বাঙালির একটা বহুল প্রচলিত প্রবাদ রয়েছে, "গরিবের সুন্দরী বৌ সকলের বৌদি"। প্রবাদবাক্যটি শুনতে কেমন কেমন লাগলেও এর মধ্যে একটি নির্মম বাস্তবতা রয়েছে। বাংলা পঞ্জিকাকে নিয়ে গত কয়েকদশকে যেভাবে অহেতুক উদ্ভট টানাহেঁচড়া কাটাছেঁড়া হয়েছে এবং সেই ধারাবাহিকতায় আজও হচ্ছে, তাতে আমাদের সাধারণ মানুষদের শুধু এই প্রবাদবাক্যটিই মনে আসে বারবার। এ ক্ষেত্রে অবশ্য সাধারণ মানুষদের কিছুই করার নেই। তাদের মনে শুধুই কিছু প্রশ্ন চক্রায়মান হয়ে ঘুরে বেড়ায়। কোটিকোটি টাকা খরচ করে ১৪২৭ বছরের আবহমানকালের বাংলা পঞ্জিকাকে কেন এই ঘনঘন পরিবর্তন করা হচ্ছে এর সদুত্তর অধিকাংশের কাছেই নেই।কিসের জন্যে পরিবর্তন করা হচ্ছে এবং কাদের কল্যাণের জন্যে পরিবর্তন করা হচ্ছে এর সদুত্তরও সাধারণ মানুষের কাছে তো নেই, বরং যারা নেতৃত্ব দিয়ে এই পরিবর্তন করছে তাদের কাছেও ঠিক সুনির্দিষ্ট উত্তর নেই। পঞ্জিকা সংস্কার প্রসঙ্গে তাদের বিভিন্ন বক্তব্য এবং বিবৃতি দেখলে বোঝা যায়, তাদের কথাগুলো সুনির্দিষ্ট নয়, কেমন ধোঁয়াটে ধোঁয়াটে আলো-আঁধারি কথাবার্তা।
আবহমান বাংলার পঞ্জিকাকে যারা কাটাছেঁড়া করে অনৈতিক পরিবর্তন করছেন, তাদের কাছে হয়তো এই পরিবর্তনের কোন যৌক্তিক সদুত্তর আছে বা থাকতে পারে।
কিন্তু দেশের সাধারণ বাঙালির কাছে এ বিষয়টি শুধুমাত্র, ক্ষমতার সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের একগুঁয়েমি এবং ক্ষমতার প্রদর্শন ছাড়া আর কিছুই নয়। কিছু ক্ষমতাবান ব্যক্তি অধ্যাপক, গবেষক নাম ধারণ করে সরকারী সুযোগ সুবিধা, বাঙালির বিভাজন এবং নিজেকে ইতিহাসে যুক্ত করার এক তীব্র আকাঙ্খা থেকেই বাংলা বর্ষপঞ্জিতে এ ঘনঘন পরিবর্তন করে চলছে বলা যায় । আপনাদের যদি এতই পরিবর্তনের ইচ্ছা, তবে আপনারা বৈদেশিক গ্রেগরিয়ান পঞ্জিকা বা আরবীয় হিজরি পঞ্জিকাকে তো সামান্য একটু সংস্কারের নামে কাটাছেঁড়া করার প্রচেষ্টা নিয়ে দেখতে পারেন। হিজরি পঞ্জিকা চান্দ্র মাসকে অনুসরণ করায় এ পঞ্জিকাকে ৩৫৪/৩৫৫ দিনে বছর হয়। যা সৌরবছর, ৩৬৫ বা ৩৬৬ দিনে বছরের থেকে ১১ দিন বা ১০ দিনের পার্থক্য। হিজরি পঞ্জিকাতে একই মাস বিভিন্ন ঋতুতে বারেবারে ঘুরে ঘুরে আসে। এ বর্ষপঞ্জির সাথে বাংলা বা ইংরেজি বর্ষপঞ্জির মত সুনির্দিষ্ট কোন ঋতুচক্র নেই।
কবি নজরুলের জন্মদিন সহ আরো অনেক জাতীয় দিনকে নির্দিষ্ট করে দেয়ার জন্যে যদি বাংলা পঞ্জিকা পরিবর্তন করতে হয়, তাবে যারা বাংলা পঞ্জিকা বারেবারে সংস্কার করছেন তাদের উদ্দেশ্যে দুটি কথা বলতে চাই।
বাংলা এবং ইংরেজি বর্ষপঞ্জির দিনের মধ্যে ১ দিনের সামান্য পার্থক্য হয়। কিন্তু হিজরি পঞ্জিকাতে পার্থক্যটা অনেকদিনের, বহুদিনের। বিষয়টি উদাহরণ দিয়ে বললে পরিষ্কার হবে। ধরুন, আজ ১৪ এপ্রিল আমার জন্মদিন তবে হিজরি পঞ্জিকা অনুসারে আগামী বছর আমার জন্মদিন পালিত হবে ১১ দিন পূর্বে, ৩ এপ্রিল। পরের বছর জন্মদিন হবে আরো ১১+১১ =২২ দিন পূর্বে। এরপরের বছর হবে ১১+১১+১১=৩৩ দিন বা একমাস পূর্বে। এমন করে করে একটি মাস, একটি বছরের পর্যন্ত পার্থক্য চলে আসে। হিজরি বর্ষপঞ্জির মাসগুলো এভাবে সারাবছর প্রত্যকটি ঋতুতে ঘুরতে থাকে। ইংরেজি জানুয়ারি মাস মনে হলেই আমাদের মনে হয় প্রচণ্ড শীতের কথা। বাংলা জৈষ্ঠ্যমাস বললেও আমাদের মনজগতে প্রচণ্ড গরমের তীব্রতার একটি ছবি ভেসে উঠে। কিন্তু হিজরি বর্ষপঞ্জির মাসগুলিতে সুনির্দিষ্ট এমন কোন ঋতুচক্রই নেই। তাহলে এই পঞ্জিকাকে সংস্কারে কেন আপনারা উদ্যোগী হচ্ছেন না। প্রথমত এটি বৈদেশিক পঞ্জিকা, দ্বিতীয় কারণ হলো সেই পঞ্জিকা প্রসঙ্গে সংস্কার শব্দটি উচ্চারণ করলেও বিপদ আছে। সংস্কারের হাত বাড়ালে, সেই হাত পুড়ে যাওয়ার ভয় আছে।পক্ষান্তরে অভাগী বাংলামায়ের বুকে যতই কাটাছেঁড়া করা হোক, দিনশেষে সেই বঙ্গজননী সর্বংসহা ক্ষমাসুন্দরী মূর্তি।
আবহমান বাংলার পঞ্জিকাটি সূর্যের দ্বাদশ রাশিতে পরিভ্রমণের সাথে যুক্ত।
তাই পঞ্জিকাটি অত্যন্ত বিজ্ঞানসম্মত। পৃথিবীর চতুর্দিকে দ্বাদশ সংখ্যক নক্ষত্রপুঞ্জ রয়েছে তাদেরই রাশি বলা হয়।এ দ্বাদশ রাশি হলো: মেষ, বৃষ, মিথুন,কর্কট, সিংহ, কন্যা, তুলা, বৃশ্চিক, ধনু, মকর, কুম্ভ এবং মীন।পৃথিবী থেকে যে নক্ষত্ররাশিকে যেমন দেখা যায়, সে অনুসারে তাদের নামকরণ করা হয়েছে। পৃথিবী থেকে যে নক্ষত্ররাশিকে অনেকটা মেষ বা ভেড়ার মত দেখতে মনে হয়, সেই নক্ষত্ররাশিকে ‘মেষরাশি’ বলা হয়।একইভাবে পর্যায়ক্রমে অন্যান্য রাশিগুলোরও নামকরণ করা হয়েছে। এ প্রত্যেকটি রাশি এক-একটি মাস এবং সূর্যের পরিভ্রমণের পথচক্রের সাথে যুক্ত। সূর্য মেষ রাশিতে গমন করলে বৈশাখ মাস হয়। এই ভাবে সূর্যের দ্বাদশ রাশিচক্রে পরিভ্রমণের ফলে দ্বাদশ মাস হয়।পঞ্জিকায় পুরুষোত্তমমাস বা মলমাস নামে আরও একটি অধিক ত্রয়োদশ মাস রয়েছে। চান্দ্র ও সৌর পঞ্জিকার সামঞ্জস্য বিধানের জন্য প্রতি তিনবছর অন্তর অন্তর এ ত্রয়োদশ মাসটির আগমন ঘটে। অর্থাৎ বাংলা পঞ্জিকাটি সম্পূর্ণভাবে প্রাকৃতিক পরিবেশের সাথে যুক্ত, তাই ঘরে বসে কাগজে কলমে এই পঞ্জিকাকে কাটাছেঁড়া করে নববর্ষের দিন ১৪ এপ্রিল নির্দিষ্ট করে দেয়াটা সম্পূর্ণভাবে অনৈতিক, অযৌক্তিক এবং বালখিল্যতাপূর্ণ আচরণ। এই ভূখণ্ডে সংবৎসরকালের হিসাব কোন নতুন বিষয় নয়।বৈদিক যুগ থেকেই প্রচলিত। বৈদিক পরম্পরা থেকেই দিন, পক্ষ, মাস এবং সংবৎসরকালের পরিমাপটি বৃহত্তর ভারতবর্ষের প্রায় সকল পঞ্জিকায় প্রবেশ করেছে। বাংলা পঞ্জিকাও এর ব্যতিক্রম নয়।
সংবৎসরোঽসি পরিবৎসরোঽসীদাবৎসরোঽসী- দ্বৎসরোঽসি বৎসরোঽসি।
উষসস্তে কল্পন্তামহোরাত্রাস্তে কল্পন্তামর্ধমাসাস্তে কল্পস্তাং মাসাস্তে কল্পন্তামৃতবস্তে কল্পন্তাং সংবৎসরস্তে কল্পতাম্।
প্ৰেত্যা এত্যৈ সং চাঞ্চ প্র চ সারয়।
সুপর্ণচিদসি তয়া দেবতয়াঽঙ্গিরস্বদ্ ধ্রুবঃ সীদ৷৷
(শুক্ল যজুর্বেদ সংহিতা:২৭.৪৫)
"হে অগ্নি, তুমি সংবৎসর, পরিবৎসর, ইদাবৎসর, ইদ্বৎসর ও বৎসররূপ। সকাল, দিন-রাত, অর্ধমাস, পক্ষ, মাস, ঋতু ও সংবৎসর প্রভৃতি তোমার অবয়বরূপে যোগ্য হোক। তুমি স্বেচ্ছায় আসা, যাওয়া, সঙ্কোচন ও প্রসারণ কর। তুমি সুপর্ণের মত গৃহীত হও, তুমি বাক্যের সাথে প্রাণের মত স্থির হয়ে থাক।"
যদিও বাংলা পঞ্জিকা সুপ্রাচীনকাল থেকে বৈদিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের উপরে দণ্ডায়মান।
এরপরেও অপ্রয়োজনীয় অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে বাংলা পঞ্জিকা সংশোধনের প্রক্রিয়া দীর্ঘদিন থেকেই চলছে।বাংলাদেশে বাংলা বর্ষপঞ্জি বা পঞ্জিকাকে সংস্কারের দায়িত্বে সর্বদাই নেতৃত্বে ছিলো বাংলা একাডেমি। প্রতিষ্ঠানটি বাংলা বর্ষপঞ্জিকা সংস্কারের জন্য ১৯৬৩ সালে ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে "বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার" নামে একটি কমিটি গঠন করে। এ কমিটির সংস্কারের প্রধান বিষয়গুলো ছিলো সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত দিনের পরিধি মাপের প্রচলিত রীতি পরিবর্তন করে গ্রেগরিয়ান বা খ্রিস্টিয় রীতি অনুসরণ করে রাত ১২টা ১ মিনিট থেকে দিনের সূচনাকাল হিসেবে গণ্য করা। অথচ আমাদের প্রাচীনকাল থেকেই চলে আসছে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে একটি দিন শুরু হওয়ার রীতি । অধিবর্ষে চৈত্রমাসে ৩১ দিনের কথা বলা হয়। তবে এ কমিটির সুপারিশে লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষ গণনার ক্ষেত্রে ছিল প্রচণ্ড জটিলতা। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ সাহিত্যের ব্যক্তি হয়েও, তার থেকে ভিন্ন পরিমণ্ডলের বাংলা পঞ্জিকা সংস্কারের নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, যা এস্ট্রোনমির বিষয়। কিন্তু দীর্ঘদিন ১৯৬৩ সালে পাকিস্তান সরকারের আমলে করা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর নেতৃত্বে "বাংলা পঞ্জিকা সংস্কার" কমিটির সুপারিশ কোন সরকারই কার্যকর করেননি। ১৯৮৭ সালে বাংলাদেশের তৎকালীন স্বৈরশাসক হুসাইন মুহাম্মদ এরশাদের পাকিস্তান সরকারের সময়ে করা সংস্কারকৃত পঞ্জিকা যা এতকাল খাতাবন্দী ছিলো, সেই খাতাবন্দী পঞ্জিকাকে মুক্ত করে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি প্রদান করে। ফলশ্রুতিতে বাংলাদেশে প্রতিবছর পহেলা বৈশাখ ১৪ এপ্রিলে সুনির্দিষ্ট হয়ে যায়। কিন্তু হিন্দু, বৌদ্ধ আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষেরা রাষ্ট্রের চাপিয়ে দেয়া পঞ্জিকাকে অনুসরণ না করে আবহমান পঞ্জিকাকেই অনুসরণ করে চলে। এর ফলে বাঙালির পহেলা বৈশাখ আজ ১৪ এপ্রিল এবং ১৫ এপ্রিলে দুইদিনে অনুষ্ঠিত। শুধু প্রতি তিনবছর পরে অধিবর্ষের কারণে ১৫ এপ্রিল উভয় পঞ্জিকাতেই একই সাথে নববর্ষ অনুষ্ঠিত হয়।পাকিস্তান সরকার চেয়েছিলো বাঙালির ধর্ম এবং সংস্কৃতিকে বিভাজিত করতে। বাঙালি যেন খণ্ডবিখণ্ড থাকে, বিচ্ছিন্ন থাকে। তাদের সেই বাঙালি বিভাজনের স্বপ্নটি বাস্তবায়িত হয় স্বাধীন দেশে ১৯৮৭ সালে।
১৯৯৫ সালের ২৬ জুলাই তৎকালীন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক হারুন-উর-রশিদকে প্রধান করে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। সে কমিটি ড.মুহম্মদ শহীদুল্লাহ কমিটির মূল সুপারিশের নিরিখে সেবছরের ২৯ আগস্ট তাদের ২০টি সুপারিশ পেশ করে। যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল চৈত্র মাসের পরিবর্তে ফাল্গুন মাসকে লিপ ইয়ার বা অধিবর্ষের মাস হিসেবে নির্ধারণ। যা এখন পর্যন্ত অনুসরণ করা হচ্ছে।
আবারও আরেক দফা বর্ষপঞ্জির পরিবর্তন করা হয় ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি। এ জন্য বাংলা একাডেমির পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি এক সভার আয়োজন করে। এ সভায় অধ্যাপক ড. অজয় রায়ের সভাপতিত্বে উপস্থিত ছিলেন বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, অধ্যাপক জামিল চৌধুরী, অধ্যাপক আলী আসগর প্রমুখ।এ পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি বিভিন্ন বিষয় পর্যালোচনা করে ২৪ ফেব্রুয়ারি বাংলা একাডেমির নির্বাহী পরিষদের দ্বিতীয় সভায় পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি বিভিন্ন সুপারিশ প্রদান করে। বাংলা বর্ষপঞ্জির প্রথম ছয় মাস বৈশাখ থেকে আশ্বিন পর্যন্ত ৩১ দিনে গণনা করা হবে। এ ছাড়া কার্তিক থেকে মাঘ এবং চৈত্র মাস ৩০ দিনে গণনা করা হবে। শুধু ফাল্গুন মাস ২৯ দিনে গণনা করা হবে। তবে ইংরেজি বর্ষপঞ্জির অধিবর্ষে ফাল্গুন মাস ২৯ দিনের পরিবর্তে ৩০ দিনে গণনা করা হবে। সংশোধনের ফলে ১৪২৩ বঙ্গাব্দ থেকে প্রতি বছর ২১ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের বাংলা তারিখ হবে ৮ ফাল্গুন; ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসের বাংলা তারিখ ১২ চৈত্র; ৮ মে রবীন্দ্রজয়ন্তী ২৫ বৈশাখ; ২৫ মে নজরুলজয়ন্তী ১১ জ্যৈষ্ঠ এবং ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসের বাংলা তারিখ হবে ১ পৌষ।
১৯৬৩ সালে পাকিস্তান সরকারের সময় থেকে শুরু হয়ে ১৯৮৭, ১৯৯৫, ২০১৬ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারিতে বাংলা পঞ্জিকার বড় ধরণের পরিবর্তন করায় পরেও সন্তুষ্ট নয় এ পঞ্জিকা সংস্কার কমিটি। তারা ২০১৯ সালে এসেও আবার বাংলা পঞ্জিকা পরিবর্তন করার সুপারিশ করে বাংলা একাডেমির উল্লেখিত দায়িত্বপ্রাপ্ত কমিটি। দেশের চৌদ্দশত বছরের পঞ্জিকাকে স্বল্প সময়ে এত ঘনঘন পরিবর্তনে আমাদের মত অধিকাংশ সাধারণ মানুষই হতাশ। তাই ২০১৯ সালের পঞ্জিকা সংস্কারের খোঁজখবর নেয়ার আমি প্রয়োজন বোধ করিনি। যারা পরিবর্তন করছে তাদের মাথায় রাখা উচিত বাঙালি মানেই শুধুমাত্র বাংলাদেশের বাঙালি না। আমাদের এমন কিছুই করা যাবে না যাতে সারা পৃথিবীর বাঙালিদের সাথে আমাদের যোগসূত্রটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। বাংলাদেশ ছাড়াও, ভারতের পশ্চিম বঙ্গ, ত্রিপুরা এ দুটি প্রদেশে বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ। আসাম, ঝাড়খণ্ডে দ্বিতীয় বৃহত্তম সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি। এর বাইরে ভারতের অন্যান্য প্রদেশ সহ লন্ডন, নিউইয়র্কে কোটি কোটি বাঙালি আছে। আমরা বাংলা পঞ্জিকাকে যাই পরিবর্তন করি তা ভৌগোলিকভাবে অবস্থিত সকলস্থানের বাঙালিকে যুক্ত করেই তবে করতে হবে। নচেৎ এটা হবে, "গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল"- এ বাক্যটির মত বৃথা প্রয়াস।
আজ বাঙালির দুই নয়নমণি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এবং কাজী নজরুল ইসলাম বছরে দুইবার জন্মগ্রহণ করছে। দুইবাংলায় দুইদিন তাঁদের জন্মজয়ন্তী পালিত হচ্ছে। আজ দুইবাংলায় জোড়ায় জোড়ায় দুইদিনে চৈত্রসংক্রান্তি পালিত হচ্ছে, জোড়ায় জোড়ায় নববর্ষ পালিত হচ্ছে, জোড়ায় জোড়ায় পৌষপার্বণ পালিত হচ্ছে, জোড়ায় জোড়ায় বসন্তোৎসব পালিত হচ্ছে, জোড়ায় জোড়ায় পরপর দুইদিনে বাঙালির সকল সার্বজনীন উৎসব পালিত হচ্ছে।বাঙালির জীবনে এর থেকে লজ্জার আর কি হতে পারে? এ লজ্জা থেকে পরিত্রাণ যদি আমরা চাই, তবে সকল বাঙালিকে ঐক্যবদ্ধভাবে বিজ্ঞানসম্মতভাবে পঞ্জিকা সংস্কার করতে হবে। না হয় হাজার বছরের পুরনো চলমান পঞ্জিকাতে ফেরত যেতে হবে। নচেৎ হিন্দুর পঞ্জিকা-মুসলিমের পঞ্জিকা অথবা এপার বাংলার পঞ্জিকা-ওপার বাংলার পঞ্জিকা ইত্যাদি বিভিন্ন নামে এবং রূপে সমান্তরাল তুষের আগুন চলতেই থাকবে, জ্বলতেই থাকবে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৭ সালে ইমনকল্যাণ রাগে বৈশাখ আহ্বান করে বলেছেন, সকল মুমূর্ষুরে উড়িয়ে দিয়ে, সকল আবর্জনাকে বিদূরিত করে, সকল গ্লানি, সকল জরাকে ঘুচিয়ে দিয়ে পৃথিবীকে অগ্নিস্নানে শুদ্ধ করে হে বৈশাখ তুমি আমাদের মাঝে আগমন কর।
"এসো, এসো, এসো হে বৈশাখ।
তাপসনিশ্বাসবায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে,
বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক॥
যাক পুরাতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি,
অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক॥
মুছে যাক গ্লানি, ঘুচে যাক জরা,
অগ্নিস্নানে শুচি হোক ধরা।"
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের এ গানের মত আমরাও চাই পহেলা বৈশাখ যেন বাঙালির পঞ্জিকা বিভাজন সব সকল প্রকার বিভাজনকে অপসৃত করে আমাদের মাঝে আগমন করে। নববর্ষে হোক নব সুচিন্তার অরুণোদয়। বিদূরিত হোক সকল বিভেদ, বিভাজন এবং সংকীর্ণতা।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।