ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

পরমেশ্বর শিবের ভীষণ-সৌম্য, দুটি বিরুদ্ধ ভাবই যুগপৎ বর্তমান ।

পরমেশ্বর শিবের ভীষণ-সৌম্য,   দুটি বিরুদ্ধ ভাবই যুগপৎ বর্তমান  মঙ্গলময় পরমেশ্বর শিবই ধাতারূপে জগতকে ধারণ করে আছেন। তিনিই জীবের ভাগ্য বিধাতা। প্রত্যেকটি জীবের অন্তস্থলে পরমাত্মা রূপে একাধারে তিনিই সকল কর্ম করেন, আবার তিনিই সকল কর্মের দ্রষ্টা পুরুষ। তিনি সত্ত্বগুণ, রজোগুণ এবং তমোগুণ এ তিনগুণের অতীত পরমেশ্বর। তিনি চিন্তার নিরাকার হয়েও বিভিন্ন দেবতারূপে প্রকাশিত হন। সকল জগত তাঁরই ইশারায় চলছে। তিনিই জগতের আদিকারণ। সেই পরমেশ্বর কখনো এক অদ্বিতীয়রূপে, কখনো শতরূপে, কখনো সহস্ররূপে, আবার কখনো শতসহস্র অনন্ত রূপেও প্রকাশিত হয়ে থাকেন। যারা বেদজ্ঞ বেদকে কিছুটা জানেন, তারা জানেন যে - পরমেশ্বর মহাদেবের দুটি মূর্তি। এক ভীষণ ভয়ংকর মূর্তিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তিনি মতো মহাকালরূপে জগত লয় করে। অন্য সৌম্য মূর্তিতে তিনিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি করেন, পালন করেন এবং রক্ষা করেন। তাঁর এ পরস্পরবিরোধী দুই মূর্তি অনন্ত প্রকারের। তিনিই ভীষণ মূর্তিতে অগ্নিরূপে সকল কিছুকেই দগ্ধ করে বিনাশ করে। বরাহ, নৃসিংহাদি বিষ্ণু মূর্তি তারই স্বরূপ। প্রচণ্ড তাপ সম্পন্ন গ্রীষ্মকাল এবং মধ্যাহ্নকালীন সূৰ্য্য তিনিই। আবার তিনিই বিবিধ সৌম্য মূৰ্ত্তিতে তা জল, নক্ষত্র ও চন্দ্র ইত্যাদি নামে অভিহিত। ব্যাকারণাদি সহ বেদাঙ্গশাস্ত্র, বেদ, অষ্টাদশ পুরাণ সহ সকল অধ্যাত্মশাস্ত্রের মধ্যে অত্যন্ত গোপণীয় হলো মহেশ্বর মহাদেবের তত্ত্ব৷ তিনিই সকলই জানেন, কিন্তু কেউ তাঁকে সম্যকরূপে জানতে পারে না। তিনি যদি দয়া করে জীবকে কিছুটা জানান, তবেই জীব সাধনার বলে অত্যন্ত সুকৃতির বলে কিছুটা জানতে পারেন। ধাতা চ স বিধাতা চ বিশ্ব বিশ্বকর্মকৃৎ। সর্বাসাং দেবতানাঞ্চ ধারয়ত্যবপূর্বপূঃ।। সর্বৈর্দেবৈঃ স্তুতাে দেবঃ সৈকধা বহুধা চ সঃ।  শতধা সহস্রধা চৈব ভূয়ঃ শতসহস্রধা।। দ্বে তনু তস্য দেবস্য বেদজ্ঞা ব্রাহ্মণা বিদুঃ। ঘোরা চান্যা শবা চান্যা তে তনূ বহুধা পুনঃ॥ ঘােরা তু যা তনুস্তস্য সােঽগ্নির্বিষ্ণুঃ স ভাস্কর।  সৌম্যা তু পুনরেবাস্য আপাে জ্যোতীংষি চন্দ্রমাঃ।।  বেদাঃ সাঙ্গোপনিষদঃ পুরাণাধ্যাত্মনিশ্চয়াঃ। যদত্র পরমং গুহ্যং স বৈ দেব মহেশ্বরঃ।। (মহাভারত: দ্রোণপর্ব, ১৭০.৮৫-৮৯) "তিনি ধাতা, বিধাতা, সকলের পরমাত্মা ও সমস্তকার্য্যকারী এবং তিনি নিরাকার হয়েও সমস্ত দেবতার আকার ধারণ করেন। সকল দেবতা তাঁর স্তব করেন এবং সেই মহাদেব একরূপ, বহুরূপ, শতরূপ, সহস্ররূপ, আবার শতসহস্ররূপও হয়ে থাকেন।  বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা জানেন যে, সেই মহাদেবের দুটি মূর্তি। একটা ভীষণ এবং অন্যটি সৌম্য। সেই দুই মূর্তি আবার বহুপ্রকারের। তাঁর যে ভীষণ মূর্তি, তা অগ্নি, নৃসিংহাদিরূপ বিষ্ণু এবং গ্রীষ্ম সময়ের মধ্যাহ্নকালীন সূৰ্য্য; আবার যেটা সৌম্য মূৰ্ত্তি তা জল, নক্ষত্র ও চন্দ্র। ব্যাকারণাদি অঙ্গশাস্ত্র ও উপনিষদের সহিত সমস্ত বেদ এবং পুরাণ ও অধ্যাত্মশাস্ত্রের মধ্যে যা অত্যন্ত গোপণীয় তাই মহেশ্বর মহাদেব।" ইশ্বরের ভীষণ সৌম্য এ দুটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখাতেও পাওয়া যায়। তিনি দেশমাতৃকাকে আদ্যাশক্তি মহামায়া রূপে কল্পনা করে, তিনি মাতৃরূপের ভীষণ এবং সৌম্য দুটি রূপেরই কল্পনা করেছেন। আসুরিক ভাবাপন্নদের বিনাশে তিনি খড়গধারিণী এবং সাধু সজ্জনদের কাছে তিনি বর ও অভয় মূদ্রায় শঙ্কাহরণ করেন। ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে,বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ, দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরণ। ওগো মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখি রে! তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে॥ বেদাদি সকল শাস্ত্রেই বিভিন্ন দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। কিন্তু এরপরেও আমরা বিভ্রান্ত হয়ে গিয়ে তাঁকে বহু মনে করি। যখনই আমরা সেই অদ্বিতীয় পরমেশ্বরকে বহু মনে করি, তখনই আমিরা মুক্তির পথ থেকে সরে যেতে থাকি।ঈশ্বরের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। ভাল-মন্দ, পজিটিভ নেগেটিভ সকল শক্তির উৎসই তিনি। ব্যক্তির ইচ্ছার স্বাধীনতা সাত্ত্বিক, রাজসিক এবং তামসিক গুণভেদেই শুভ অশুভের উৎপত্তি। কিন্তু পৃথিবীর অনেক জাতিই বিশ্বাস করে ভালোর জগতের একজন ঈশ্বর; খারাপ জগতের আরেকজন ঈশ্বরের কনসেপ্ট। রেললাইনের মত সমান্তরালভাবে চলছে তাদের দুই ঈশ্বরের শুভ অশুভের রাজত্ব। সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বর এবং পরমেশ্বর একজন প্রতিদ্বন্দ্বী তত্ত্ব উপরে জগতের যে সকল মতবাদ প্রতিষ্ঠিত তারা প্রধানত দুই ঈশ্বর তত্ত্বে বিশ্বাসী। কারণ সৃষ্টিকির্তা পরমেশ্বরের বাইরে কাউকে স্বীকার করলে, তখন একেশ্বরবাদ থাকে না। আমাদের বুঝতে হবে জগতের ভালো মন্দ সকল ভাবই ঈশ্বর থেকে আসা।ভক্তকবি রজনীকান্ত সেনের ভাষায় বলতে হয়: "তুমি, অরূপ সরূপ, সগুণ নির্গুণ, দয়াল ভয়াল, হরি হে; - আমি কিবা বুঝি, আমি কিবা জানি,  আমি কেন ভেবে মরি হে।" ভগবান শিবের সৌম্য এবং ভীষণ এ দুটি বিষয়  নিয়ে বিভিন্ন মাহাত্ম্য  বিবিন্ন পুরাণে বর্ণিত হয়েছে।  ঋষি মার্কণ্ডেয় নিয়ে এমনি একটি অত্যন্ত জনপ্রিয়   উপাখ্যানটি রয়েছে। সে উপাখ্যানে তিনি সৌম্য করুণাঘন রূপে যেমন মহর্ষি  মার্কণ্ডেয়কে রক্ষা করেছেন, তেমনি ভীষণরূপে যমরাজকে শাসন করেছেন।মৃকণ্ডু ঋষি ও তার পত্নী মরুদবতী পুত্রকামনায় শিবের আরাধনা করেন। তাঁদের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান শিব তাদের সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে দর্শন দেন। তিনি মৃকণ্ডু ঋষি ও তার পত্নী মরুদবতীকে জিজ্ঞাসা করেন, তারা কেমন পুত্র চান – দীর্ঘজীবী মূর্খ পুত্র না স্বল্পায়ু মহাজ্ঞানী পুত্র। মৃকণ্ডু ঋষি স্বল্পায়ু মহাজ্ঞানী পুত্রই ভগবান শিবের কাছে প্রার্থনা করলেন। এভাবেই ভগবান শিবের আশীর্বাদে মাত্রা ষোলো বছরের স্বল্পায়ু নিয়ে মহর্ষি মার্কণ্ডেয়ের জন্ম হয়। জন্ম থেকেই তিনি ছিলেন পরম শিবভক্ত। ষোড়শ বছর বয়সে যখন তার মৃত্যুকাল আসন্ন, তখন তিনি লিঙ্গমূর্তি গড়ে শিবের একনিষ্ঠ আরাধনা শুরু করেন। ষোড়শ বছরের স্বল্পায়ু যখন সমাপ্ত হওয়ার পথে, তখন মৃত্যুরূপ যমরাজ তাঁর প্রাণবায়ু হরণ করতে আসে। শিব উপাসনায় তন্ময় হয়ে যাওয়া মহর্ষি মার্কণ্ডেয় লিঙ্গমূর্তিকে আঁকড়ে ধরে থাকে। যমরাজ  মৃত্যুরজ্জু দিয়ে মার্কণ্ডেয়কে বন্ধন করলেও, তাঁর প্রাণবায়ু হরণ করতে পারে না। মহর্ষি মার্কণ্ডেয় শিবলিঙ্গমূর্তিকে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে  শিবের শিবের নাম জপ করতে থাকে। বৈদিক মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র নিবিষ্টমনে জপ করতে থাকেন। ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবিদর্দ্ধনম্। উর্বারুকমিব বন্ধনান্ মৃত্যোর্মুক্ষীয় মামৃতাৎ।। (ঋগ্বেদ সংহিতা:০৭.৫৯.১২) "অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বা জন্ম,জীবন ও মৃত্যু -এ ত্রয়ীদ্রষ্টা রুদ্ররূপ হে পরমেশ্বর, তোমার বন্দনা করি।তুমি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সুন্দর পরিবেশ ও পুষ্টিকর খাদ্যের দাতা।পাকা উর্বারুক ফলের ন্যায় আমরা যেন পূর্ণায়ু পেয়েই মৃত্যুর বন্ধন হতে মুক্ত হতে পারি। তোমার অমৃতরূপ হতে যেন বঞ্চিত না হই।"  ভক্তবৎসল শিব মহাভক্ত মার্কণ্ডেয়কে রক্ষা করতে সেই শিবলিঙ্গমূর্তি থেকে আবির্ভূত হন। ক্রুদ্ধ ভীষণ মূর্তিতে ভগবান শিব যেমনি যমরাজকে শাসন করেন, তেমনি যুগপৎ সৌম্য করুণার দৃষ্টিতে মহর্ষি মার্কণ্ডেয়কে বরাভয় প্রদান করেন। পরমেশ্বর শিবের একইসাথে ভয়ংকর এবং সৌম্য রূপই প্রকাশিত হয়। ভগবান  শিবের বরে মহর্ষি মার্কণ্ডেয় অমরত্ব লাভ করেন এবং ভগবান শিবও মহামৃত্যুঞ্জয় নামে জগতে খ্যাত হন। একই প্রকারের ঘটনা আমরা ভগবান শ্রীবিষ্ণুর নৃসিংহ অবতারের ক্ষেত্রেও দেখতে পাই। ভগবান নৃসিংহদেব রুদ্র, ভীষণ ভয়ংকর মূর্তিতে যেমন হিরণ্যকশিপুকে বধ করেন ; ঠিক তেমনি একই সময়ে সান্ত সৌম্য কল্যাণময় রূপে ভক্ত প্রহ্লাদকে বরাভয় প্রদান করেন। শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।

মঙ্গলময় পরমেশ্বর শিবই ধাতারূপে জগতকে ধারণ করে আছেন। তিনিই জীবের ভাগ্য বিধাতা। প্রত্যেকটি জীবের অন্তস্থলে পরমাত্মা রূপে একাধারে তিনিই সকল কর্ম করেন, আবার তিনিই সকল কর্মের দ্রষ্টা পুরুষ। তিনি সত্ত্বগুণ, রজোগুণ এবং তমোগুণ এ তিনগুণের অতীত পরমেশ্বর। তিনি চিন্তার নিরাকার হয়েও বিভিন্ন দেবতারূপে প্রকাশিত হন। সকল জগত তাঁরই ইশারায় চলছে। তিনিই জগতের আদিকারণ। সেই পরমেশ্বর কখনো এক অদ্বিতীয়রূপে, কখনো শতরূপে, কখনো সহস্ররূপে, আবার কখনো শতসহস্র অনন্ত রূপেও প্রকাশিত হয়ে থাকেন। যারা বেদজ্ঞ বেদকে কিছুটা জানেন, তারা জানেন যে - পরমেশ্বর মহাদেবের দুটি মূর্তি। এক ভীষণ ভয়ংকর মূর্তিতে বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের তিনি মতো মহাকালরূপে জগত লয় করে। অন্য সৌম্য মূর্তিতে তিনিই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের সৃষ্টি করেন, পালন করেন এবং রক্ষা করেন। তাঁর এ পরস্পরবিরোধী দুই মূর্তি অনন্ত প্রকারের। তিনিই ভীষণ মূর্তিতে অগ্নিরূপে সকল কিছুকেই দগ্ধ করে বিনাশ করে। বরাহ, নৃসিংহাদি বিষ্ণু মূর্তি তারই স্বরূপ। প্রচণ্ড তাপ সম্পন্ন গ্রীষ্মকাল এবং মধ্যাহ্নকালীন সূৰ্য্য তিনিই। আবার তিনিই বিবিধ সৌম্য মূৰ্ত্তিতে তা জল, নক্ষত্র ও চন্দ্র ইত্যাদি নামে অভিহিত। ব্যাকারণাদি সহ বেদাঙ্গশাস্ত্র, বেদ, অষ্টাদশ পুরাণ সহ সকল অধ্যাত্মশাস্ত্রের মধ্যে অত্যন্ত গোপণীয় হলো মহেশ্বর মহাদেবের তত্ত্ব৷ তিনিই সকলই জানেন, কিন্তু কেউ তাঁকে সম্যকরূপে জানতে পারে না। তিনি যদি দয়া করে জীবকে কিছুটা জানান, তবেই জীব সাধনার বলে অত্যন্ত সুকৃতির বলে কিছুটা জানতে পারেন।

ধাতা চ স বিধাতা চ বিশ্ব বিশ্বকর্মকৃৎ।
সর্বাসাং দেবতানাঞ্চ ধারয়ত্যবপূর্বপূঃ।।
সর্বৈর্দেবৈঃ স্তুতাে দেবঃ সৈকধা বহুধা চ সঃ।
শতধা সহস্রধা চৈব ভূয়ঃ শতসহস্রধা।।
দ্বে তনু তস্য দেবস্য বেদজ্ঞা ব্রাহ্মণা বিদুঃ।
ঘোরা চান্যা শবা চান্যা তে তনূ বহুধা পুনঃ॥
ঘােরা তু যা তনুস্তস্য সােঽগ্নির্বিষ্ণুঃ স ভাস্কর।
সৌম্যা তু পুনরেবাস্য আপাে জ্যোতীংষি চন্দ্রমাঃ।।
বেদাঃ সাঙ্গোপনিষদঃ পুরাণাধ্যাত্মনিশ্চয়াঃ।
যদত্র পরমং গুহ্যং স বৈ দেব মহেশ্বরঃ।।
(মহাভারত: দ্রোণপর্ব, ১৭০.৮৫-৮৯)
"তিনি ধাতা, বিধাতা, সকলের পরমাত্মা ও সমস্তকার্য্যকারী এবং তিনি নিরাকার হয়েও সমস্ত দেবতার আকার ধারণ করেন।
সকল দেবতা তাঁর স্তব করেন এবং সেই মহাদেব একরূপ, বহুরূপ, শতরূপ, সহস্ররূপ, আবার শতসহস্ররূপও হয়ে থাকেন।
বেদজ্ঞ ব্রাহ্মণেরা জানেন যে, সেই মহাদেবের দুটি মূর্তি। একটা ভীষণ এবং অন্যটি সৌম্য। সেই দুই মূর্তি আবার বহুপ্রকারের।
তাঁর যে ভীষণ মূর্তি, তা অগ্নি, নৃসিংহাদিরূপ বিষ্ণু এবং গ্রীষ্ম সময়ের মধ্যাহ্নকালীন সূৰ্য্য; আবার যেটা সৌম্য মূৰ্ত্তি তা জল, নক্ষত্র ও চন্দ্র।
ব্যাকারণাদি অঙ্গশাস্ত্র ও উপনিষদের সহিত সমস্ত বেদ এবং পুরাণ ও অধ্যাত্মশাস্ত্রের মধ্যে যা অত্যন্ত গোপণীয় তাই মহেশ্বর মহাদেব।"
ইশ্বরের ভীষণ সৌম্য এ দুটি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের লেখাতেও পাওয়া যায়। তিনি দেশমাতৃকাকে আদ্যাশক্তি মহামায়া রূপে কল্পনা করে, তিনি মাতৃরূপের ভীষণ এবং সৌম্য দুটি রূপেরই কল্পনা করেছেন। আসুরিক ভাবাপন্নদের বিনাশে তিনি খড়গধারিণী এবং সাধু সজ্জনদের কাছে তিনি বর ও অভয় মূদ্রায় শঙ্কাহরণ করেন।
ডান হাতে তোর খড়্গ জ্বলে,বাঁ হাত করে শঙ্কাহরণ,
দুই নয়নে স্নেহের হাসি, ললাটনেত্র আগুনবরণ।
ওগো মা, তোমার কী মুরতি আজি দেখি রে!
তোমার দুয়ার আজি খুলে গেছে সোনার মন্দিরে॥
বেদাদি সকল শাস্ত্রেই বিভিন্ন দৃষ্টান্ত দিয়ে বুঝিয়ে দেয়া হয়েছে যে তিনি এক এবং অদ্বিতীয়। কিন্তু এরপরেও আমরা বিভ্রান্ত হয়ে গিয়ে তাঁকে বহু মনে করি। যখনই আমরা সেই অদ্বিতীয় পরমেশ্বরকে বহু মনে করি, তখনই আমিরা মুক্তির পথ থেকে সরে যেতে থাকি।ঈশ্বরের কোন প্রতিদ্বন্দ্বী নেই। ভাল-মন্দ, পজিটিভ নেগেটিভ সকল শক্তির উৎসই তিনি। ব্যক্তির ইচ্ছার স্বাধীনতা সাত্ত্বিক, রাজসিক এবং তামসিক গুণভেদেই শুভ অশুভের উৎপত্তি। কিন্তু পৃথিবীর অনেক জাতিই বিশ্বাস করে ভালোর জগতের একজন ঈশ্বর; খারাপ জগতের আরেকজন ঈশ্বরের কনসেপ্ট। রেললাইনের মত সমান্তরালভাবে চলছে তাদের দুই ঈশ্বরের শুভ অশুভের রাজত্ব। সৃষ্টিকর্তা পরমেশ্বর এবং পরমেশ্বর একজন প্রতিদ্বন্দ্বী তত্ত্ব উপরে জগতের যে সকল মতবাদ প্রতিষ্ঠিত তারা প্রধানত দুই ঈশ্বর তত্ত্বে বিশ্বাসী। কারণ সৃষ্টিকির্তা পরমেশ্বরের বাইরে কাউকে স্বীকার করলে, তখন একেশ্বরবাদ থাকে না। আমাদের বুঝতে হবে জগতের ভালো মন্দ সকল ভাবই ঈশ্বর থেকে আসা।ভক্তকবি রজনীকান্ত সেনের ভাষায় বলতে হয়:
"তুমি, অরূপ সরূপ, সগুণ নির্গুণ,
দয়াল ভয়াল, হরি হে; -
আমি কিবা বুঝি, আমি কিবা জানি,
আমি কেন ভেবে মরি হে।"
ভগবান শিবের সৌম্য এবং ভীষণ এ দুটি বিষয় নিয়ে বিভিন্ন মাহাত্ম্য বিবিন্ন পুরাণে বর্ণিত হয়েছে।
ঋষি মার্কণ্ডেয় নিয়ে এমনি একটি অত্যন্ত জনপ্রিয় উপাখ্যানটি রয়েছে। সে উপাখ্যানে তিনি সৌম্য করুণাঘন রূপে যেমন মহর্ষি মার্কণ্ডেয়কে রক্ষা করেছেন, তেমনি ভীষণরূপে যমরাজকে শাসন করেছেন।মৃকণ্ডু ঋষি ও তার পত্নী মরুদবতী পুত্রকামনায় শিবের আরাধনা করেন। তাঁদের তপস্যায় সন্তুষ্ট হয়ে ভগবান শিব তাদের সম্মুখে আবির্ভূত হয়ে দর্শন দেন। তিনি মৃকণ্ডু ঋষি ও তার পত্নী মরুদবতীকে জিজ্ঞাসা করেন, তারা কেমন পুত্র চান – দীর্ঘজীবী মূর্খ পুত্র না স্বল্পায়ু মহাজ্ঞানী পুত্র। মৃকণ্ডু ঋষি স্বল্পায়ু মহাজ্ঞানী পুত্রই ভগবান শিবের কাছে প্রার্থনা করলেন। এভাবেই ভগবান শিবের আশীর্বাদে মাত্রা ষোলো বছরের স্বল্পায়ু নিয়ে মহর্ষি মার্কণ্ডেয়ের জন্ম হয়। জন্ম থেকেই তিনি ছিলেন পরম শিবভক্ত। ষোড়শ বছর বয়সে যখন তার মৃত্যুকাল আসন্ন, তখন তিনি লিঙ্গমূর্তি গড়ে শিবের একনিষ্ঠ আরাধনা শুরু করেন। ষোড়শ বছরের স্বল্পায়ু যখন সমাপ্ত হওয়ার পথে, তখন মৃত্যুরূপ যমরাজ তাঁর প্রাণবায়ু হরণ করতে আসে। শিব উপাসনায় তন্ময় হয়ে যাওয়া মহর্ষি মার্কণ্ডেয় লিঙ্গমূর্তিকে আঁকড়ে ধরে থাকে। যমরাজ মৃত্যুরজ্জু দিয়ে মার্কণ্ডেয়কে বন্ধন করলেও, তাঁর প্রাণবায়ু হরণ করতে পারে না। মহর্ষি মার্কণ্ডেয় শিবলিঙ্গমূর্তিকে শক্ত হাতে আঁকড়ে ধরে শিবের শিবের নাম জপ করতে থাকে। বৈদিক মহামৃত্যুঞ্জয় মন্ত্র নিবিষ্টমনে জপ করতে থাকেন।
ত্র্যম্বকং যজামহে সুগন্ধিং পুষ্টিবিদর্দ্ধনম্।
উর্বারুকমিব বন্ধনান্ মৃত্যোর্মুক্ষীয় মামৃতাৎ।।
(ঋগ্বেদ সংহিতা:০৭.৫৯.১২)
"অতীত,বর্তমান ও ভবিষ্যৎ বা জন্ম,জীবন ও মৃত্যু -এ ত্রয়ীদ্রষ্টা রুদ্ররূপ হে পরমেশ্বর, তোমার বন্দনা করি।তুমি আমাদের বেঁচে থাকার জন্য সুন্দর পরিবেশ ও পুষ্টিকর খাদ্যের দাতা।পাকা উর্বারুক ফলের ন্যায় আমরা যেন পূর্ণায়ু পেয়েই মৃত্যুর বন্ধন হতে মুক্ত হতে পারি। তোমার অমৃতরূপ হতে যেন বঞ্চিত না হই।"
ভক্তবৎসল শিব মহাভক্ত মার্কণ্ডেয়কে রক্ষা করতে সেই শিবলিঙ্গমূর্তি থেকে আবির্ভূত হন। ক্রুদ্ধ ভীষণ মূর্তিতে ভগবান শিব যেমনি যমরাজকে শাসন করেন, তেমনি যুগপৎ সৌম্য করুণার দৃষ্টিতে মহর্ষি মার্কণ্ডেয়কে বরাভয় প্রদান করেন। পরমেশ্বর শিবের একইসাথে ভয়ংকর এবং সৌম্য রূপই প্রকাশিত হয়। ভগবান শিবের বরে মহর্ষি মার্কণ্ডেয় অমরত্ব লাভ করেন এবং ভগবান শিবও মহামৃত্যুঞ্জয় নামে জগতে খ্যাত হন। একই প্রকারের ঘটনা আমরা ভগবান শ্রীবিষ্ণুর নৃসিংহ অবতারের ক্ষেত্রেও দেখতে পাই। ভগবান নৃসিংহদেব রুদ্র, ভীষণ ভয়ংকর মূর্তিতে যেমন হিরণ্যকশিপুকে বধ করেন ; ঠিক তেমনি একই সময়ে সান্ত সৌম্য কল্যাণময় রূপে ভক্ত প্রহ্লাদকে বরাভয় প্রদান করেন।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁