ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

"আচারলক্ষণো ধর্মঃ"; মহাভারতের সদাচার বিধি।


"আচারলক্ষণো ধর্মঃ";  মহাভারতের সদাচার বিধি।

যে সংস্কৃতি যত বেশী দৃশ্যমান তাকে গ্রাস করা ততই কঠিন। সংস্কৃতির শুধু বায়বীয় উপাদানকেই অন্য সংস্কৃতি গ্রাস করতে পারে, দৃশ্যমান উপাদান নয়।সনাতন ধর্মের শক্তি তার সংস্কৃতিতে।এ সংস্কৃতির অনেকটাই সদাচারের উপরে প্রতিষ্ঠিত। আমরা আধুনিকতার নামে, বুঝে অথবা না বুঝে সদাচারগুলো ব্যক্তিজীবন এবং পারিবারিক জীবন থেকে দিনেদিনে ছিন্ন করে ফেলছি ; পরিনামে ডেকে আনছি আমাদের জন্যে ভয়াবহ বিপদ। প্রতিদিনই বিভিন্ন দৈবদুর্বিপাক ঘটছে, কিন্তু হয়ত টেরই পাচ্ছি না কেন এই অনাকাঙ্ক্ষিত দৈবদুর্বিপাকগুলো আমাদের জীবনে ঘটছে। তবে বর্তমান করোনাকালে আমরা হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি, সদাচারের প্রয়োজনীতা। বেশীদূর যেতে হবে না, আজ থেকে এক শতাব্দী যদি পিছিয়ে যাই, তখন ভ্যাকসিন বা অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কার হয়নি, তখন অধিকাংশ মহামারীতে মৃত্যুর কারণ ছিল বিভিন্ন প্রকারের জীবাণুর সংক্রমণ। এর রোধকল্পে পালন করা হত বিভিন্ন ধর্মীয় সদাচার বিধি; এতে মানুষ, পরিবার, সমাজ, রাষ্ট্র বেঁচে যেত। অত্যন্ত যৌক্তিক এ বিধিগুলো বৈদিক যুগ থেকে আজও আমাদের মাঝে প্রচলিত। আমরা না বুঝে আপাতদৃষ্টিতে অনেক সময়েই এ সদাচারবিধিকে হঠাৎ ভুল বুঝে ফেলি। কিন্তু অনেকেই আমরা জানি না এ সদাচারের পিছনে রয়েছে এক সুদৃঢ় অসম্ভব রকমের বিজ্ঞানভিত্তিক অনুশীলন।
প্রত্যেক হিন্দু পরিবার শাস্ত্র, সদাচারবিধি ও ধর্মের অনুশাসন মেনে প্রতিদিন ব্যক্তিগত ও সমবেতভাবে ভগবানের উপাসনা করা প্রয়োজন। সদাচারে আদর্শ জীবন যাপন করে প্রত্যেককেই মনে প্রাণে, আচরণে ব্যবহারে, আহারে, বিহারে,পোশাকে পরিচ্ছদে, বাক্যলাপে ও চিন্তা ভাবনা প্রভৃতিতে এক পরিশুদ্ধ মানুষ হতে হবে। তবেই আমাদের ভেতরের আত্মশক্তি জাগবে। তাই আজও অত্যন্ত প্রাসঙ্গিক আমাদের শাস্ত্রের বিশেষ করে মহাভারতের সদাচারবিধি।সদাচার এবং সংস্কার মানুষ পরিবার থেকেই শেখে। যখন ছোট্ট বয়সে এ সংস্কারগুলো শেখানো হয়, তখন হয়ত আমরা বুঝতে পারি না। যিনি এগুলো শেখান, তার উপরে আমরা বিরক্ত হই, রেগে যাই। কিন্তু আজ গভীরে একটু চিন্তা করলে দেখা যায়, সেদিনের সেই অনিচ্ছায় আয়ত্ত করা সংস্কারগুলো কতটা প্রয়োজনীয় আজ আমাদের জীবনে। সদাচার সংস্কার নিয়ে আমাদের বিভিন্ন শাস্ত্রগ্রন্থাদিতে অসংখ্য নির্দেশনা দেয়া আছে। এরমধ্যে মহাভারতের অনুশাসন পর্বের দানধর্মের অন্তর্ভুক্ত 'আয়ুষ্যাখ্যান' নামক একানব্বই তম অধ্যায়টি অত্যন্ত মাহাত্ম্যপূর্ণ। অধ্যায়টিতে সদাচারে দীর্ঘায়ু এবং কদাচারে অল্পায়ু বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে। খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং বর্তমান সময়ের জন্যেও সমান প্রাসঙ্গিক। সেখানে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরকে সদাচার বিধিনিষেধ বলছেন পিতামহ ভীষ্ম। পিতামহ ভীষ্মকে ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বললেন:
শতায়ুরুক্তঃ পুরুষঃ শতবীৰ্য্যশ্চ জায়তে ৷
কস্মান্ ম্রিয়ন্তে পুরুষা বালা অপি পিতামহ।।
আয়ুষ্মান্ কেন ভবতি অল্পায়ুৰ্বাপি মানবঃ ।
কেন বা লভতে কীৰ্ত্তিং কেন বা লভতে শ্রিয়ম্।।
তপসা ব্রহ্মচর্য্যেণ জপহোমৈস্তথৌষধৈঃ।
কৰ্ম্মণা মনসা বাচা তন্মে ব্রূহি পিতামহ ॥
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৯১.১-৩)
"হে পিতামহ, মানুষ শতায়ু এবং মহাবলপরাক্রান্ত হয়ে জন্মগ্রহণ করেও কেন অকালে মৃত্যুবরণ করে? মানুষ দীর্ঘায়ু কেন হয়? অল্পায়ুই বা কেন হয়? কোন ফলে কীর্তিমান হয়? কিভাবে মানুষের জীবন সমৃদ্ধ এবং শ্রীযুক্ত হয়? পিতামহ! তপস্যা, ব্রহ্মচর্য, জপ, হোম, ও ঔষধ সেবন কিংবা কর্ম, মন ও বাক্যদ্বারা ঐসকল হয়, তা সকলই আপনি আমার নিকটে বলুন।"
যুধিষ্ঠিরের এ যৌক্তিক প্রশ্নে পিতামহ ভীষ্ম তখন সদাচার সম্পর্কে বিস্তারিত বলতে শুরু করেন।
যেন বা লভতে কীৰ্ত্তিং যেন বা লভতে শ্রিয়ম্ ।
যথা বৰ্ত্তযন্ পুরুষঃ শ্রেয়সা সম্প্ৰযুজ্যতে ॥
আচারাল্লভতে হ্যাযুরাচারাল্লভতে শ্রিয়ম্ ।
আচারাৎ কীর্তিং লভতে পুরুষঃ প্রেত্য চেহ চ।।
দুরাচারো হি পুরুষো নেহাযুর্বিন্দতে মহৎ।
যম্মাত্রসন্তি ভূতানি তথা পরিভবন্তি চ ॥
তস্মাৎ কুর্য্যাদিহাচারং যদীচ্ছেদ্ভূতিমাত্মনঃ।
অপি পাপশরীরস্য আচারে হন্ত্যলক্ষণম্।।
আচারলক্ষণো ধর্মঃ সন্তশ্চাবিত্রলক্ষণাঃ।
সাধুনাঞ্চ যথার্বৃত্তমেতদাচারলক্ষণম্।।
অপ্যদৃষ্টং শ্রবাদেব পুরুষং ধর্ম্মচারিণম্ ৷
ভূতিকৰ্ম্মাণি কুর্ব্বাণং তং জনাঃ কুৰ্বতে প্ৰিয়ম্।।
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৯১.৫-১০)
"যে কর্মের ফলে মানুষ কীর্ত্তি লাভ করে, সম্পদ লাভ করে এবং জীবন মঙ্গলময় পথে পরিচালিত হয়, তা বলছি।
মানুষ আচারের গুণে আয়ু লাভ করে, আচারের ফলে সম্পদ প্রাপ্ত হয় এবংএবং আচারবশতই ইহলোকে ও পবলোকে কীৰ্ত্তি লাভ করর থাকে।
দুরাচার মানুষ ইহলোকে দীর্ঘায়ু লাভ করে না; যেহেতু প্রাণিগণ দুরাচারী ব্যক্তি হতে ভীত হয় এবং তাকে নিন্দা করে, সেই হেতু মানুষ যদি নিজের সম্পদ ইচ্ছা করে, তা হলে, এই জগতে সদাচার করবে৷ কোন ব্যক্তির দেহ অপবিত্র হয়ে গেলেও, সে যদি নিয়মিতভাবে শাস্ত্রোক্ত সদাচারের আচরণ করে, তবে তার অপবিত্র দেহের অপবিত্রতা ধীরেধীরে ক্ষয় হয়।
সদাচারই ধর্ম্মের স্বরূপ এবং সচ্চবিত্রই সজ্জনের লক্ষণ। সাধুগণের যে ব্যবহার, তাই সদাচারের লক্ষণ।
মানুষ ধর্মাচরণ করতে থাকলে এবং সম্পদের কার্য চিরদিন করলে, না দেখে দূর হতে বৃত্তান্ত শুনেই তাকে প্রিয় বলে মনে করে।"
ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির বলেন, মানুষ দীর্ঘায়ু, অল্পায়ু, ধনবান, যশস্বী কেবলমাত্র সদাচার গুণেই হয়। দুরাচারী ব্যক্তিরা কখনই দীর্ঘায়ু হতে পারে না। যদি কেউ নিজের মঙ্গল চায়, তবে তাকে অবশ্যই সদচারী হতে হবে। সাধুদের আচারকেই সদাচার বলে। মানুষ সুলক্ষণবিহীন হয়েও, কেবল সদাচার সম্পন্ন, শ্রদ্ধাশীল, ঈর্ষাপরিশূণ্য, সত্যবাদী, ক্রোধবিহীন ও সরলস্বভাব হয়ে শতবছর জীবিত থাকতে পারে।
যে নাস্তিকা নিষ্ক্রিয়াশ্চ গুরুশাস্ত্রাভিলঙ্ঘিনঃ।
অধর্ম্মজ্ঞা দুরাচারাস্তে ভবন্তি গতায়ুষঃ।।
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৯১.১১)
"যারা ঈশ্বরে অবিশ্বাসী নাস্তিক, সৎকার্যশূন্য, গুরুবাক্য এবং শাস্ত্রবাক্য লঙ্ঘন করে; সেই অধর্মজ্ঞ ও দুরাচারসম্পন্ন ব্যক্তিরা অল্পায়ু হয়।" ঈশ্বর এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ডের স্রষ্টা। জগতের সকল জীব তাঁরই সৃষ্টি। ঈশ্বরের সৃষ্ট হয়ে, সেই ঈশ্বরকেই অবিশ্বাস করাকে শাস্ত্রে মহাপাপ বলে অবিহিত হয়েছে। সেই ঈশ্বরে অবিশ্বাসীদের শাস্ত্রে নাস্তিক বলে। এই নাস্তিকেরা এবং যারা মানুষের কল্যাণে কাজ করে না তারা অল্পায়ু হয়। সদগুরু সর্বদা আত্মপ্রচার বিমুখ। তারা সর্বপ্রকারের আত্মপ্রচারকে পরিত্যাগ করে বেদ এবং বেদান্ত শাস্ত্রবাক্যকে নিজেরা অনুসরণ করেন এবং শিষ্যদেরও সেই পথে চলতে প্রোৎসাহিত করেন। তাই বেদের শরণ নেয়া সদগুরু এবং বেদবাক্যের লঙ্ঘনকারীরা অল্পায়ু হয়।
বিশীলা ভিন্নমৰ্য্যাদা নিত্যং সঙ্কীর্ণ মৈথুনাঃ।
অল্পায়ুষো ভবন্তীহ নরা নিরয়গামিনঃ ॥
সৰ্বলক্ষণহীনোঽপি সমুদাচারবান্ নরঃ ।
শ্রদ্দধানোঽনসূযশ্চ শতং বর্ষাণি জীবতি ॥
অক্রোধনঃ সত্যবাদী ভূতানামবিহিংসকঃ ।
অনসূয়ুরজিহ্মশ্চ শতং বৰ্ষাণি জীবতি।।
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৯১.১২-১৪)
"কুৎসিত স্বভাব, মাননীয় লোকের অপমানকারী, অনিয়ত সময়ে মৈথুনকারী মানুষেরা অল্পায়ু এবং নরকগামী হয়। মানুষ বিদ্যাপ্রভৃতি সর্বগুণশুণ্য হয়েও, যদি শুধু সদাচারযুক্ত, ধর্মবিশ্বাসী ও অসূয়াশূন্য হয় ; তবে সেই মানুষ শতবছর বেঁচে থাকে। ক্রোধবিহীন, সত্যবাদী, প্রাণীগণের অহিংসক, অসূয়াশূন্য ও সহজ সরল স্বভাবের মানুষ শতবছর জীবিত থাকে।"
মানুষের জীবনে স্বভাব বা আচরণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বলা হয়ে থাকে, স্বভাবেই জয় এবং স্বভাবেই ক্ষয়। তাই কুৎসিত কুটিক এবং জটিল স্বভাব যতটা সম্ভব পরিবর্তন করা উচিত। কোন মাননীয় এবং সম্মানিত ব্যক্তির ক্ষতি করতে নেই। তবে যারা করে তারাই দৈবী বিপদে পরে যায়। অন্যকে বিপদে ফেলতে কেউ যখন কোন কুয়া খনন করে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, সেই কুয়ায় সেই দুষ্ট ব্যক্তিই ভয়ংকরভাবে পতিত হয়। তখন তার কুয়া থেকে উদ্ধারেরও ক্ষমতা থাকে না। মানুষের জীবনে কাম জীবনের একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ। কিন্তু একথা মনে রাখা প্রয়োজন যে, জীবনটা শুধুই কামসর্বস্ব নয়। শাস্ত্রে মৈথুন সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে বলে দেওয়া আছে। এই কাম এবং মৈথুন সম্পর্কে 'কামসূত্র' নামে স্বতন্ত্র একটি শাস্ত্রই রয়েছে। তাই যখন তখন মৈথুন করা উচিত নয়, এতে আয়ুক্ষয় হয়।
লোষ্টমর্দ্দী তৃণচ্ছেদী নখখাদী চ যো নরঃ ।
নিত্যোচ্ছিষ্টঃ সঙ্কুসুকো নেহায়ুৰ্বিন্দতে মহৎ ॥
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৯১.১৫)
"যে ব্যক্তি অনর্থক লোষ্ট্রমর্দন, তৃণচ্ছেদন ও দন্তদ্বারা নখচ্ছেদন করে এবং যে সর্বদা পরের উচ্ছিষ্ট অশুচি অন্ন খায় এবং যে সর্বদা চঞ্চল স্বভাবের, সে মানুষ কখনই দীর্ঘজীবী হতে পারে না।"
অনর্থক শক্ত মাটি-ইট-পাথর দলন পেষণ, পীড়ন এবং পিষ্টকরণ করা ; তৃণছেদন করা একটি অস্বাভাবিক আচরণ। চঞ্চল মানসিকতার পরিচায়ক এমন অনেক মানুষ আমাদের আশেপাশে প্রতিনিয়ত দেখি, যারা অকারণে এমন আচরণ করে থাকে এবং অকারণে গাছের ডালপালা ছেদন করে থাকে। মেডিকেল স্বাস্থ্যবিধি বলে,হাতের নখ সবসময় পরিষ্কার থাকে না ;তাই দাঁত দ্বারা হাতের নখ কখনই কাটা উচিত নয়। অন্যের উচ্ছিষ্ট কখনই খাওয়া উচিত নয়। এতে একজনের মুখের লালা থেকে অন্যের মাঝে রোগজীবাণু সংক্রমিত হয়।
ব্রাহ্মে মুহূর্ত্তে বুধ্যেত ধৰ্ম্মার্থৌ চানুচিন্তয়েৎ।
উত্থায়াচম্য তিষ্ঠেত পূর্বাং সন্ধ্যাং কৃতাঞ্জলিঃ।।
এবমেবাপরাং সন্ধ্যাং সমুপাসীত বাগ্ যতঃ ॥
নেক্ষেতাদিত্যমুদ্যন্তং নাস্তং যান্তং কদাচন।
নোপসৃষ্টং ন বারিস্থং ন মধ্যং নভসো গতম্ ॥
ঋষয়ো নিত্যসন্ধ্যত্বাদ্দীর্ঘমা যুরবাপ্নুবন্ ।
তস্মাৎ তিষ্ঠেৎ সদা পূর্বাং পশ্চিমাং চৈব বাগ্ যতঃ।।
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৯১.১৬-১৮)
" ব্রাহ্মমূহুর্তে ঘুম থেকে জাগরিত হতে হবে। এরপরে ধর্ম অর্থের চিন্তা। সকালে ঘুম থেকে উঠে প্রথমেই কৃতাঞ্জলি ও সংযতবাক্য হয়ে প্রাতঃসন্ধ্যা করতে হবে। এইভাবে শ্রদ্ধার সাথে মধ্যাহ্নসন্ধ্যা ও সায়ংসন্ধ্যার অনুষ্ঠান করতে হবে। কখনো সূর্যের উদয়কালীন সময়ে, সূর্যের অস্তকালীন সময়ে, সূর্য যখন রাহুগ্রস্ত হয়ে ঢেকে যায় সেই গ্রহণের সময়ে, জলমধ্যে এবং সূর্য যখন মধ্যগগণে থাকে সেই সময়ে সূর্যের দিকে তাকিয়ে থাকা অনুচিত। ঋষিগণ প্রত্যহ সন্ধ্যোপাসনা করে দীর্ঘায়ুলাভ করেছেন। অতএব বাক্যকে সংযত করে প্রাতঃকালের সন্ধ্যোপসনার সাথে অন্যদুটি সন্ধ্যাও করতে হবে।"
সূর্যগ্রহণে সূর্য থেকে অনেক ক্ষতিকর রশ্মি ছড়িয়ে পরে এবং সূর্য যখন মধ্যগগনে থাকে তখন সূর্যের প্রচণ্ড তাপ থাকে; তাই সে সময়ে খালি চোখে সূর্যকে নিরীক্ষণ করলে চোখ ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।সনাতন ধর্মে সন্ধ্যা উপয়াসনা বা সন্ধ্যাকালে গায়ত্রী জপ অত্যন্ত গুরুত্ববহ। বাককে সংযত করে গায়ত্রী জপ করা প্রত্যেকের কর্তব্য। শ্রীমদ্ভাগবতের দশম স্কন্দের ৭০তম অধ্যায়ে দেখা যায় ভগবান শ্রীকৃষ্ণ বেদমাতা গায়ত্রী মহামন্ত্রের মাধ্যমে উপাসনা সন্ধ্যা করতেন। তিনি বিধি অনুসারে নির্মল ও পবিত্র জলে স্নান করে শুদ্ধ বস্ত্র ও উত্তরীয় ধারন করে যথাবিদি নিত্যকর্ম সন্ধ্যা বন্দনা করেন। অতঃপর তিনি যজ্ঞ করতে বসেন ও মৌন হয়ে গায়ত্রী জপ করেন।
পরদারা ন গন্তব্যা সৰ্ববর্ণেষু কর্হিচিৎ।
ন হীদৃশমনায়ুষ্যং লোকে কিঞ্চন বিদ্যতে।
যাদৃশং পুরুষ্যেহ পরদারোপসেবনম্ ॥
যাবন্তো রোমকূপাঃ স্যুঃ স্ত্রীণাং গাত্রেষু নির্মিতাঃ।
তাবদ্বর্ষসহস্রাণি নরকং পর্য্যুপাসতে ॥
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৯১.২০-২১)
" সকল বর্ণের কোন মানুষই কখনো পরস্ত্রী গমন করবে না। কারণ, এ জগতে পরস্ত্রীগমনে পুরুষের যেমন আয়ুক্ষয় করে; তেমনি আয়ুক্ষয়কর কাজ জগতে আর দ্বিতীয়টি নেই।
কেউ যদি পরস্ত্রী গমন করে তবে, সেই পরস্ত্রী নারীর শরীরের যত রোমকূপ আছে, তত সহস্র বছর সেই পরস্ত্রীগামী নরক ভোগ করে।"
সনাতন সকল শাস্ত্রেই পরস্ত্রীগমন নিষিদ্ধ। পরনারীকে মায়ের দৃষ্টিতে দেখতে বলা হয়েছে। পরস্ত্রীগমনে সমাজে ব্যভিচারের ফলে অধর্মের উৎপত্তি ঘটে। সমাজে ব্যভিচারের প্রাবল্য দেখা দিলে পারিবারিক ব্যবস্থা সম্পূর্ণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।তাই এই নিন্দনীয় অপকর্মটি বেদ সহ সকল শাস্ত্রেই নিষিদ্ধ।
প্রসাধনঞ্চ কেশানামঞ্জনং দন্তধাবনম্ ।
পূর্বাহ্ণ এব কাৰ্য্যাণি দেবতানাঞ্চ পূজনম্ ৷৷
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৯১.২২)
"কেশবিন্যাস, নেত্রে কজ্জলদান, দন্তধাবন এবং দেবগণের অর্চনা করা পূর্ব্বাহ্নেই কর্ত্তব্য।"

চুল ঠিকমত আঁচড়ালে মাথার তালুর ঠিকমত ব্যায়াম হয়। কাজলের প্রচলন আজ হয়ত চলে যাচ্ছে, কাজলে চোখ ভাল থাকে এবং ভারতবর্ষীয় নারীদের সৌন্দর্য চর্চার একটি অংশ। দাঁতমাজা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি সংস্কার। এ সংস্কারটি যদি আমরা বাল্যকালে আয়ত্ত না করতাম তাহলে কি অবস্থা হত একবার ভাবুন তো?আমরা কেউ কারো কাছে বা ঘনিষ্ঠ সংস্পর্শেই যেতে পারতাম না। দাঁত মেজে, স্নান করে কেশবিন্যাস করে, চোখে কাজল দিয়ে ; শুদ্ধ দেহমনে দিনের শুরুতেই দেবতার পূজা-অর্চনা কর্তব্য।
পুরীষমূত্রে নোদীক্ষেন্নাধিতিষ্ঠেৎ কদাচন।
নাতিকল্যং নাতিসায়ং ন চ মধ্যন্দিনে স্থিতে ॥
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৯১.২৩)
"রাস্তায় পরে থাকা মলমূত্রাদি দর্শন এবং পা দিয়ে স্পর্শ করবে না। অতি প্রত্যুষে, সায়ংকালে ও মধ্যাহ্নসময়ে মলমূত্রাদি পরিত্যাগ করবে না।"
এই সন্ধি সময়গুলো প্রার্থনার সময়, তাই এ সময়ে মলমূত্রাদি পরিত্যাগ না করাই উত্তম। এ সময়গুলো প্রার্থনার সময়।
নাজ্ঞাতৈঃ সহ গচ্ছেত নৈকো ন বৃষলৈঃ সহ ৷
পন্থা দেয়ো ব্রাহ্মণায় গোভ্যো রাজভ্য এব চ।
বৃদ্ধায় ভারতপ্তায় গর্ভিণ্যৈ দুৰ্বলায় চ ৷৷
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৯১.২৪)
"অপরিচিত লোকের সাথে, একাকী, বৃষলের সাথে গমন করবে না। ব্রাহ্মণ, গোরু, রাজা, বৃদ্ধ, ভারবাহী, গর্ভবতী ও দুর্বলকে পথ ছেড়ে দিবে।"
অপরিচিত মানুষের সাথে কখনই একাকী যেতে নেই, এতে অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদের সম্ভাবনা থাকে। 'বৃষল' শব্দের অর্থ পাপি, পতিত, অধার্মিক ব্যক্তি। তাই যিনি বৃষল চরিত্রের ব্যক্তি, তার সাথে কোথাও যাওয়া উচিত নয়। কারণ সে চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বিশ্বস্ত নয়। বর্তমানে যে সম্মানিত ব্যক্তিদের পথ ছেড়ে দেওয়ার রীতি, এ বিষয়টি নতুন নয়; মহাভারতের যুগেও প্রচলিত ছিলো।
প্রদক্ষিণঞ্চ কুর্বীত পরিজ্ঞাতান্ বনস্পতীন্ ।
চতুষ্পথান্ প্রকুর্বীত সর্বানেব প্ৰদক্ষিণান্ ॥
মধ্যন্দিনে নিশাকালে অৰ্দ্ধরাত্রে চ সর্বদা।
চতুষ্পথং ন সেবেত উভে সন্ধ্যে তথৈব চ ৷৷
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৯১.২৫-২৬)
"পরিচিত অশ্বত্থপ্রভৃতি বৃক্ষ এবং চতুষ্পথকে প্রদক্ষিণ করবে। মধ্যাহ্নকালে, রাত্রে বিশেষতঃ অর্দ্ধরাত্র সময়ে এবং প্রাতঃসন্ধ্যা ও সায়ংসন্ধ্যাকালে চতুষ্পথে কখনো যাবে ন৷"
ধর্মে অশ্বত্থবৃক্ষ অত্যন্ত পবিত্র একটি বৃক্ষ। তাই অশ্বত্থবৃক্ষের পরিক্রমা করতে শাস্ত্রে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। তাই প্রতিদিন যদি অশ্বত্থবৃক্ষের পরিক্রমা করতেই হয় তবে পরিচিত অশ্বত্থবৃক্ষের পরিক্রমা করা উচিত। এতে অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদের সম্ভাবনা দূর হয়।তেমনিভাবে পরিচিত পথ এবং চতুষ্পথে চলাচল করা উচিত। একেবারে ভোরবেলা, মধ্যাহ্নবেলা এবং গভীর রাত্রি এ সময়ে একান্তই প্রয়োজন ছাড়া পথে একাকী চলাচল করা উচিত নয়। এই সময়ে পথে লোকসমাগম অনেক কম থাকে বা থাকে না। লোকশূণ্য পথে একাকী বিপদের সম্ভাবনা থাকে। তাই এ সময়কালে যথাসম্ভব ঘরে থাকাই মঙ্গলের।
উপানহৌ চ বস্ত্ৰঞ্চ ধৃতমন্যৈর্ন ধারয়েৎ ।
ব্রহ্মচারী চ নিত্যং স্যাৎ পাদং পাদেন নাক্ৰমেত্ ৷৷
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৯১.২৭)
"অন্যের ব্যবহৃত বস্ত্র ও পাদুকা ব্যবহার করা নিষিদ্ধ। সর্বদা ব্রহ্মচারী, অর্থাৎ সংযমের সাথে থাকতে হবে। এক পা দিয়ে অন্য পা আক্রমণ করবে না।"
বর্তমানের চিকিৎসা বিজ্ঞানও নিষেধ করে, অন্যের ব্যবহৃত কাপড় এবং জুতা পড়তে। এতে একজন থেকে অন্যজনে সুক্ষ্ম রোগ-জীবাণু সংক্রামিত হয়। মানুষের ইন্দ্রিয় প্রবল, তাই সর্বদা সংযমী হয়ে ইন্দ্রিয়কে নিয়ন্ত্রিত করতে হয়। অনেকের অভ্যাস আছে এক পা দিয়ে অন্য পা আক্রমণ করা, অনর্থক পায়ে পায়ে ঘর্ষণ করা। বিষয়টি একদিকে যেমন দৃষ্টিকটু, তেমনি এর ফলে শরীরেও আঘাত লাগতে পারে।
অমাবস্যাং পৌর্ণমাস্যাং চতুৰ্দ্দশ্যাঞ্চ সৰ্বশঃ ।
অষ্টমাং সর্বপক্ষাণাং ব্রহ্মচারী সদা ভবেৎ।।
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৯১.২৮)
"অমাবস্যা, পূর্ণিমা এবং উভয়পক্ষীয় চতুর্দশী ও অষ্টমী তিথিতে সর্বদা ব্রহ্মচারী হয়ে থাকবে।"
মানুষের দেহের অধিকাংশই জলীয় অংশ। চন্দ্রের কারণে আমরা নদী বা সমুদ্রতে জলের হ্রাস বৃদ্ধি দেখি। মানুষের শরীরের সিংহভাগই জল দ্বারা গঠিত, তাই নদী সমুদ্রের হ্রাস বৃদ্ধির মত একই কারণে এ তিথিগুলোতে মানুষের দেহে একই হ্রাস বৃদ্ধি ঘটে। বৃদ্ধরা অমাবস্যা পূর্ণিমাতে দেহের অভ্যন্তরে এ পরিবর্তন বেশী অনুভব করে, ব্যাথা সহ বিভিন্ন উপসর্গের আবির্ভাব ঘটে সে সময়ে তাদের দেহে। তাই এ তিথিগুলোতে ব্রহ্মচারী অর্থাৎ স্ত্রী সহবাসাদি পরিত্যাগ করে যতটা সম্ভব সংযতচিত্ত থাকতে হয়।
বৃথা মাংসং ন খাদেত পৃষ্ঠমাংসং তথৈব চ ।
আক্রোশং পরিবাদঞ্চ পৈশুন্যঞ্চ বিবর্জয়েৎ ॥
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৯১.২৯)
"বৃথামাংস ও পৃষ্ঠমাংস ভোজন করা কদাচ কর্তব্য নয়।পরের প্রতি আক্রোশ, পরের নিন্দা ও খলত্ব পরিত্যাগ করবে।"
মাংস ভক্ষণ শাস্ত্রে নিষিদ্ধ নয়, মাংস যেহেতু রজঃগুণ বৃদ্ধি করে, তাই শাস্ত্রে বৃথামাংস বা অতিরিক্ত মাংস খেতে নিষেধ করা হয়েছে। জগতে কারো প্রতি অকারণে আক্রোশ করতে নেই, নিন্দা করতে নেই। এতে যে করে তারই ক্ষতি হয়। খলত্ব বা ক্রুরতা মানুষকে রসাতলগামী করে। তাই আক্রোশ, নিন্দা ও ক্রুরতা পরিত্যাগ করা সর্বতোভাবে বিধেয়।
নারুন্তুদঃ স্যান্ন নৃশংসবাদী ন হীনতঃ পরমভ্যাদদীত।
যযাস্য বাচা পর উদ্বিজেত ন তাং বদেদুশতীং পাপলোক্যাম্।।
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৯১.৩০)
" করো হৃদয়ে ব্যাথা দিবে না, কাউকেই নিষ্ঠুর বাক্য বলবে না, নীচ ব্যক্তি হতে দান গ্রহণ করবে না, যে বাক্যদ্বারা অন্যের উদ্বেগ হয়; এমন অমঙ্গল এবং নারকীয় বাক্য বলবে না।"
কারো হৃদয়ে আঘাত করে নিষ্ঠুর বাক্য কখনো বলতে নেই। অন্যের উদ্বেগজনক নিষ্ঠুরবাক্য মানুষকে হীন করে দেয়, এগুলো যার প্রতি করা হয় তার কোন ক্ষতি হয় না ; বরং বুমেরাং হয়ে যিনি এর চর্চা করেন তিনিই ক্ষতিগ্রস্ত হন। তাকেই পাপ গ্রাস করে নরকে পতিত করে। জগতে সকল মানুষের দান গ্রহণ করতে নেই। হীন ব্যক্তি যিনি অসৎ উপায়ে অন্যকে ক্ষতিগ্রস্ত করে সম্পদ লাভ করেছেন; তার থেকে কোন দ্রব্য গ্রহণ করা উচিত নয়।এতে দাতার পাপকর্মের তামসিকতা গ্রহীতাকেও আচ্ছন্ন করে।তার বিবেচনা না করে যারতার থেকে দান গ্রহণ করা সর্বদা বর্জনীয়।
বাকসায়কা বদনান্নিষ্পতন্তি যৈারাহতঃ শোচতি রাত্র্যহানি।
পরস্য বা মর্মসু যে পতন্তি তান্ পণ্ডিতো নাবসৃজেৎ পরেষু॥
রোহতে সায়কৈর্বিদ্ধং বনং পরশুনা হতম্ ।
বাচা দুরুক্তয়া বিদ্ধং ন সংরোহতি বাকক্ষতম্ ॥
কর্ণিনালীকনারাচান্নির্হরন্তি শরীরতঃ ।
বাক্শল্যস্তু ন নির্হর্ত্তুং শক্যো হৃদিশয়ো হি সঃ ॥
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৯১.৩১-৩৩)
"মনুষের মুখ থেকে বাক্যরূপ বাণ নির্গত হয়।যে বাক্যরূপ বাণ বদন হতে নির্গত হয়ে অন্যের মর্মভেদ করে, যার দ্বারা আহত হলে দিবারাত্রি শোকাকুল হতে হয়, পণ্ডিত ব্যক্তি কখনই বাক্যরূপ বাণ অন্যের প্রতি প্রয়োগ করবে না। বাণক্ষত অঙ্গ বা কুঠারে ছিন্ন অরণ্য পুনরায় উৎপন্ন হয়। কিন্তু দুর্বাক্যদ্বারা অন্যের হৃদয়কে বিদ্ধ করলে, সেই ক্ষতস্থান অপ্রতিবিধেয় হয়ে উঠে।দেহ হতে কর্ণী, নালীক, নারাচ নিষ্কাশন করা যায়।কিন্তু দুর্বাক্যরূপ বাণ হৃদয় হতে কখনোই নিষ্কাসিত করা যায় না।কারণ, সেই বাক্যরূপ বাণ হৃদয়ে দৃঢ় ক্ষত সৃষ্টি করে।"

শব্দকে ব্রহ্ম বলা হয়েছে, তাই শব্দ অবিনশ্বর ; জগতের প্রত্যেকটি শব্দের একটি শক্তি আছে। এ কারণেই কখনও কারো প্রতি দুর্বাক্য ব্যবহার করা উচিৎ নয়। তীর যেমন একবার নিক্ষিপ্ত হলে তাকে ফিরিয়ে নিয়ে আসা যায় না। বাক্যরূপ তীরও ঠিক এমনি। বাণ দ্বারা ক্ষত-বিক্ষত অঙ্গ চিকিৎসা এবং শুশ্রূষায় পুনরায় পূর্বের মত হতে পারে।কুড়াল দিয়ে বনের সকল গাছকে ছেদন করলে, বৃক্ষের গোড়া থেকে আবার নতুনভাবে গাছ অঙ্কুরিত হয়; কিন্তু কারো প্রতি দুর্ব্যবহার করলে তা আর ফিরিয়ে নিয়ে আসা যায় না, প্রতিবিধান করা যায় না। জগতে অবিনশ্বর হয়ে রয়ে যায়। তাই কটুবাক্য কখনই কারো প্রতি প্রয়োগ করতে নেই।
হীনাঙ্গানতিরিক্তাঙ্গান্ বিদ্যাহীনান্ বিগর্হিতান্ ।
রূপদ্রবিণহীনাংশ্চ সত্ত্বহীনাংশ্চ নাক্ষিপেৎ ॥
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৯১.৩৪)
"হীনাঙ্গ, অতিরিক্তাঙ্গ,বিদ্যাহীন, অত্যন্ত নিন্দিত, শ্রীহীন কদাকার, নিঃস্ব ও দুর্বল ব্যক্তিগণকে নিয়ে নিন্দা বা পরিহাস করবে না।"
শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী, পাগল, অপরাধী, অসুন্দর, দরিদ্র এবং দুর্বলদের নিয়ে কোন পরিহাস করা উচিৎ নয়। আমাদের উপলব্ধি করতে হবে, যে কোন পরিস্থিতিতে আমরা যে কোন তথাকথিত সুস্থ মানুষও এমন হতে পারি। তবে সমাজের সাথে সাথে আমাদের মানবিক বোধ এবং ভাষাও পরিবর্তিত হচ্ছে, আগে শারীরিক বিভিন্ন প্রতিবন্ধীদের যারযার সমস্যা অনুসারে অন্ধ, লেংড়া, কানা, খোড়া বলে অভিহিত করা হত। কিন্তু এখন আমরা এ অমানবিক নিষ্ঠুর শব্দগুলো ব্যবহার করি না। এখন বলি প্রতিবন্ধী, কেউ কেউ আরও মানবিক দৃষ্টিতে ইদানীং বলি দিব্যাঙ্গ। দৈবী কারণে সে শারীরিকভাবে অসুস্থ, তাই তাকে দিব্যাঙ্গ বলা হয়। ভাবতে অবাক লাগে, প্রতিবন্ধীদের নিয়ে পরিহাস না করতে; মানসিক অসুস্থকে পাগল না বলতে; দরিদ্র ও অসুন্দরদের নিয়ে নিন্দা না করতে -এ মানবিক বিধানগুলো মহাভারতে পাঁচহাজার বছর পূর্বেই দেয়া আছে। বিষয়গুলো আজ বৈশ্বিক মানবিক মূল্যবোধের অংশ।
"নাস্তিকতা, বেদনিন্দা, বিদ্বেষ প্রকাশ,অভিমান, উগ্রতা পরিহার করা সর্বতোভাবে কর্তব্য।"
ঈশ্বরের প্রতি আমাদের তীব্র বিশ্বাস থাকা প্রয়োজন। তাই ঈশ্বরের বাণী বেদের কখনও নিন্দা করা উচিৎ নয়। মনের মধ্যে বিদ্বেষ এবং অভিমান পুষে কখনও ঈশ্বরের পথে যাওয়া যায় না, ঈশ্বরকে পাওয়া যায় না।
"মলমূত্র পরিত্যাগ ও পথ পর্যটনের পর এবং স্বাধ্যায় ও ভোজনকালে পাদপ্রক্ষালন করা অবশ্য কর্তব্য।"
মলমূত্রাদি ত্যাগের সময়ে সুক্ষ্ম রোগ-জীবাণু সংক্রমণের সম্ভাবনা থাকে। তাই আধুনিক বিজ্ঞানও বলে এ সময়ে ভাল করে হাত-পা জল দিয়ে ধুয়ে নিতে হয়। বিষয়টি রাস্তাঘাটে চলাফেরা করার ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য। কারণ, রাস্তায় প্রচুর জীবাণু থাকে, যা পা দ্বারা বাহিত হয়ে ঘরে চলে আসে। তাই বেদপাঠ এবং খাবারের আগে হাত-পা ভাল করে ধুয়ে পরিষ্কার পরিছন্ন করে নিতে হয়।
সংযাবং কৃসরং মাংসং শঙ্কুলীং পায়সং তথা ।
আত্মার্থং ন প্রকৰ্ত্তব্যং দেবাৰ্থস্তু প্রকল্পয়েৎ ॥
(মহাভারত:অনুশাসন পর্ব, ৯১.৪০)
"যবচূর্ণ বা যবনির্মিত পিঠা, কৃশর ( তিলতণ্ডুলকৃত অন্ন বা খিচুড়ি ), মাংস, শঙ্কূল( ঘিয়ে ভাজা ময়দার পিঠা) ও পায়স এগুলো নিজের জন্য প্রস্তুত করবে না; ঐ সমস্ত দ্রব্য দেবতার নিমিত্ত প্রস্তুত করবে।"

যবচূর্ণ বা যবনির্মিত পিঠা, খিচুড়ি, মাংস এবং বিবিধ প্রকারের পিঠা সহ সকল উপাদেয় সুস্বাদু খাবার কখনো একা খেতে নেই; দেবতাদের সমপর্ণ করে, সকলকে দিয়েই তবে খেতে হয়।
"প্রতিদিন অগ্নিতে আহুতিপ্রদান, ভিক্ষুককে ভিক্ষাদান ও মৌনাবলম্বনপূর্ব্বক দন্তকাষ্ঠ ব্যবহার করবে। সূর্য্যোদয় হলে শয্যায় শয়ান থাকবে না। যদি দৈবাৎ সূর্য্যেদয়ের পরও কেউ শয়ান থাকে, তাই হলে প্রায়শ্চিত্ত করবে। প্রাতঃকালে শয্যা হতে গাত্রোত্থান করে মাতা, পিতা ও আচার্যকে নমস্কার করা কর্তব্য।"
প্রতিদিনই সাধ্যানুযায়ী যজ্ঞের অনুষ্ঠান করা প্রয়োজন। কিন্তু বর্তমানে আমাদের সমাজ থেকে যজ্ঞ প্রথা অনেকটা লোপ পেয়েছে বললেই চলে। শুধু দেবতাদের পূজাতেই সীমিত পরিসরে যজ্ঞ অনুষ্ঠিত হয়। প্রতিদিন সাধ্যানুসারে দরিদ্রদের দান করা উচিৎ। সূর্যোদয়ের পরে আর শয্যাশায়ী থাকা উচিৎ নয়। শাস্ত্রের নির্দেশ অমান্য করে যদি কেউ থাকে, তবে শাস্ত্রে প্রায়শ্চিত্ত করতে বলা হয়েছে। এক্ষেত্রে মানসিক প্রায়শ্চিত্ত খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মানসিক প্রায়শ্চিত্ত হল, নিজে নিজে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়া যে, আমি অশাস্ত্রীয় কদাচার জীবনে আর করব না। সকালে ঘুম থেকে উঠে, প্রথমে গর্ভধারিণী মাকে, পরে জন্মদাতা পিতাকে, এরপরে আচার্যকে নমস্কার করতে হয়। আচার্য তাঁকেই বলা হয়, যিনি বিনে পয়সায় অবৈতনিক বৈদিক শিক্ষা দেন।
"যে সকল দন্তকাষ্ঠ অব্যবহার্য তা কদাচ ব্যবহার করবে না, যে সকল দন্তকাষ্ঠ ব্যবহার্য বলে নিদিষ্ট শুধু তাই ব্যবহার করবে।"
দন্তকাষ্ঠকে আমরা বর্তমান কালের দাঁত মাজার ব্রাশ বলতে পারি, এখানে ব্যবহার উপযোগী ভাল মানের ব্রাশই সর্বদা করতে বলা হয়েছে।
"দন্তধাবন না করে দেবপূজা এবং দেবপূজা না করে গুরু, বৃদ্ধ, ধার্মিক ও বিজ্ঞ ব্যক্তি ব্যতীত অন্য লোকের নিকট গমন করবে না।"
দাঁত না মেজে, পরিষ্কার পরিছন্ন না হয়ে কখনই কোন শ্রদ্ধেয় গুরুজনদের সংস্পর্শে যাওয়া উচিৎ নয়। দিনের শুরুতেই আগে পরিষ্কার পরিছন্ন হয়ে নিজের নিত্যকর্ম দেবপূজন করেই তবে গৃহ থেকে অন্যত্র যেতে হয়।
"মলিন দর্পণে আপনার প্রতিবিম্ব দর্শন করা উচিত নয়। গর্ভিণী ও ঋতুমতী স্ত্রীকে সম্ভোগ করা নিতান্ত অকর্তব্য।"
ভাঙা বা মলিন আয়নায় মুখ দেখতে নেই। মলিন আয়নায় নিজেকে মলিন দেখায়, এতে অনেক সময়ে আত্মবিশ্বাসের ঘাটতি দেখা দিতে পারে। গর্ভিণী ও ঋতুমতী অবস্থায় নারী শারীরিক মানসিকভাবে কিছুটা দুর্বল থাকে, তাই সে সময়ে তাদের সাথে যৌনকর্ম করা একেবারে উচিৎ নয়।
"উত্তর ও পশ্চিমদিকে মস্তক বিন্যস্ত করে শয়ন করবে না; পূর্ব ও দক্ষিণে মস্তক সন্নিবেশিত করে শয়ন করাই শ্রেয়স্কর।"
উত্তরদিক পৃথিবীর কেন্দ্র হওয়ায়, সেখানে প্রচণ্ড এক চৌম্বকীয় শক্তি সর্বদাই কাজ করে, তাই উত্তর দিকে মাথা রেখে শয়নের সময়ে আমাদের মস্তিষ্কের চৌম্বকীয় শক্তি এবং পৃথিবীর কেন্দ্রের বৃহত্তর চৌম্বকীয় শক্তির আকর্ষণে মস্তিষ্কের ক্ষতি হয়। সূর্যের উদয়ে পূর্বদিক হল প্রকাশের দিক। তাই পূর্বদিকে মাথা রেখে সর্বদা শয়ন করাই শ্রেয়।
"নাস্তিকের সাথে নিয়ম স্থাপন করে তার কার্য্যানুরোধে কোন স্থানান্তরে গমন করবে না।"
নাস্তিক বা অবিশ্বস্ত কারো সাথে তাদের অনুরোধে তাদের নির্দিষ্ট অপরিচিত স্থানে কখনই যাওয়া উচিৎ নয়। এতে অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদের সমূহ সম্ভাবনা থাকে।
"ভগ্ন বা জীর্ণ খট্বায় শয়ন করা নিতান্ত নিষিদ্ধ। চরণদ্বারা আসন আকর্ষণ করে উপবেশন, বিবস্ত্র হয়ে অবগাহন, রাত্রিকালে স্নান, স্নানান্তর গাত্রমর্দন, স্নান না করে অনুলেপনদ্রব্য সেবন, স্নান করে অার্দ্রবস্ত্রে কম্পন ও প্রতিদিন অার্দ্রবস্ত্র পরিধান করাও কর্তব্য নয়।"
ভাঙা বা পুরাতন খাটে কখনই শয়ন করা উচিৎ নয়। এতে খাট ভেঙে শারীরিক বড় বিপদ হতে পারে, পঙ্গুও হয়ে যেতে পারে । কোন বসার আসন সকলের সামনে পা দিয়ে টেনে টেনে নিয়ে আসাটা ঔদ্ধত্যের লক্ষণ, তাই এটি কখনই করা উচিত নয়। প্রকাশ্য কোন জলাশয়ে উলঙ্গ হয়ে স্নান করা একটি নিন্দনীয় কর্ম, তাই এ দুষ্কর্ম কখনই করা উচিৎ নয়। রাত্রে স্নান করা উচিৎ নয়, এতে অনেকের শরীরেই বিভিন্ন রোগের উপসর্গ তৈরি করে। স্নানের পরে কোন গাত্রমর্দন করা উচিৎ নয়। স্নান করে অবশ্যই সাথে সাথেই শুকনো কাপড় পড়তে হবে। ভেঁজা কাপড় পড়ে থাকা একদমই উচিৎ নয়, এতে শারীরিক ক্ষতি হয়।
"যিনি পূর্বাস্য হয়ে ভোজন করেন, তিনি দীর্ঘায়ু; যিনি দক্ষিণাস্য হয়ে ভোজন করেন, তিনি যশস্বী ; যিনি পশ্চিমাস্য হয়ে ভোজন করেন, তিনি ধনবান ও যিনি উত্তরাস্য হয়ে ভোজন করেন তিনি সত্যবাদী হন। গমন করতে করতে কদাচ কোন বস্তু ভোজন করবে না।"
পূর্বদিক সূর্যের প্রকাশের দিক বিধায় অধিকাংশ দেবকার্য পূর্বদিকেই সম্পন্ন হয়। তাই দেবার্চনাদি, ভোজন, শয়ন সহ সকল কর্মই পূর্বদিকে মুখ করে করা মঙ্গলজনক। খেতে খেতে কখনই রাস্তার চলাফেরা করা উচিত নয়। এতে যেমন খাদ্য গলাধঃকরণে সমস্যা হতে পারে, তেমনি অন্নরূপ ব্রহ্মের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ পায়।
"দণ্ডায়মান হয়ে মূত্র পরিত্যাগ করবে না। যিনি আর্দ্রপাদ হয়ে ভোজন করেন, তিনি শতবর্ষজীবী হন, সন্দেহ নাই। ভগ্ন আসনে উপবেসন এবং ভগ্ন কাসার থালাতে ভোজন বিধেয় নয়।উত্তরীয় ধারণ না করে ভোজন, নগ্ন হয়ে স্নান বা শয়ন ও অশুচি হয়ে উপবেশন করা নিতান্ত অকর্তব্য।"
দাড়িয়ে প্রস্রাব করা উচিৎ নয়। খাবার আগে ভাল করে হাত এবং পা ধুয়ে তবেই খেতে বসতে হবে। বাইরে থেকে এসে পা না ধুয়ে কখনই খেতে বসা উচিৎ নয়। ভাঙা আসনে এবং ভাঙা থালায় খাবার খাওয়া কখনই উচিত নয়; এতে মনঃকষ্ট বাড়ে, মন ছোট হয়ে যায়। নগ্ন হয়ে স্নান করা, শয়ন করা এবং অশুচি অবস্থায় উপবেসন সহ সকল প্রকার কর্ম করা সম্পূর্ণ অনুচিত।
"শাস্ত্রে আছে মাথায় প্রাণসমুদয় প্রতিষ্ঠিত, তাই অশুচি হয়ে কারো মস্তক স্পর্শ করবে না। মাথায় আঘাত করবে না, চুল ধরে টানবে না।"
আমাদের মাথার দু'ভ্রূরুর মধ্যবর্তী স্থানে আজ্ঞাচক্র অবস্থিত। এ চক্র থেকে রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ ইত্যাদির অনুভূতি নিয়ন্ত্রিত হয়। এ চক্রতেই জ্যোতি দর্শন হয়ে সাধকের অনির্বচনীয় আজ্ঞা বা নির্দেশ আসে। এ কারণে এর নাম আজ্ঞাচক্র।এখানে বায়ুক্রিয়ার অন্ত হয়ে ইড়া পিঙ্গলা, সুষুম্না নাড়ির মিলন হয়, তখন তাকে সাধকের ত্রিবেণী সঙ্গম বলে। এ স্তরে প্রকৃতির বন্ধন থেকে মুক্ত হয়ে যোগী মস্তকের ব্রহ্মরন্ধ্র ভেদ করে মহাসমাধি লাভ করে। আমাদের দেহের অভ্যন্তরে সুষুম্না নাড়ীর পথে অতি সূক্ষ্ম পদ্মাকৃতিমূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা-ছয়টি চক্র আছে, যাকে ষটচক্র বলে।সকলের উর্দ্ধে আছে সহস্র পাপড়ির সহস্রার পদ্ম। সাধক যখন মুক্তি লাভ করে তখন তার এই সহস্র পাপড়ির পদ্মটির একটি একটি পাপড়ি প্রস্ফুটিত হচ্ছে এমন উপলব্ধি হয়।মাথাতেই সহস্রার চক্র বিরাজমান এবং পঞ্চপ্রাণ এখানেই প্রতিষ্ঠিত, তাই অপবিত্র অশুচি অবস্থায় কারো মাথায় স্পর্শ করতে নেই। কাউকে মাথায় আঘাত করতে নেই এবং চুল ধরে টানতে নেই। এতে যিনি এ কর্মটি করেন, তার পরমায়ু কমে যায়।
"স্নানকালে নিরন্তর সলিলমধ্যে মস্তক নিমগ্ন করা কদাপি কর্তব্য নয়। কৃতস্নান হয়ে দেহে তৈল প্রদান করবে না।"
স্নানকালে বারবার জলের মধ্যে মাথা নিমগ্ন করে ডুব দেয়া অনুচিত।এতে অতিরিক্ত ঠাণ্ডা লেগে যেতে পারে, চোখ লাল হয়ে ফুলে যেতে পারে এবং কানে জল ঢুকে যেতে পারে। শরীরে তেল সর্বদা স্নানের আগেই দিতে হবে; আগে গায়ে তেল মেখে তবে স্নান করতে হবে।
"তিল-মিশ্রিত ভক্ষ্যদ্রব্য ভক্ষণ করা বিধেয় নহে।অশুচি হয়ে অধ্যয়ন ও অধ্যাপন করা নিতান্ত নিষিদ্ধ। উচ্ছিষ্ট হাতে বেদপাঠ শাস্ত্রীয় আলাপ করলে আয়ু ও বংশক্ষয় হয়।"
তিল মিশ্রিত অন্ন পিতৃপুরুষের উদ্দেশ্যে শ্রাদ্ধে ব্যবহৃত হয়, তাই সর্বদা ভক্ষণীয় নয়। অশুচি তিনপ্রকার, কায়িক,বাচিক এবং মানসিক। এ অশুচি অবস্থায় অখনও অধ্যয়ন এবং অধ্যাপনা করা উচিত নয়। খাওয়ার পরে হাত-পা-মুখ ভাল করে না ধুয়ে উচ্ছিষ্ট হাতে বেদপাঠ করা নিষিদ্ধ। এতে পরমায়ু এবং বংশধারা ক্ষয়প্রাপ্ত হয়।
"গুরুর সহিত কোন বিষয় লইয়া বিতণ্ডা করা কর্তব্য নয়।গুরু ক্রুদ্ধ হলে যথোচিত সম্মানপূর্ব্বক তাকে প্রসন্ন করা উচিত।"
গুরুর সাথে বিতণ্ডা করতে নিষেধ করা হয়েছে।আমাদের শাস্ত্রে তিনপ্রকার তর্কের কথা বলা হয়েছে: বাদ, জল্প, এবং বিতণ্ডা। বাদ হল দুজনের আলোচনাতে একটা সিদ্ধান্তে পৌছানো। জল্প হল অন্যের কথা না শুনে, যার যার কথা সে সে বলে যাওয়া এবং বিতণ্ডা হল নিজের বলার কিছুই নেই অন্যের নিন্দা বা যুক্তিখণ্ডন। এরমধ্যে শ্রেষ্ঠ হল বাদ সিদ্ধান্তবাদ। শাস্ত্র নির্ণয়ের এ সিদ্ধান্তবাদ অত্যন্ত প্রয়োজনীয়।
"বাসগৃহের নিকট অতিথিশালা নির্মাণ, পাদ প্রক্ষালন এবং উচ্ছিষ্ট দ্রব্য নিক্ষেপ করা হিতকরী মানুষের পক্ষে নিতান্তই অকর্তব্য।"
অতিথিশালাতে বিভিন্ন রকমের মানুষের আনাগোনা থাকে, তাই তাদের সংস্পর্শে পরিবারের সদস্যরা প্রভাবিত হতে পারে, বিভিন্ন রোগ জীবাণু ঘরে প্রবেশ করতে পারে ; অহেতুক অনেক ঝামেলা তৈরি হতে পারে। তাই বাসগৃহের নিকট অতিথিশালা নির্মাণ করা উচিত নয়। নিজের পা ধোওয়া জল উচ্ছিষ্ট দ্রব্য আশেপাশে নিক্ষেপ করা অনুচিত এবং অশোভন।
"অন্যের ব্যবহৃত বস্ত্র ব্যবহার করবে না।শয়ন, চতুষ্পথাদিতে গমন ও দেবপূজার সময় পৃথক্ পৃথক্ বস্ত্র পরিধান করা আবশ্যক। কারো সাথে একপাত্রে ভোজন করবে না, এটা গর্হিত কর্ম।"
বর্তমান চিকিৎসা বিজ্ঞানও অন্যের ব্যবহৃত কাপড় ব্যবহার করতে নিষেধ করে।এতে একজনের শরীর থেকে অন্যজনের শরীরে বিভিন্ন সুক্ষ্ম রোগ-জীবাণু সংক্রমিত হয়। শয়নের সময়ে, বাইরে ঘোরাঘুরির সময়ে এবং দেবতাপূজায় সকল ক্ষেত্রেই আলাদা বস্ত্র ব্যবহার করা উচিত। রাস্তায় ঘোরাঘুরি করা বস্ত্রে বিছানায় ঘুমাতে যাওয়া সম্পূর্ণ অনুচিত। এতে রাস্তাঘাটের রোগ জীবাণু শয্যাতে চলে আসে। আত্মীয় পরিজন বন্ধু যেই হোক, কারো সাথেই এক থালায় খাওয়া উচিত নয়, এটা গর্হিত কর্ম। এতে একজনের মুখের লালা থেকে অন্য একজন সুস্থ মানুষও রোগাক্রান্ত হতে পারে।
"রজঃস্বলাকর্ত্তৃক সম্পাদিত অন্ন ভোজন ও উদ্ধৃতসার ( মাখন), দুগ্ধাদি পান করা কদাপি বিধেয় নয়। যাচক ব্যক্তিকে অন্নাদি দান না করে কদাপি ভোজন করবে না। অশুচি ব্যক্তির নিকটে উপবিষ্ট হয়ে, সাধু ব্যক্তিদের অবজ্ঞা করে ভোজন করা নিতান্তই শাস্ত্রবিহিত নয়।"
সর্বদা স্নান করে শুদ্ধ হয়েই দেবার্চনাদি করতে হয়, নারীর রজঃস্বলাকালীন দিনগুলোতে সর্বদা স্নানাদি করা সম্ভব নয়; তাই তাকে সে কয়েকদিন দেবার্চনাদি সহ অন্ন পাক থেকে বিরত থাকতে বলা হয়েছে। যেহেতু দুধ এবং দুধের মাখন যজ্ঞ এবং পূজাতে ব্যবহৃত হয়, তাই পবিত্রভাবে সংগ্রহ করা হয়। শাস্ত্রে অন্নদানকে মহত্তর কর্ম বলা হয়েছে, তাই নিরন্ন মানুষকে অন্নদান করেই তবে ভোজন করতে বলা হয়েছে, একে নৃযজ্ঞ বলা হয়।
"যে সকল ভক্ষদ্রব্য ধর্মশাস্ত্রে অভক্ষ্য বলে নির্দিষ্ট হয়েছে, তা গোপনেও ভক্ষণ করবে না।ছাগ,গো ও ময়ূরের মাংস,শুষ্ক মাংস এবং পর্য্যুষিতান্ন ভোজন করা গর্হিত। কাঁচা লবন এবং রাত্রে দধি এবং শক্তু ভোজন নিষিদ্ধ। বৃথামাংস ভোজন করাও কারও কর্ত্তব্য নহে। "
আমাদের ধর্মশাস্ত্রে সুস্পষ্টভাবে দেয়া আছে, কি খাওয়া যাবে এবং কি খাওয়া যাবে না। শাস্ত্রে যা নিষিদ্ধ, সে সকল খাবার গোপনেও খাওয়া উচিত নয়। কেউ না দেখলেও স্বয়ং দ্রষ্টাপুরুষ দেখছেন।শাস্ত্রে দেবতাদের সমর্পণ করেই মাংস খেতে বলা আছে। ছাগ যেহেতু স্ত্রী, দেবতাকে সমর্পিত হয় না, তাই ছাগ মাংস নিষিদ্ধ ; দেবতাকে সমর্পণ করে পাঁঠা খাওয়া যায়।গরু, ময়ূরের মাংস, শুকনো মাংস এবং বহুদিনের দুর্গন্ধযুক্ত পচা খাবার খাওয়া গর্হিত অপরাধ, এতে স্বাস্থ্যের হানি ঘটে। কাঁচা লবন খাওয়াও শরীরের পক্ষে ভাল নয়। হজমে সহায়ক নয়, তাই রাত্রে দই এবং ছাতু খাওয়া অনুচিত। মাংস খাওয়া নিষিদ্ধ নয়, কিন্তু অতিরিক্ত মাংস খাওয়া ঠিক নয়।
"সমাহিত হয়ে কেবল দিনে একবার এবং রাত্রে একবার ভোজন করতে হয়।একবস্ত্রধারী শয়ান ও দণ্ডায়মান হয়ে এবং ভূমিতে খাদ্যদ্রব্য রেখে কখনই ভোজন করবে না।শব্দসহকারে ভোজন করা শাস্ত্রসম্মত নহে। মহাত্মারা প্রথমে অতিথিকে অন্নপান করিয়েই পরিশেষে তিনি ভোজন করবেন। সুহৃদবর্গকে ভোজ্যাদি প্রদান না করে শুধুই নিজে গ্রহণ করলে, তা হলাহল বিষ ভক্ষণ করা হয়।"
অতিরিক্ত খাওয়া সমীচীন নয়, তাই দিনেরাতে শুধু দুইবারই ভোজন করতে হয়। খালিগায়ে, বিছানায় শুয়ে, দাড়িয়ে খাবার খাওয়া উচিত নয়। মাটিতে খাবার রেখে খাওয়া অস্বাস্থ্যকর। শব্দ করে খাওয়াটা দৃষ্টিকটু, তাই শব্দ করে খাওয়া উচিত নয়, সমাজে বসে তো একদমই উচিত নয়। গৃহে অতিথি থাকলে, তাকে আগে খাইয়ে খাবার গ্রহণ করতে হবে। খাবার একা একা নয়, পরিবার পরিজন এবং সুহৃদবর্গদের সাথে ভাগাভাগি করে খেতে হবে। খাবার কাউকে না দিয়ে একা একা খেলে তা হলাহল বিষতুল্য হয়।
"শক্তু ভক্ষণ এবং পানীয়,পায়স,দধি,ঘৃত ও মধু পান করে ঐ সমুদয় দ্রব্যের শেষভাগ অন্যকে প্রদান করা কদাচ বিধেয় নয়।শঙ্কিতমনে ভোজন করা কর্তব্য নয়।ভোজনান্তে দধিপান নিতান্ত নিষিদ্ধ।ভোজনান্তে হাত দ্বারা মুখ ধুয়ে, সে জল দক্ষিণচরণের অঙ্গুষ্ঠে অর্পণ করবে।"
ছাতু, পানীয়, পায়স,দধি, ঘৃত ও মধু খেয়ে, খাবারের উচ্ছিষ্ট অবশিষ্টাংশ অন্যকে খেতে দেয়া অনুচি, এতে রোগের সংক্রমণ ঘটে। ভোজন পবিত্র যজ্ঞতুল্য, তাই আনন্দবিহীন শঙ্কিতমনে ভোজন ঠিক নয়। খাবার গ্রহণের পরে ভাল করে হাত মুখ ধুয়ে, হাতে সামান্য জল নিয়ে ডান পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলির উপরে অর্পণ করতে হবে।
"অন্যের নিন্দাসূচক ও অপ্রিয়বাক্য প্রয়োগ এবং ক্রোধ উদ্দীপন করা কদাপি বিধেয় নহে।দিবাবিহার এবং ঋতুমতী স্ত্রী, কুমারী ও দাসীর সহিত সংসর্গ করা নিতান্ত দূষণীয়।"
অন্যের নিন্দা এবং অপ্রিয় বাক্যের প্রয়োগ যিনি করেন তারই জীবনীশক্তি ধীরেধীরে নষ্ট হয়। দিনেরবেলা এবং ঋতুমতী অবস্থায় স্ত্রীর সাথে যৌনকর্ম করা অনুচিত। অন্যায়ভাবে কোন নারীর কুমারিত্ব হরণ করা এবং গৃহের দাসীর সাথে যৌনকর্ম করা -এ সকল অত্যন্ত নিন্দনীয় গর্হিতকর্ম ।
"বৃদ্ধ, জ্ঞাতি, দরিদ্র ও মিত্রকে স্বীয় আবাসে বাস প্রদান করা অবশ্য কর্তব্য।পারাবত, শুক, সারিকা ও তৈলপায়িক (আরশোলা) এরা গৃহে থাকলে গৃহস্থের মঙ্গল হয়।খাদ্যোত (জোনাকিপোকা), গৃধ্র, বনোকপোত, উৎক্রোশ( বাজ) ও ভ্রমর গৃহে প্রবেশ করলে তৎক্ষণাৎ শান্তিকার্য্যের অনুষ্ঠান করা কর্তব্য।"
পরিবার পরিজন বৃদ্ধ হয়ে গেলে তাদের পরিত্যাগ করা নয় বা বর্তমানকালের বৃদ্ধাশ্রমে পাঠিয়ে দেয়া নয়; তাদের সম্মানের সাথে নিজগৃহে আশ্রয় দিয়ে পরিপোষণ করতে হবে। প্রাণীকুলের মধ্যে কিছু পশুপাখি আছে গৃহের কল্যাণকর এবং কিছু আছে অনিষ্টকর। শকুন, বাজপাখি সহ যারা হিংস্র, এদের অনেকে মনুষ্য মাংসও খায়। প্রাচীনকাল থেকে বসতগৃহে এদের প্রবেশ অনিষ্টকর হিসেবে বিবেচিত। তাই এদের প্রবেশে গৃহে শান্তিকর্ম করতে হয়।
"মহাত্মা ব্যক্তিদিগের গোপনীয় বিষয়সমুদয় ব্যক্ত করা সম্পূর্ণ অনুচিত।রাজা, বৈদ্য, বালক, বৃদ্ধ, ভৃত্য, বন্ধু, ব্রাহ্মণ, শরণাগত ও স্বসম্পর্কীয় ব্যক্তির পত্নীর সহিত সংসর্গ করা নিতান্ত নিষিদ্ধ।"
মানুষ মাত্রই জীবনে অনেক শ্লীল বা অশ্লীল গোপনীয়তা থাকে। তেমনি মহাত্মা ব্যক্তিদেরও থাকে; তাই তাদের দুর্বল গোপনীয় বিষয় কখনই জনসম্মুখে প্রকাশ করা উচিত নয়। নিজ স্ত্রী ছাড়া অন্যের স্ত্রীর সাথে যৌনকর্ম সম্পূর্ণভাবে শাস্ত্রে নিষিদ্ধ।
"সন্ধ্যাকালে শয়ন, ভোজন ও বিদ্যার আলোচনা করা নিতান্ত অকর্তব্য।রাত্রিকালে পিতৃকার্য্য, স্নান ও শক্তুভোজন এবং ভোক্তান্তে কেশবিন্যাসাদি কার্য্যের অনুষ্ঠান করা একান্ত নিষিদ্ধ।পানভোজনাবশিষ্ট দ্রব্য অতি উপাদেয় হইলেও তাহা পরিত্যাগ করাই বিধেয়।"
সন্ধ্যাকালে গায়ত্রী উপাসনা করতে হয়, তাই এ সময়ে শয়ন, ভোজন এবং বিদ্যার আলোচনা করা অকর্তব্য। পিতৃকার্য সর্বদা দিনের পূর্বাহ্নেই করতে হয়। প্রাচীনকালে নারীপুরুষ নির্বিশেষে সকলেই দীর্ঘ চুল রাখতেন, খোলা চুল থাকলে তা খাবারে পড়তে পারে; তাই শাস্ত্রে কেশবিন্যাস করেই খাবার গ্রহণ করতে বলা হয়েছে।
"রাত্রিকালীন আহারসময়ে নিমন্ত্রিত ব্যক্তিকে পরিতৃপ্ত করিয়ে ভোজন করান কর্তব্য। স্বয়ং সম্পূর্ণরূপে আহার করা বিধেয় নয়। রাত্রিতে এবং খাবারের পরে চুল কাটা নিষিদ্ধ।"
নিমন্ত্রিত অতিথিকে আগে খাইয়েই পরে খাবার গ্রহণ করতে হবে। একাই রন্ধনকৃত সকল খাবার খেয়ে নেয়া ঠিক নয়। রাত্রে যেহেতু যথাসম্ভব স্নান না করতে বলা হয়েছে, চুল কাটার পরে যেহেতু অবশ্যই স্নান করতে হয় ; তাই রাত্রে চুল কাটা নিষিদ্ধ।
"সৎকুলসম্ভূত সুলক্ষণাক্রান্তা বয়স্থা কন্যার পাণিগ্রহণ করাই বিজ্ঞ ব্যক্তির বিধেয়।বংশরক্ষার্থ পুত্রোৎপাদন করিয়া জ্ঞান ও কুলধর্ম্মশিক্ষার্থ তাহাকে বিদ্যান ব্যক্তির নিকট সমর্পণ এবং কন্যা উৎপাদন করে সৎকুলসম্ভূত ধীশক্তিসম্পন্ন পাত্রে প্রদান করবে।সদ্বংশসম্ভূতা কন্যার সহিত পুত্রের বিবাহকার্য্য সম্পাদন ও জীবিকাবিধান করা অবশ্য কর্ত্তব্য।"
সুলক্ষণা বয়স্থা কন্যাকেই বিবাহ করতে বলা হয়েছে। আমরা বৈদিক যুগ সহ মহাভারতের যুগেও দেখি বাল্যবিবাহকে প্রোৎসাহিত করা হয়নি। কন্যাকে শিক্ষিতা করে, বয়স্থা করেই তবে সৎকুলজাত ধীশক্তিসম্পন্ন পাত্রের সাথেই বিবাহ দিতে বলা হয়েছে।
"মস্তক নিমজ্জনপূর্বক স্নান করেই দেবতা ও পিতৃকার্য করবে।জন্মনক্ষত্রে শ্রাদ্ধের অনুষ্ঠান করা উচিত নয়।এতদ্ভিন্ন জ্যোতিষশাস্ত্রে যে যে সময়ে শ্রাদ্ধ করা নিষিদ্ধ বলিয়া অভিহিত হয়েছে, সেই সেই সময়ে শ্রাদ্ধ করা অবিধেয়।"
দেবতা পূজা এবং পিতৃকার্য সর্বদা অহংকারশুন্য বিনীতভাবে স্নান করে পবিত্র হয়েই করতে হয়। জন্মতিথিতে শ্রাদ্ধশান্তি কর্মের অনুষ্ঠান করা সম্পূর্ণ অনুচিত।
"পূর্বাস্য বা উত্তরাস্য হয়ে সমাহিতচিত্তে ক্ষৌরকার্য্য সমাধান করা উচিত। গ্লানি করলে অধর্মে লিপ্ত হতে হয়, তাই আপনা বা পরের কখনই এটি করা উচিৎ নয়।"
চুল দাড়ি কাটা সহ সকল ক্ষৌরকর্ম পূর্ব এবং উত্তর দিকে মুখ করে নিবিষ্ট মনে করা উচিত, নিবিষ্ট মনে ক্ষৌরকর্ম না করলে কেটে রক্তপাত হতে পারে । গ্লানিকর পাপকর্মে অধর্ম হয়, তাই পাপকর্ম সর্বদা পরিত্যাগ করা উচিত।
"পিঙ্গলবর্ণা, কুষ্ঠরোগাক্রান্তা, অঙ্গহীনা, পতিতা এবং অপস্মারী ( মৃগীরোগী) ও শ্বিত্রীর কুলে সম্ভূতা কন্যাকে বিবাহ করা কর্তব্য নহে।আপনা অপেক্ষা উৎকৃষ্ট বা সদৃশ কুলে বিবাহ করাই শাস্ত্রসম্মত। স্ত্রীলোকের প্রতি ঈর্ষা প্রদর্শন করা কর্তব্য নয়। স্ত্রীকে পরম যত্নসহকারে রক্ষা করতে হবে। ঈর্ষান্বিত হয়ে ঈর্ষাপ্রদর্শন সতত নিষিদ্ধ, এতে আয়ু ক্ষয় হয়।"
নারী এবং কুলের যদি কিছু অনিরাময়যোগ্য রোগ থাকে তবে, সে সকল কুলের কন্যাকে বিবাহ করতে নিষেধ করা হয়েছে। বিষয়টি বর্তমান মানবতার দৃষ্টিতে দেখলে ঠিক নয়।কিন্তু আমাদের বুঝতে হবে কথাগুলো কোন ঈশ্বর বা দেবতাদের বলা নয়। এ কথাগুলো বলছেন, একজন মহারথী তাঁর বংশের উত্তরসূরী ক্ষত্রিয় রাজা যুধিষ্ঠিরকে, যার প্রধান লক্ষ্য রাজধর্ম।স্ত্রীলোকের প্রতি ঈর্ষা করা সম্পূর্ণ অনুচিত,এতে আয়ু ক্ষয় হয়।স্ত্রীকে যথাযোগ্য সম্মান এবং যত্নসহকারে সর্বদা রক্ষা করা স্বামীর কর্তব্য।
" দিবসে নিদ্রা ও সূর্যোদয় পরবর্তীতে শয়ন আয়ুক্ষয়কর হয়,সন্দেহ নাই।প্রত্যূষে শয়ন ও রাত্রিকালে অশুচি হয়ে শয়ন উভয়ই নিষিদ্ধ।পরস্ত্রীতে অনুরাগ প্রদর্শন করা নিষিদ্ধ। ক্ষৌরকর্ম্মসমাধানান্তে স্নান করা বিধেয়।সন্ধ্যাকালে বেদপাঠ, বেদাভ্যাস, ভোজন ও স্নান করা নিতান্ত অকর্তব্য।"
দিনের বেলা নিদ্রা, সূর্যোদয় পরবর্তীতে প্রত্যূষে শয়ন, রাত্রে অশুচি অবস্থায় শয়ন নিষিদ্ধ। কামনা দ্বারা প্রভাবিত হয়ে পরস্ত্রীর প্রতি তীব্র অনুরাগ অনুচিত।
"স্নান করিয়া ব্রাহ্মণগণের পূজা, দেবগণকে নমস্কার ও গুরুলোকদিগকে অভিবাদন করা কর্ত্তব্য।"
স্নান না করে দেবতা, ব্রাহ্মণ এবং গুরুবর্গীয়দের নমস্কার ও অভিবাদন করতে নেই, এতে তাদের প্রতি অশ্রদ্ধা প্রকাশ পায়।
"অনিমন্ত্রিত হয়ে কোন স্থলেই গমন করবে না।একাকী দেশান্তরে গমন ও রজনীযোগে ভ্রমণ করা বিধেয় নয়।কোন কার্য্যানুরোধে গৃহ হতে অন্যত্র গমন করতে সন্ধ্যা উপস্থিত না হতেই গৃহে আগমন করে বাস করা কর্তব্য।"
অনাকাঙ্ক্ষিত নিমন্ত্রণবিহীন কোথাও যাওয়া উচিত নয়। একদেশ থেকে অন্যদেশে একাকী যেতে নেই এতে বিপদের আশঙ্কা থাকে। রাত্রিতে একাকী ভ্রমণ করা বিধেয় নয়। কোন কাজ উপলক্ষে যদি দূরের কোথাও যেতে হয়, তবে যথাসম্ভব চেষ্টা করতে হবে সন্ধ্যার মধ্যেই নিজের গৃহে ফিরে আসার।
"পিতা, মাতা প্রভৃতি গুরুজনদিগের আজ্ঞা অবিচারিতচিত্তে প্রতিপালন করা উচিত।"
কোন বাদবিচার না করেই পিতামাতা এবং গুরুজনদের নির্দেশ পালন করা উচিত, এতে দেবতারা প্রসন্ন হন।
"ঋতুমতী ভার্য্যাসম্ভোগ ও তাকে আহ্বান করা নিতান্ত গর্হিত।ঋতুস্নান দিবসে রাত্রীকালে স্ত্রীসংসর্গ করিবে।ঋতুস্নানের পরদিবসে ভার্য্যাসম্ভোগ করিলে কন্যা ও তৎপরদিবস স্ত্রীসম্ভোগ করিলে পুত্র উৎপন্ন হয়।এইরূপ পঞ্চমাদি অযুগ্ম দিবসে স্ত্রীসংসর্গ করিলে কন্যা ও ষষ্ঠাদি যুগ্মদিবসে স্ত্রীসম্ভোগ করিলে পুত্র উৎপন্ন হইয়া থাকে।" ঋতুমতী অবস্থায় স্ত্রীসম্ভোগ করা উচিত নয়।
"জ্ঞাতি, সন্বন্ধী ও মিত্রগণকে সতত সমাদর করবে। প্রভূত দান সহকারে যজ্ঞ করবে।গৃহস্থ এই সমস্ত গার্হস্থ্য ধর্ম্ম প্রতিপালনপূর্বক বৃদ্ধাবস্থায় বাণপ্রস্থাশ্রম অবলম্বন করিবে।"
নিজ বংশের জ্ঞাতি, আত্মীয় পরিজনদের যথাসম্ভব সাহায্য সহযোগিতা করা উচিত। একজন গৃহস্থ এ সকল বর্ণিত সদাচার পালন করে, তৎপরে গার্হস্থ আশ্রম থেকে বাণপ্রস্থ নামক তৃতীয় আশ্রমে প্রবেশ করবে।সন্তানের উপরে সংসারের দায়িত্ব দিয়ে ভগবানের শরণে যাবে।
এ সকল সদাচার বর্তমানের জন্যেও সমানভাবে প্রাসঙ্গিক। হয়ত যুগের কারণে কিছু কিছু সদাচার রূপ পরিবর্তিত হয়েছে, কিন্তু এর অন্তর্নিহিত শ্বাশত শিক্ষাটি আজও একই আছে। মহাভারতে যেখানে দাঁত পরিষ্কার করতে দন্তকাষ্ঠ ব্যবহারের কথা আছে, সেখানে বর্তমানে ব্যবহৃত হচ্ছে, আধুনিক ব্রাশ, শুধু সামান্য রূপান্তরিত হয়েছে। কিন্তু এমনিভাবে অধিকাংশ সংস্কারই টিকে আছে বলেই তুর্কি, পাঠান, আরবীয় সহ বিভিন্ন বিদেশীরা এদেশীয় সংস্কৃতিকে সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে, সবাইকে ধর্মান্তরিত করতে পারেনি। তাদের চেষ্টার অন্ত ছিল না।বিদেশীরা বিফল হয়েছে, কারণ এ সংস্কৃতির একটি নিজস্বতা আছে, শ্বাশত শক্তি আছে। সদাচার নিয়ে অনুকূল ঠাকুরের অত্যন্ত সুন্দর প্রাসঙ্গিক একটা কথা আছে:
"সদাচারে বাঁচে-বাড়ে, লক্ষ্মী বাঁধা তার ঘরে।"
এ সদাচারের মধ্যে আমরা বাঁচতে পারছি না, বাড়তে পারছি না ; তাই হয়ত লক্ষ্মীকেও গৃহে বেঁধে রাখতে পারছি না। পরিণামে আমরা দিনেদিনে শ্রীহীন হয়ে যাচ্ছি। সদাচার যে কতটা আজও প্রাসঙ্গিক এবং প্রয়োজনীয় তা আমরা ২০২০ এর করোনাকালে হাড়েহাড়ে টের পাচ্ছি। একটি উদাহরণ দিয়েই বোঝানো যায়। আমাদের অন্তেষ্টিক্রিয়াতে মৃতদেহ পুড়িয়ে ফেলা হয়, যা দেখতে একটু অমানবিক মনে হলেও জীবাণু ধ্বংসের জন্যে শতভাগ কার্যকরী। মৃত ব্যক্তির লেপ, তোষক, কাঁথা সহ মৃতের মৃতকালীন ব্যবহৃত সকল কিছুই পুড়িয়ে ফেলা হয়। যাতে মৃত ব্যক্তির শরীরে যদি কোন ছোঁয়াচে জীবাণু থাকেও, তবে তা যেন আগুনে বিনষ্ট হয়ে আর সংক্রামিত হতে না পারে।মৃত ব্যক্তির বাড়ীর লোকজনকে অন্যদের থেকে কিছুদিনের জন্যে আলাদা রাখতেই অশৌচ বিধিনিষেধ। আতপ চালের ভাত মালসায় রান্না করে কলাপাতায় খেতে হয়। খেয়ে কলাপাতাটি ফেলে দিতে হয়, বাসন মজার ঝামেলা থাকে না। মৃতের পরিবারকে হাটবাজার থেকে দূরে রাখতে তাদের উপযোগী খাদ্য হবিষ্য আত্মীয় পরিজন দিয়ে আসে। অশৌচকালে চুল দাড়ি না কাটা সহ প্রত্যেকটির অনুশাসনের মূলেই রয়েছে বিজ্ঞান এবং স্বাস্থ্য সদাচার বিধি।
ধর্ম একটি বিমূর্ত বিষয়, এ বিমূর্ত বিষয়টি সদাচারের মধ্যে দিয়ে ব্যক্তি, পরিবার, সমাজ এবং রাষ্ট্রে দৃশ্যমান হয়। তাই সদাচার ধর্মের একটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয় মূর্তিমান স্বরূপ। এর মাধ্যমেই জীবনকে জয় করে শতবছর সুস্থ নীরোগ হয়ে বেঁচে থাকা যায়। সদাচারের প্রবাহ না থাকায় বর্তমানকালে আমাদের দেহ-মন দুটোই জরাজীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এ জরাজীর্ণতা সংস্কার করা অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। জরাজীর্ণ বাসভবনে যেমন সুখী হয়ে বাস করা যায় না। বাসভবন সংস্কার করে বসবাস উপযোগী করে নিতে হয়, তদ্রূপ জরাজীর্ণ দেহ ও মনে সদাচারী হওয়াটাও সম্ভব নহে। এর জন্যে প্রয়োজন ব্যক্তির আত্মবোধের সক্রিয়তা, তবেই আবার শাস্ত্রে বর্ণিত প্রাচীন সদাচারের ধারায় প্রবেশ করতে পারবে। সময়ের প্রভাবে হয়ত, আমাদের শাস্ত্রে বর্ণিত সকল সদাচার পূর্বের মত সম্পূর্ণ পালন করা বর্তমানকালে হয়ত কারো পক্ষেই সম্ভব নয়। কিন্তু আমরা প্রচেষ্টা করতে পারি, সম্পূর্ণ সদাচার বিধি পালন করতে না পারলেও অধিকাংশই পালন করা সম্ভব। এর জন্যে প্রয়োজন ইচ্ছা, একাগ্রতা ঈশ্বরে নিষ্ঠা।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁