ধর্মানুসারে প্রত্যেকটি জীবের মধ্যে যেমন ব্রহ্ম আছে, তেমনি প্রত্যেকটি জীব পরিশেষে ব্রহ্মময় হয়েই জন্মজন্মান্তরের আবর্ত থেকে মুক্তি লাভ করবে। আমাদের সাত্ত্বিক কর্ম এবং কর্মপ্রচেষ্টাই আমাদের মুক্তির কাছাকাছি নিয়ে যায়। আমাদের প্রত্যেকের মাঝেই সেই অচিন্ত্যপ্রাণেশ লীলাভরে লীলা করেন।যেহেতু ত্রিগুণ দ্বারা আমরা সবাই আচ্ছন্ন তাই আমরা চাই বা না চাই পাপ আমাদের মোহাচ্ছন্নতা তৈরি করে মুগ্ধ করে। আমরা তখন জলের মধ্যে বাস করেও তৃষ্ণাতুর হয়ে যাই। জল তৃষ্ণায় আমাদের বুক ফেটে যায়। অজ্ঞানতা আমাদের বুদ্ধি লোপ করে দেয়। আকাশে হঠাৎ মেঘ করলে যেমন সূর্য ঢাকা পরে যায়, আবার মেঘ সরে গেলে সূর্য জ্বলজ্বল করে ওঠে। আমরা আমাদের অজ্ঞানতাবসত অনেক সময় না বুঝেশুনেই ঈশ্বরের বা দৈবশক্তির বিরুদ্ধাচরণ করে ফেলি।কিন্তু পরে যখন অনুতাপ নিয়ে প্রায়শ্চিত্ত বোধ নিয়ে ঈশ্বরের অহেতুকী স্মরণ নেই তখনই ধীরেধীরে আমাদের হৃদয়ের অজ্ঞান নাশ হতে হতে ব্রহ্মজ্ঞানের, ব্রহ্মপ্রেমের উদয় হয়। এ প্রসঙ্গে বেদে একটি অসাধারণ সূক্ত রয়েছে:
যদেমি প্রস্ফুরেন্নিব দৃতির্ন ধ্মাতো অদ্রিবঃ।
মৃড়া সুক্ষত্র মৃলয়॥
ক্রত্বঃ সমহ দীনতা প্রতীপং জগমা শুচে।
মৃড়া সুক্ষত্র মৃলয়॥
আপাং মধ্যে তস্থিবাংসং তৃষ্ণাবিদব্জরিতারম্।
মুলা সুক্ষত্র মৃলয়।।
যৎকিং চেদং বরুণ দৈব্যে জনঃ
অভিদ্রোহং মনুষ্যাশ্চরামসি।
অচিত্তী যত্তব ধর্মা যুরোপিম
মা নস্তস্মাদেনসো দেব রীরিযঃ।।
( ঋগ্বেদ সংহিতা : ৭. ৮৯. ২-৫)
" হে আয়ুধবান বরুণদেব! আমি কম্পমান বায়ুচালিত মেঘের ন্যায় ভেসে যাচ্ছি; হে সুক্ষত্র বরুণদেব, দয়া কর, দয়া কর।
হে নির্মল বরুণদেব! আমি দিকভ্রান্ত হয়ে অসৎ পথে চলে আজ দীনতাপ্রাপ্ত; হে সুক্ষত্র বরুণদেব, দয়া কর, দয়া কর।
অনন্ত জলের মধ্যে বাস করেও তৃষ্ণার্ত আমি। হে সুক্ষত্র বরুণদেব, দয়া কর, দয়া কর।
আমরা সাধারণ মনুষ্য, দেবগণের সম্বন্ধে আমরা যা কিছু বিরুদ্ধাচরণ করেছি অজ্ঞানতাবশত, সে সকল পাপ থেকে আমাদের মুক্ত করে দাও ; হে দেব তোমার বাৎসল্য প্রেম থেকে যেন আমরা বঞ্চিত না হই।"
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ঋগ্বেদ সংহিতার বরুণসূক্তটির কাব্যিক অনুবাদ করেন। ১৯০৯ খ্রিস্টাব্দে এ বরুণসূক্তটির তিনটি মন্ত্রের (২-৪) ভাবার্থকে অবলম্বন করে কীর্তন রাগে কবি লিখলেন একটি বিখ্যাত ব্রহ্মসংগীত:
"যদি ঝড়ের মেঘের মতো আমি ধাই চঞ্চল-অন্তর
তবে দয়া কোরো হে, দয়া কোরো হে, দয়া কোরো হে ঈশ্বর ॥
ওহে অপাপপুরুষ, দীনহীন আমি এসেছি পাপের কূলে-
প্রভু, দয়া কোরো হে, দয়া কোরো হে, দয়া করে লও তুলে
আমি জলের মাঝারে বাস করি, তবু তৃষায় শুকায়ে মরি-
প্রভু, দয়া কোরো হে, দয়া করে দাও সুধায় হৃদয় ভরি॥"
অধিকারীর মধ্যে অন্যতম হল প্রায়শ্চিত্ত। অর্থাৎ নিজের পাপকর্মকে স্মরণ করে কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত হওয়া। এই অনুতপ্ত বোধই অনেক বড় বড় চোর, ডাকাত, সন্ত্রাসীকে সাধুসন্তে রূপান্তরিত করেছে। রামায়ণের রত্নাকর দস্যুর কাহিনী আমরা সকলেই জানি। এই রত্নাকর দস্যুই নিজের পাপবোধের উপলব্ধি থেকে মহর্ষি বাল্মীকিকে পরিণত হয়ে রামায়ণ লিখেছিলেন। অথর্ববেদেও নিজের পূর্ববর্তী পাপকর্মকে স্মরণ করে কৃতকর্মের জন্যে অনুতপ্ত হয়ে, পুনরায় নিজেকে শুদ্ধ করে নেয়ার তীব্র আকুতি পাওয়া যায়। দেবগণের কাছে নিজেকে সমর্পণ করে দেয়া হয়েছে। তাঁদের কাছে শোধন করে পবিত্র করতে দিতে প্রার্থনা জানানো হয়েছে।
পুনন্তু মা দেবজনাঃ পুনন্তু মনবাে ধিয়া।
পুনন্তু বিশ্বা ভূতানি পবমানঃ পুনাতু মা॥
পবমানঃ পুনাতু মা ক্ৰত্বে দক্ষায় জীবসে।
অথাে অরিষ্টতাতয়ে॥
(অথর্ববেদ সংহিতা: ৬.২.৫.১-২)
"দেবগণ আমাকে শোধন করে পবিত্র করুক। মানবজাতি বৃদ্ধি এবং কর্মের দ্বারা আমাকে শোধন করে পবিত্র করুক। প্রাণী মাত্রই আমাকে শোধন করে পবিত্র করুক। অন্তরিক্ষে সঞ্চরণশীল পবমান বায়ু আমাকে শোধন করে পবিত্র করুক।
অন্তরিক্ষে সঞ্চরণশীল পবমান বায়ু কর্ম, বল, জীবন ও অহিংসক কাজের জন্য আমাকে পাপ মুক্ত করে পবিত্র করুক।"
মা ন একস্মিন্নাগসি মা দ্বয়োরুত ত্রিষু।
বধীর্মা শুর ভূরিষু।।
(ঋগ্বেদ সংহিতা: ৮.৪৫.৩৪)
"হে ইন্দ্র এক অপরাধে আমাদের বধ করো না, দুই, তিন এবং বহু অপরাধেও আমাদের বধ করো না।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।