বাঙালির পরিচয় শুধু ভাষায় নয়, এই ভাষার সাথে সম্পর্কিত সহস্রাধিক বছরের আবহমানকালের সাংস্কৃতির উত্তরাধিকারকেও গ্রহণ করতে হবে।
বাঙালির প্রত্যেকটি উৎসব পার্বণের সাথে আছে এ ভূখণ্ডের মাটি, মানুষের সম্পর্ক। সেই অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ককে অস্বীকার করে বাঙালি হওয়া অসম্ভব। এক্ষেত্রে এ সংস্কৃতির ধারক, বাহক এবং প্রচারক হিসেবে বাঙালি হিন্দুকেই অগ্রণী ভূমিকা কাঁধে নিতে হবে। ভুলে গেলে চলবে না, ঋগ্বেদের ঐতরেয় আরণ্যকে বঙ্গ শব্দের সর্বপ্রাচীন উল্লেখ আছে। অর্থাৎ বৈদিক যুগ থেকেই বঙ্গের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। হয়তো সে সময়ের ভাষা বর্তমান কালের বাংলার মত ছিলো না। ভাষার কাজই স্বেচ্ছা প্রবাহমানতা, সে তার নিজের মর্জি অনুযায়ী প্রবাহিত হয়ে চলে। এ চলতে চলতে বিভিন্ন বাঁকে বাঁকে সে পরিবর্তিত হয়। এই সেদিনের মধ্যযুগের বাংলায় লিখিত বিভিন্ন সাহিত্যিক উপাদান বর্তমান একবিংশ শতাব্দীর অধিকাংশ বাঙালিই বুঝতে পারে না। তেমনি সহস্র বছর পূর্বের চর্যাপদ পড়তে তো রীতিমতো সরল ব্যাখ্যার প্রয়োজন পড়ে। তা না হলে চর্যাপদগুলোর মর্মার্থ অধিকাংশই বুঝতে পারে না।
ইমাঃ প্রজাস্তিস্রো অত্যায়মায়ংস্তানীমানি
বয়াংসি বঙ্গাবগধাশ্চেরপাদাঃ ।
(ঋগ্বেদীয় ঐতরেয় আরণ্যক:২.১.১)
ঋগ্বেদের ঐতরেয় আরণ্যকের এ রেফারেন্সটি খুব একটা মানুষ জানে না। শুধু ইতিহাস চর্চা এবং গবেষণার সাথে যারা আছে, তারাই জানে। তাদের অনেকেই বঙ্গসংস্কৃতি যে বৃহত্তর বৈদিক সংস্কৃতির অঙ্গ; এ সাংস্কৃতিক ঐক্যের প্রাচীন পরম্পরাকে ঢাকতে চান। তাদের অনেকেই বলেন, ঋগ্বেদের উক্ত রেফারেন্সে পাখির ডাকের সাথে বাঙালির ভাষাকে তুলনা করে বাংলা ভাষাকে ছোট করা হয়েছে। যারা এ কথাগুলি বিভিন্ন বইপত্রে লিখেছে, তাদের কাছে আমার একটি ছোট্ট প্রশ্ন। একজন ব্যক্তি যদি ভাল গান করে, তাকে আমরা বাঙালিরা কি বলি? এককথায় সকলেই উত্তরটি জানি, কোকিলকণ্ঠী।যেমন কোকিলকণ্ঠী লতা মুঙ্গেশকর, সন্ধ্যা মুখোপাধ্যায়, আরতি মুখোপাধ্যায়, নুরজাহান বেগম ইত্যাদি। পাখির কলরবের সাথে তুলনা করে যদি সংগীত শিল্পীদের কন্ঠের সুমিষ্টতাকে ইঙ্গিত করা হয়, মহিমান্বিত করা হয়, তবে বাঙালির মুখের বুলিকে পাখির ডাকের সাথে তুলনা করে ঋগ্বেদে কি করে বাঙালির মুখের ভাষাকে ছোট করা হয়েছে, তা আমার বোধগম্য নয়।এখানে ছোট তো করাই হয়নি, বরং বাঙালির ভাষার সুমিষ্ট ধ্বনিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। বাঙালির মুখের সুমিষ্ট বুলিকেই মহিমান্বিত করা হয়েছে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে বাঙালি হিন্দু ইতিহাস থেকে কখনো শিক্ষা নেইনি। সে শিক্ষা-দীক্ষায় অন্যদের থেকে এগিয়ে থাকার পরেও প্রতিনিয়ত হেরে গেছে, শুধুমাত্র কাণ্ডজ্ঞানহীন কর্মকাণ্ডের কারণে। বাঙালি হিন্দু মহানত্ব, সম্প্রীতি, সর্বধর্ম সমন্বয় করতে করতে নিজেরই অস্তিত্ব আজ সংকটে । ইতিহাসের পাতায় পাতায় তাদের জ্ঞানত অজ্ঞানত শুধু ভুলেরই দৃষ্টান্ত। ১৮৩৫ সালে ব্রিটিশরা আমাদের নিজস্ব শিক্ষা ব্যবস্থাকে নিষিদ্ধ করে যখন পাশ্চাত্য ভাষায় এবং পাশ্চাত্য রীতিনীতিতে আমাদের শিক্ষা ব্যাবস্থাকে রূপান্তরিত করে ; তখন থেকেই যে ষড়যন্ত্রের জাল বিছানো হয় সেই জাল আজও ছিন্ন হয়নি। এ ষড়যন্ত্রকারীদের অন্যতম নায়ক হলেন টমাস বেবিংটন মেকলে বা লর্ড মেকলে (১৮০০-১৮৫৯)। তিনি ছিলেন রথলি-র প্রথম ব্যারন, ব্রিটিশ পার্লামেন্ট সদস্য, এডিনবার্গ রিভিউ পত্রিকা নিয়মিত লেখক, ব্যবহারশাস্ত্র বিশারদ, কমিশনার ও বোর্ড অব কন্ট্রোলের সচিব (১৮৩২) এবং ব্রিটিশ মন্ত্রিসভার সদস্য (১৮৩৯-৪১)।তিনি চেয়েছিলেন ভারতের জনসাধারণ শুধু নামেই থাকবে ভারতীয়, কিন্তু তার চাল-চলন, আচার-ব্যাবহার সব কিছুই থাকবে ব্রিটিশের মতো।
ব্রিটিশ হাউজ অব কমন্সে মেকলের বক্তব্য ছিল ভারতের ইতিহাস ঐতিহ্য ও প্রতিষ্ঠানসমূহের বিরুদ্ধে।আইন কমিশনের সভাপতি হিসেবে মেকলে ভারতের ফৌজদারি আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে অবদান রাখেন। কিন্তু পরিতাপের বিষয়, এই আইন প্রণয়ন ও ফৌজদারি আইনের পাশ্চাত্যকরণ সম্পর্কিত সভার কার্যবিবরণীতে তিনি বাঙালি ও অন্যান্য ভারতীয়দের জাতীয় চরিত্র সম্পর্কে বহু অবমাননাকর মন্তব্য করেছেন। বাঙালি সম্পর্কে তিনি বলেন, "বাঙালিরা দৈহিক দিক থেকে ভঙ্গুর ও দুর্বল, নৈতিক দিক থেকে কাপুরুষ। তাঁর মতে, বাঙালিরা অভ্যাসগতভাবে মিথ্যাবাদী, প্রতারক, যোগসাজশকারী ও জালিয়াত। তিনি বাঙালির এই চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের ব্যাখ্যা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলতে চেয়েছেন, শতকের পর শতক সামন্তবাদী স্বৈরতন্ত্রের কবলে থাকার ফলে বাঙালির এ ধরনের চারিত্রিক অবক্ষয় ঘটেছে।"
(সূত্র:বাংলাপিডিয়া)
মেকলে বাঙালিকে নিন্দা করেছেন ঠিকই কিন্তু তিনি যে বলেছেন,শতকের পর শতক সামন্তবাদী স্বৈরতন্ত্রের কবলে থাকার ফলে বাঙালির চারিত্রিক অবক্ষয় ঘটেছে - কথাটি ভাববার বিষয়। হাজার বছরের পরাধীনতা বাঙালি বিশেষ করে হিন্দু বাঙালির মনজগতের অবক্ষয়ের একটি অন্যতম কারণ। একটি পাখিকেও বহুদিন খাঁচায় পুরে রাখার পরে সে আর খাঁচা ভেঙে যেতে চায় না। পরনির্ভরশীলতা তাকে হীনমন্য করে দেয়।
বিস্ময়কর হলেও সত্য যে, এদেশীয়দের নিয়ে যার এত নেতিবাচক মানসিকতা, তার হাতের প্রণীত আধুনিক শিক্ষা ব্যবস্থা এবং ফৌজদারী কার্যবিধির উপরেই আমরা চলছি। ব্রিটিশদের সত্যি অনেক ভবিষ্যদ্দৃষ্টি ছিল বলতে হবে; কারণ তারা যা চেয়েছে আজ তাই হয়েছে। সীমাহীন মিথ্যাচার এবং তথ্যসন্ত্রাস চলছে আমাদের এদেশীয় ইতিহাসকে ঘিরে। আর্য এবং অনার্য একটি ভাষিক শব্দ। যেমন শিষ্ট ও অশিষ্টজন। শ্রীমদ্ভগবদগীতার মধ্যেও এ অর্থে ব্যবহার করা হয়েছে। এ শব্দগুলিতে কোন জাতিবাচকতা না থাকার পরেও ব্রিটিশদের আর্য অনার্যের জাতিতত্ত্ব তোতাপাখির মত আউরে এ ভূখণ্ডের আদিবাসীরা আজ নিজেরাই নিজেদের মধ্যে বিদ্বেষে জড়িয়ে পরছে।এর অভিঘাতে উৎপন্ন হচ্ছে বিদ্বেষ, আত্মকোন্দল এবং পারস্পরিক অবিশ্বাস। আর্য বলতে কোন জাতি বোঝায় না। যদি আর্য শব্দটি দিয়ে কোন আপত্তিকর জাতিবিশেষ বোঝাতো, তবে গৌতম বুদ্ধ তাঁর মতবাদে আর্য শব্দটি ব্যবহার করতেন না। ১৮৫৭ সালে সিপাহি বিদ্রোহের পরে ব্রিটিশরা যখন বুঝতে পারলো, এদেশে থাকা তাদের অসম্ভব তখন তারা এদেশের মূল জনগোষ্ঠীদের বহিরাগত বানিয়ে আর্য তত্ত্বটি তৈরি করলেন। পরবর্তীতে মুসলিম ইতিহাসবিদরাও এ তত্ত্বটি লুফে নেয়।
হাজার হাজার বছরের প্রাচীন সংস্কৃতি বহমান না থাকলে একাত্তুরের অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জন্ম নেয়া বাংলাদেশ রাষ্ট্রটিও তার স্বরূপে থাকবে না।একটা তীরকে ছুড়তে হলে হাতকে একটু পিছনে নিতে হয়, তখন তীরটি গতি পায়। ঠিক একইভাবে প্রত্যেকটি জাতির পেছনের ইতিহাসের ভুল ত্রুটি থেকে যত বেশী শিক্ষা নিয়েছে, সে জাতি তত বেশী গতি পেয়েছে, এগিয়ে গিয়েছে। প্রত্যেক জাতির অন্ততপক্ষে দুইহাজার বছরের পূর্ণ ইতিহাস জানাটা, জাতীয়তাবাদ বিকাশে অত্যাবশকীয়। ইতিহাস এবং আবহমান সংস্কৃতির চর্চাহীন জাতীয়তাবাদ মাকাল ফলের মত অসার, জাতির খুব একটা কাজে লাগে না। সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর 'আমরা' কবিতায় শাশ্বত বাঙালির যে বৈশিষ্ট্য তুলে ধরেছেন, তা সত্যি অতুলনীয়। তিনি গঙ্গা বিধৌত বাঙালির বসবাসরত বাঞ্চিত ভূমিকে বরদাতীর্থ বলে সম্বোধন করেছেন।
"মুক্তবেণীর গঙ্গা যেথায় মুক্তি বিতরে রঙ্গে
আমরা বাঙালী বাস করি সেই তীর্থে- বরদ বঙ্গে;
বাম হাতে যার কমলার ফুল, ডাহিনে মধুর-মালা,
ভালে কাঞ্চন-শৃঙ্গ-মুকুট, কিরণে ভূবন আলো,
কোল ভরা যার কনক ধান্য, বুকভরা যার স্নেহ,
চরণ পদ্ম, অতসী অপরাজিতায় ভূষিত দেহ,
সাগর যাহার বন্দনা রচে শত তরঙ্গ ভঙ্গে,
আমরা বাঙালী বাস করি সেই বাঞ্চিত ভূমি বঙ্গে।"
শাশ্বত বাঙালির এ বৈশিষ্ট্য বিভিন্ন সময়ে বিদেশিদের হাতে ছেদ পরলেও, ঋগ্বেদের কাল থেকে আজও বাঙালি জাতি নিরবচ্ছিন্ন বহমান।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।