। এই সাম্প্রদায়িক আক্রমণকারী প্রযোজক এবং পরিচালকদের উচিত নতুন কলাকৌশল আবিষ্কার করা। কারণ, একই কাহিনীতে আর কত নির্মম চলচিত্র নির্মিত হবে?
খুলনার রুপসার শেয়ালীর ঘটনার চিত্রনাট্য একই প্রকারের। ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের মাইকে ঘোষণা দিয়ে হাজার খানেক সংখ্যাগরিষ্ঠ জনতাকে জড়ো করে, পরবর্তীতে সংখ্যালঘু হিন্দু পল্লীতে সাম্প্রদায়িক আক্রমণ করা হয়। আক্রান্ত ভুক্তভোগীদের পক্ষে অভিযোগ করা হয়, আক্রমণে ৪টি বড় মন্দিরসহ ১০ মন্দির বিধ্বস্ত হয়। ৫৪ টি সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িতে হামলাসহ ব্যাপকভাবে লুটপাট করা হয়।এ ভয়াবহ সাম্প্রদায়িক আক্রমণ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের অন্যতম জাতীয় দৈনিক সমকাল অনলাইন পত্রিকায় "খুলনায় দুর্বৃত্তের হামলা, ৪ মন্দির ও বাড়িঘর ভাঙচুর" (০৭.০৮.২০২১) শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়। সমকালে ঘটনার বিবরণ সম্পর্কে বলা হয় :
"গ্রামবাসী ও পূজা পরিষদের নেতারা জানান, শুক্রবার রাত ৯টার দিকে পূর্বপাড়া মন্দির থেকে কয়েকজন নারীভক্ত কীর্তন করতে করতে শিয়ালী মহাশ্মশানের দিকে যাচ্ছিলেন। পথের মাঝে একটি মসজিদ ছিল। মসজিদের ইমাম নারীদের কীর্তন করতে নিষেধ করেন। তখন কিছুটা তর্কাতর্কি হয়। বিষয়টি নিয়ে শনিবার থানায় বৈঠক হওয়ার কথা ছিল।
প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান, শনিবার বিকেল পৌনে ৬টার দিকে শতাধিক যুবক রামদা, চাপাতি, কুড়াল নিয়ে শিয়ালী গ্রামে হামলা চালায়। তারা অতর্কিতে বাজারের গণেশ মল্লিকের ওষুধের দোকান, শ্রীবাস মল্লিকের মুদি দোকান, সৌরভ মল্লিকের চা ও মুদি দোকান, অনির্বাণ হীরার চায়ের দোকান ও তার বাবা মজুমদারের দোকান ভাঙচুর করে। এ সময় শিবপদ ধরের বাড়িতে হামলা চালিয়ে লুটপাট করা হয়। তার বাড়ির গোবিন্দ মন্দির, শিয়ালী পূর্বপাড়া হরি মন্দির, শিয়ালী পূর্বপাড়া দুর্গা মন্দির, শিয়ালী মহাশ্মশান মন্দিরের বেশিরভাগ প্রতিমা ভাঙচুর করা হয়। এ সময় কয়েকজন বাধা দিতে গেলে তাদের পিটিয়ে আহত করা হয়। এলাকাবাসী প্রতিরোধ তৈরি করার আগেই যুবকরা পালিয়ে যায়।
রূপসা থানা পূজা উদযাপন পরিষদের সভাপতি শক্তিপদ বসু বলেন, হামলার সময় গ্রামবাসী এক হয়ে প্রতিবাদ করতে গেলে শিয়ালী ক্যাম্পের পুলিশ উল্টো গ্রামবাসীকে তাড়িয়ে দিয়েছে।
হামলার পরেই ঘটনাস্থলে ছুটে যান ঘাটভোগ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সাধন অধিকারী। সমকালকে তিনি বলেন, এভাবে মন্দির ও বাড়ি ভাঙচুরের ঘটনা এর আগে কখনও হয়নি।"
২০২০ খ্রিস্টাব্দের নভেম্বর মাসে কুমিল্লার মুরাদনগরের সংখ্যালঘুদের গৃহস্থালি ও উপাসনালয়ে হামলা এবং ভাংচুরের ঘটনা একই ধরণের।এদেশে কিছুদিন পর পর ঘটে যাওয়া আর দশটি হিন্দু পল্লীতে ঘটে যাওয়া ঘটনার পরিণতির মত এই ঘটনাটিও পরিণতি হয়ত একই প্রকারের হবে। সংখ্যালঘু পল্লীতে সংঘবদ্ধ সাম্প্রদায়িক আক্রমণের, ফলশ্রুতিতে বিচারহীনতার সংস্কৃতি এই ঘটনাগুলোকে আরও বেশি পুনরাবৃত্তি করছে এবং উৎসাহিত করছে।হিন্দু সম্প্রদায়ের দেশত্যাগের প্রবণতা কমলে মৌলবাদী গোষ্ঠীর কাছে বিষয়টি অত্যন্ত মাথাব্যথার কারণ হয়। তারা চায় না যে এদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায় মাটি আঁকড়ে ধরে সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে বসবাস করুক। সংখ্যালঘুদের সুখ স্বাচ্ছন্দ্যে মৌলবাদীদের মস্তিষ্কের তারগুলো কিলবিল করে এবং তাদের হাত নিশপিশ করে। তাই তারা সংখ্যালঘুদের দমনে বিভিন্ন সুযোগের অপেক্ষায় বসে থাকে। পরবর্তীতে সুযোগ মত, তাদের তৈরি করা ঘটনার মঞ্চায়নে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উপরে আক্রমণের সুবর্ণ সুযোগ যখন চোখের সামনে আসে, তখন তারা একদণ্ডও অপেক্ষা করে না। শুধু দিনশেষে সেই বহুদিনের সুবর্ণ সুযোগের অপেক্ষায় বলি হয়, দেশের অসহায় সংখ্যালঘু বিশেষ করে হিন্দু জনগোষ্ঠী। যাদের সংখ্যা প্রতি জনগণনায় হ্রাস পেতে পেতে শূণ্যে অভিমুখে ধাবিত হচ্ছে। অথচ এ নিয়ে রাজনৈতিক ক্ষমতাবানদের কারও মধ্যে সামান্য মাথাব্যথা নেই।
তথ্য সহায়তা:
১. Dr. S.P. Chatterjee, The partition of Bengal A Geographical Study With Maps And Diagrams, Geographical Society Of India, Kolkata: Second Edition 2007
২. দৈনিক সমকাল অনলাইন পত্রিকা, ঢাকা
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।