ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

রামায়ণের সীতার কাহিনীর মত, আজও চলছে সমাজে অপবাদ রটনা।


রামায়ণের সীতার কাহিনীর মত,  আজও চলছে সমাজে অপবাদ রটনা

মানুষের জীবনের বিন্দুগুলো একটু একটু করে পথ চলে, একটি বৃত্ত পূর্ণ করে সেই বৃত্তকে পিছনে ফেলে বিন্দুগুলো অন্য একটি নতুন বৃত্তের সন্ধানে বেড়িয়ে পড়ে। এভাবেই প্রত্যেকটি জীবনে আমৃত্যু চলে বিন্দু এবং বৃত্তের অভিযাত্রা।

সীতাকে তমসা নদীর তীরে বাল্মিকী আশ্রমে মহর্ষি বাল্মিকীর তত্ত্বাবধানে রেখে লক্ষ্মণ অযোধ্যায় ফিরে আসলো। তিনি দেখলে শ্রীরামচন্দ্র অত্যন্ত বিষন্ন ভগ্নহৃদয়ে একটি সিংহাসনে বসে আছেন। তাঁর দুইচোখ অশ্রুসিক্ত হয়ে আছে। লক্ষ্মণ তখন শ্রীরামের কাছে এসে তাঁর দু'পা জড়িয়ে ধরে তাঁকে সান্ত্বনা দিলেন। লক্ষ্মণ বললেন, হে মহারাজ আপনি সিংহের মত আপনার বিক্রম। তাই আপনার শোক বিহ্বল হওয়া মানায় না। কালের গতি এমনই। এর পরে লক্ষ্মণ খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি অত্যন্ত দার্শনিক কথা বলেন। সেই কথাগুলোর মূলভাব হলো - এ সংসারে যত সঞ্চিত বস্তু আছে, সেই সকল বস্তুরই পরিণাম আছে এবং বিনাশ আছে। জগতে উত্থানের দীর্ঘস্থায়ী নয়। তাই উত্থানের পরেই পতন হত। প্রিয় ব্যক্তি বা বস্তুর সংযোগের পরেই, প্রাপ্তির পরে বিচ্ছেদ হয়। জীবন এবং মৃত্যু এ দু'টি বিষয় ধ্রুব সত্য।চক্রাকারে একে অন্যের আশেপাশে ঘুরে বেড়ায়।জীবনের অন্তেই মৃত্যু এবং মৃত্যুর অন্তেই জীবন অথবা কদাচিৎ মুক্তি। এভাবেই মানুষের জীবনে জন্মমৃত্যু খেলা করে বেড়ায়। জগতের সকল কিছুই অনিত্য এবং ক্ষণিকের। তাই স্ত্রী, পুত্র, বন্ধুবান্ধব এবং ধনসম্পত্তির প্রতি আসক্তি থাকা উচিত নয়। বিশেষ আসক্তি রাখা উচিত নয়। কারণ প্রাপ্তি যেখানে থাকে, সেখানে বিয়োগ নিশ্চিত। আসক্তি থেকেই মনুষ্যের বন্ধন হয়। সেই বন্ধন সকলেই অতিক্রম করতে পারে না। তখন সে জন্ম-মৃত্যু পাশে আবদ্ধ হয়ে চক্রাকারে ঘুরতে থাকে নিজ আত্মার মধ্যেই আত্মাকে জয় করা যায় এবং মন দ্বারাই মনকে জয় করা যায়। আত্মাকে জয় করা গেলে সম্পূর্ণ জগৎকেও চাইলে জয় করা যায়। 



তত্র তাং শুভাচারামাশ্রমান্তে যশস্বিনীম্।
পুনরপ্যাগতো বীর পাদমূলমুপাসিতুম্ ৷৷
মা শুচঃ পুরুষব্যাঘ্র কালস্য গতিরীদৃশী।
ত্বদ্বিধা নহি শোচন্তি বুদ্ধিমন্তো মনস্বিনঃ৷৷
সর্বে ক্ষয়ান্তা নিচয়াঃ পতনাস্তাঃ সমুচ্ছ্ৰয়াঃ।
সংযোগা বিপ্রয়োগান্তা মরণান্তং চ জীবিতম্॥
তস্মাৎ পুত্রেষু দারেষু মিত্রেষু চ ধনেষু চ।
নাতিপ্রসঙ্গঃ কর্তব্যো বিপ্রয়োগো হি তৈর্ধ্রুবম্।।
শক্তস্ত্বমাত্মনাঽহম্মানং বিনেতুং মনসা মনঃ।
লোকান্ সর্বাংশ্চ কাকুস্থ কিং পুনঃ শোকমাত্মনঃ৷৷
নেদৃশেষ বিমুহ্যন্তি ত্বদ্বিধাঃ পুরুষর্ষভাঃ।
অপবাদঃ সকিল তে পুনরেষ্যতি রাঘব।।
যদর্থং মৈথিলী ত্যক্তা অপবাদভয়ান্নৃপ।
সোহপবাদঃ পুরে রাজন্ ভবিষ্যতি ন সংশয়ঃ ॥
(রামায়ণ : উত্তরকাণ্ড, ৫২.৯-১৫)

"আপনার আদেশ শিরোধার্য করে আমি সেই শুভ আচরণসম্পন্না, যশস্বিনী জনক তনয়া সীতাদেবীকে গঙ্গাতটে মহর্ষি বাল্মীকির আশ্রমের নিকট নির্দিষ্ট স্থানে রেখে দিয়ে আপনার শ্রীচরণের সেবায় ফিরে এসেছি।

হে পুরুষসিংহ ! আপনি শোক করবেন না। কালের গতি এমনই। আপনার মতো বুদ্ধিমান ও মনস্বী ব্যক্তি শোক করেন না।সংসারে যত সঞ্চিত বস্তু আছে, তার সবকিছুর পরিণাম বিনাশ, উত্থানের অন্ত পতন, সংযোগের অন্ত বিয়োগ এবং জীবনের অন্ত হল মৃত্যু। সুতরাং স্ত্রী, পুত্র, মিত্র ও ধনে বিশেষ আসক্তি রাখা উচিত নয়। কারণ সেসব থেকে বিয়োগ হওয়া নিশ্চিত। 

হে কাকুৎস্থ বংশের রত্ন শ্রীরামচন্দ্র! আপনি আত্মার দ্বারা আত্মাকে, মন দ্বারা মনকে এবং সম্পূর্ণ জগৎকেও সংযত রাখতে সক্ষম ; তাহলে নিজ-শোক বশে রাখা আপনার পক্ষে এমন কি বড় কথা ? 

আপনার মতো শ্রেষ্ঠ পুরুষ এরূপ পরিস্থিতিতে চিত্তে মোহগ্রস্ত হন না। রঘুনন্দন ! আপনি যদি দুঃখিত থাকেন, তাহলে এই অপবাদ আপনার ওপর আবার ফিরে আসবে। হে মহারাজ রামচন্দ্র! আপনাকে মনে রাখতে হবে, আপনি রাজধর্ম রক্ষার্থে অপবাদের ভয়ে মৈথিলী সীতাকে ত্যাগ করে বনবাস দিয়েছেন। কিন্তু সীতাকে পরিত্যাগ করে আপনি যদি এভাবে সর্বদা দুঃখিত থাকেন, তবে সেই পুরাতন অপবাদ আবার নগরে চর্চা শুরু হবে।"

রাজধর্ম অত্যন্ত কঠিন। এই রাজধর্মের জন্যে শ্রীরামচন্দ্রকে তাঁর প্রাণপ্রিয় সীতাকে বনবাসে দিতে হয়েছে। সীতাকে বনবাসে দিয়ে একদণ্ডের জন্যে তাঁকে ভুলতে পারেননি শ্রীরামচন্দ্র। মিথ্যা অপবাদ এমন একটি নির্মম বিষয়, এ নিয়ে যতই আলোচনা করা হয় সে ততই দাবানলের মতই বেড়ে যায়। সাধারণ মানুষ বোধ-বিবেক না ব্যবহার করে বিচার না করেই মিথ্যা অপবাদের আগুন জ্বলতে সহায়তা করে। তখন সুযোগ সন্ধানীরা বলে, "যা দেশে রটে, তার কিছুটা তো বটে"। এভাবেই মিথ্যা এবং মিথ্যা অপবাদ গ্রাস করে সমাজকে। এই মিথ্যা অপবাদের থেকে শ্রীরামচন্দ্র এবং নিষ্কলুষ সীতা দেবীও রক্ষা পায়নি। আজও মানুষ ঈর্ষার বশিভূত হয়ে মহৎপ্রাণ মানুষদের বিভিন্ন অপবাদ দিয়ে লাঞ্ছিত করে। এই লাঞ্ছনার কারণে অনেক মমহৎপ্রাণ ব্যক্তিই সমাজের কল্যাণে কাজ করতে গিয়ে, পরবর্তীতে সমাজের অকৃতজ্ঞতায় নিজেকে গুটিয়ে নিয়েছেন। মানুষের যেন একটি জন্মগত স্বভাব, কারো ব্যক্তিগত জীবন বিশেষ করে সামাজিকভাবে প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তিদের জীবন নিয়ে আলোচনা করা। আমরা কেউ এক স্থানে বসলেই শুরু করে দেই, আশেপাশের অনুপস্থিত মানুষদের জীবন নিয়ে পরনিন্দা এবং পরচর্চা। অনেক ব্যক্তি আছে, যারা প্রতিদিন সময় করে যদি পরনিন্দা এবং পরচর্চা না করে তবে তাদের পেটের খাবার ঠিকঠাক হজম হয় না। সেই মানুষেরা রাম-সীতার সময়েও যেমন ছিলো, তেমনি বর্তমানেও আছে। বর্তমানের পরনিন্দা, পরচর্চা করা ব্যক্তিরা অনেক বেশি দক্ষ। আধুনিকতার মুখোশে তাদের মুখগুলো ঢাকা। তবে মিথ্যা অপবাদ মিথ্যাই থাকে। মানুষ একিদিন না একদিন সত্যকে জানতে পারে। তখন মিথ্যা আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হয়।

তাই ভাই লক্ষ্মণ শ্রীরামচন্দ্রকে সতর্ক করে বলেছেন, রাজ্যের মানুষের সীতার নামে অপবাদের লোকশ্রুতি শুনে রাজধর্মের প্রয়োজনে যখন সীতাকে বনবাসে দেয়া হয়েছে। তাই বিষয়টি নিয়ে শ্রীরামচন্দ্রের দুঃখে বিহ্বল থাকা উচিত নয়। কিন্তু মনে রাখতে হবে, মৈথিলী সীতাকে ত্যাগ করে শ্রীরামচন্দ্র যদি সর্বদা দুঃখিত থাকেন, তবে সেই পুরাতন অপবাদের চর্চা নগরে আবার শুরু হবে মিথ্যা অপবাদে মানসিকভাবে ভেঙে পড়লে, তবে পুরাতন মিথ্যা অপবাদ চর্চার মাধ্যমে সমাজে আবার নতুন করে উজ্জীবিত হয়ে যায়। তাই দৃঢ় হৃদয়ে স্থিরচিত্তে শোক বিহ্বল না হয়ে, যথাসম্ভব কর্তব্য কর্ম পালন করে যাওয়া উচিত। 

সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁