ইদানীং আমরা অনেকে ধর্ম বলতে বাহ্যিক আচরণকেই বুঝি। তাই যতটা ধর্ম পালন করছি, এরথেকে মানুষকে দেখানোর প্রচেষ্টাই বেশী। অবশ্য কিছুটা দেখানোরও প্রয়োজন আছে সমাজে, এতে লোকশিক্ষা হয়। কিন্তু অতিরিক্ত দেখানোপনাতে ধর্মের হানি ঘটে। ধর্ম করতে যেয়ে অনেকের চিন্তাশূন্য ধর্মরোগে পেয়ে যাচ্ছে। আবার অনেকে মানুষকেই দেখা যায়, ধর্মের নামে অযৌক্তিক শুচিবায়ু পেয়ে বসে। ছোঁয়া যাবে না, ধরা যাবে না, খাওয়া যাবে না -এ কুসংস্কারগুলি সমাজ থেকে চলেই গিয়েছিলো। কিন্তু চলে যাওয়া কুসংস্কারগুলিই ইদানিং আবার নতুন করে চালু হচ্ছে সমাজে। এটা ভাববার বিষয়।ধর্মপালনের নামে বর্তমানে অনেকেকেই দেখা যায় যে, বিভিন্ন অজুহাত দিয়ে তারা জন্মদাত্রী মায়ের হাতের রান্না খায় না। কারণ, মা তাদের ভাষায় সাত্ত্বিক আহার করেন না। এদের অনেকেই সাত্ত্বিক আহারের নামে রান্না করা খাবার দূরে থাক; কারো কেটে দেয়া ফলমূলও খেতে চান না; বিষয়টি অনেক ক্ষেত্রেই বাড়াবাড়ি এবং দৃষ্টিকটু পর্যায়ে চলে যায়। আবার অনেকেই বিভিন্ন কুসংস্কারাচ্ছন্ন যুক্তিবোধহীন হয়ে দেবদেবী পূজার প্রসাদ গ্রহণ করেন না। বিষয়টি অত্যন্ত পরিতাপের এবং আপত্তিকর।
সনাতন ধর্ম সৃষ্টির শুরু থেকেই যুগযুগান্তর টিকে আছে কারণ এরমধ্যে একটা শাশ্বত সত্ত্বা আছে। কোন ব্যক্তি এ ধর্ম প্রবর্তন করেনি। এ ধর্ম কোন ব্যক্তি কেন্দ্রিক মত না, যে সেই প্রবর্তক ব্যক্তিকে মুছে দিলে ধর্মের কোন অস্তিত্ব থাকবে না। যুগযুগান্তর এ ধর্মটি পাড়ি দিয়েছে, কারণ সর্বদাই এ ধর্মের মধ্যে একটি আধুনিকতা ছিলো এবং সেই ধারাবাহিকতা আজও আছে। যুগের প্রয়োজনে নিজেকে মানিয়ে নেয়া, যুগোপযোগী তৈরি করে নেয়াই সনাতন সমাজের অন্যতম শক্তি। পৃথিবী থেকে খৃস্টপূর্বকালের বহু ধর্ম হারিয়ে গেছে। শুধু হিমালয়ের মত মাথা উঁচু করে স্বমহিমায় আছে সনাতন ধর্ম। যুগযুগান্তের কালখণ্ডে সমুদ্রের বুদবুদের মত কত মতপথ তৈরি হয়েছে, আবার তা সনাতন মহাসমুদ্রে এমনিতেই বিলীয়মান হয়ে গেছে।
জগতের ইতিহাস সাক্ষী, যে মতপথ যত বেশী কঠোর, সে মতপথ সাময়িক তীব্র উত্তেজনা তৈরি করে তত-দ্রুতই জগত থেকে হারিয়ে গিয়েছে।
বিষয়টিকে উদাহরণ দিয়ে বলা যায়, আমাকে যদি বলা হয়, প্রথমে আমার বসতি এলাকা থেকে বের না হতে; এরপরে দ্বিতীয়তে আমার ঘর থেকে বের না হতে; তৃতীয়ত আমার বেডরুম থেকে বের না হতে। এ তিনটি আদেশের মধ্যে কোন আদেশটি সবার আগে আমি অমান্য করব বলতে পারেন? যে আদেশটি সর্বোচ্চ কঠিন। অর্থাৎ আমার বেডরুম থেকে বের হওয়ার আদেশটি সবার আগে দ্রুতই আমি অমান্য করব। কারণ তিনটি আদেশের মধ্যে এটিই সবথেকে কঠিন। তাই আদেশ দেয়ার সময়ে এমনভাবে দিতে হয়, যাতে তা সহনীয় মাত্রায় হয়; তবেই মানুষ তা পালন করে। জগতে যারা যতবেশি আইনকানুন চাপিয়ে দিতে নিষ্ঠুয় হয়েছে মানুষ তত দ্রুতই তাদের নিষ্ঠুরতার বেড়াজাল ভেঙে দিয়েছে। হয়ত এ কারণেই বাঙালির একটা প্রবাদ আছে, "বজ্র আঁটুনি ফস্কা গিরো"। প্রবাদবাক্যটি খুবই গভীর তাৎপর্যপূর্ণ। কোন কিছুকে যত বেশি বজ্র আঁটুনি নিয়ে কেউ বাঁধতে চেষ্টা করে; দিনশেষে দেখা যায় সেই বজ্র আঁটুনি তত দ্রুতই ঢিলা হয়ে ফস্কে যায়। সমাজ সংসারের নিয়মের বন্ধনকে তাই বেশি কঠোর করতে নেই। যতটা সম্ভব মানবিকতার দৃষ্টিতে পরিচালিত করা প্রয়োজন। তবেই সকলের কল্যাণ হয়ে নিয়মটি সার্বজনীন হয়।
বেদের পরে বিভিন্ন ঋষিদের লিখিত মনুসংহিতা, যাজ্ঞবল্ক্য সংহিতা, পরাশর সংহিতা, হারীত সংহিতা, ব্যাস সংহিতা ইত্যাদি স্মৃতিশাস্ত্রের বিধানগুলো আমাদের জন্যে খুবই গুরুত্বপূর্ণ।
বর্তমানের জন্যে প্রয়োজনীয় বিভিন্ন বিধান স্মৃতিশাস্ত্রে আজও আমরা পাই। মানব জীবনের প্রত্যেকটি বিষয়ে স্মৃতিগুলিতে আলোচিত হয়েছে। বর্তমানের জন্যে প্রযোজ্য হলেও স্মৃতিগুলি হল সে প্রাচীনযুগের আইনশাস্ত্র। এর দুইএকটা নির্দেশ হয়ত আমার বর্তমান একবিংশ শতাব্দীর বাস্তবতায় পছন্দসই নাও হতে পারে। এই একটি দুটি শ্লোককে রেফারেন্স টেনে আমরা স্মৃতিগ্রন্থগুলির হাজার হাজার শ্লোককে অবুঝের মত ফেলে দিতে চাই। সর্বোপরি জগতের সকল দেশের, সকল কালের আইনেই কিছু নেতিবাচক দিক থাকে, কিছুসময় অতিবাহিত হলে মানুষ তা উপলব্ধি করতে পারে। আবার অনেক সময় রাষ্ট্রীয়ভাবে রাজশক্তি তাদের ক্ষমতার স্বার্থে অনেক নিয়মকানুন চাপিয়েও দেয়। দুইচারটি নেতিবাচক দিককে উপলব্ধি করে আমরা বর্তমানকালের সম্পূর্ণ আইনশাস্ত্রকে ফেলে দেই না। আমরা আইনকে প্রয়োজনীয় যুগোপযোগী করে সংশোধন করে নেই। হাজার হাজার বছর পূর্বের স্মৃতির আইনগুলো সম্পর্কেও মোটাদাগে কথাগুলো প্রযোজ্য।
এ স্মৃতির গ্রন্থগুলোর মধ্যে ব্যাসদেবের পিতা পরাশর ঋষির লেখা পরাশর সংহিতা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। অনেক আধুনিক বাস্তবসম্মত নির্দেশনা পাওয়া যায় এ স্মৃতিতে। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের জীবনেও দেখা যায়, তিনিও বিধবাবিবাহের পক্ষে অনেক শাস্ত্রীয় যুক্তি এ স্মৃতিটি থেকে নিয়েছেন। দেশবিভাজনে, আপৎকালীন অবস্থায়, মহামারী অবস্থাতে আমাদের ধর্মীয় করণীয় সম্পর্কে অসাধারণ নির্দেশনা দিয়েছেন পরাশর মুনি। তিনি বারবার বলেছেন, বিপদকালীন সময়ে আগে নিজে দেহকে রক্ষা করতে হবে, নিজের দীনাত্মাকে উদ্ধার করতে হবে। বিপদ চলে গেলে, আগে নিজে সম্পূর্ণ সুস্থ হয়ে তবেই ধর্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হবে। এর থেকে আধুনিক কথা হতে পারে না। কথাগুলো দেশকালপাত্র ভেদে সকল যুগের জন্য, সকল মানবের জন্য প্রযোজ্য।
দেশভঙ্গে,প্রবাসে বা ব্যাধিষু ব্যাসনেষ্বপি।
রক্ষেদেব স্বদেহাদি পশ্চার্দ্ধর্ম্মং সমাচরেৎ।।
যেন কেন চ ধর্ম্মেণ মৃদুনা দারুণেন চ।
উদ্ধরেদ্দীনমাত্মাং সমর্থো ধর্মমাচরেৎ।।
আপৎকালে তু সম্প্রাপ্তে শৌচাচারং ন চিন্তয়েৎ।
স্বয়ং সমুদ্ধরেৎ পশ্চাৎ স্বস্থো ধর্ম্মং সমাচরেৎ।।
(পরাশর সংহিতা:৭ অধ্যায়,৪১-৪৩)
"দেশভঙ্গে, প্রবাসে, বিপদের সময়, শরীর পীড়াক্রান্ত হলে, তখন যেকোন উপায়ে আগে নিজের দেহকে রক্ষা করতে হবে । এরপরে সুস্থ হয়ে সকল ধর্মাচরণ করবে। স্বয়ং বিপন্ন হলে, অল্প কিংবা কঠিন, যে কোন উপায়ে আগে নিজের দীনাত্মাকে উদ্ধার করবে, তৎপরে সমর্থ হয়ে ধর্মাচরণ করবে। বিপদের সময়ে ধর্মানুমোদিত শৌচাচার কিছুই চিন্তা করবে না। তখন যে কোন উপায়ে আপনাকে উদ্ধার করবে; বিপদ চলে গেলে স্বয়ং সুস্থ হয়ে ধর্মানুষ্ঠানে প্রবৃত্ত হবে।"
ধর্মরক্ষার্থে আমি জানি না কতজন সাধুসন্ত বা সাধারণ হিন্দু জীবন দিয়েছেন।সুস্পষ্ট আত্মরক্ষার নির্দেশ থাকার পরেও যুগের বা সময়ের আয়নাতে না তাকিয়ে অন্ধভাবে ধর্ম পালন করতে যেয়ে কত মানুষের জীবন হারাতে হয়েছে এটা ইতিহাস সাক্ষী। ১৯৭১ সালে এমন অনেক ঘটনা দেখি যে, পাকিস্তানি হানাদারদের নৃশংসতার ভয়ে সাধারণ মানুষ সবাই যখন যারযার মত নিরাপদ আশ্রয়ে। তখন কিছু সাধুসন্ত মন্দিরে বসে অখণ্ড হরিনাম কীর্তন করছে। এমনি একটি নির্মম ঘটনা ১৯৭১ সালে ফরিদপুর জগদ্বন্ধু সুন্দরের শ্রীঅঙ্গন মন্দিরে ঘটে। এপ্রিল মাসের মাঝামাঝি পদ্মার গোয়ালন্দ ঘাট হয়ে ফরিদপুরে শহরে প্রবেশ করে হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী। ফরিদপুর শহরটি তখন ছিলো অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হিন্দু সম্প্রদায় অধ্যুষিত। অভিজাত হিন্দু সম্প্রদায়ের ধনসম্পত্তি লুট করার জন্যে পাকিস্তানি বাহিনীকে সাহায্য সহযোগিতা করতে দেশদ্রোহী রাজাকার বাহিনী অত্যন্ত উৎসাহী হয়ে উঠে। এ রাজাকার বাহিনী পাকিস্তানি হানাদারদের ফরিদপুরে স্বাগত জানিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের সম্পত্তিতে দখল করে সেনাক্যাম্প তৈরি করে। এই মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চিহ্নিত রাজাকারেরা পাকিস্তানি বাহিনীর ক্যাম্পের সাথে সাথে, তারা রাজাকার ক্যাম্প তৈরি করে। ফরিদপুর শহরে পাকিস্তানি বাহিনী প্রবেশ করেছে, এ সংবাদে মহানাম সম্প্রদায়ের তৎকালীন প্রধান ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী মঠের অন্যান্য সাধুদের নিয়ে শ্রীঅঙ্গন থেকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যান। শ্রীঅঙ্গনে শুধু রয়ে যায় নয়জন সন্ন্যাসী।
মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক নির্মম গণহত্যাটি সংগঠিত হয় ১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিল।সেদিন খুব সকালে গোয়ালন্দ ঘাট হয়ে রাজবাড়ী রাস্তার মোড়ে অবস্থান নেয় হানাদার পাকিস্তানি বাহিনী। সেখান থেকেই শহরের দিকে গোলাবারুদ নিক্ষেপ করতে থাকে একের পর এক। যেহেতু হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরে পাকিস্তান বাহিনীর আক্রোশ ছিলো সবচেয়ে বেশি। তাই ফরিদপুর শহরে প্রবেশ করে সন্ধ্যার দিকে প্রথমেই তারা গোয়ালচামট শ্রীঅঙ্গন মন্দিরে নৃশংস আক্রমণ করে। শ্রীঅঙ্গন মন্দিরে অখণ্ড হরিনাম সংকীর্তন হচ্ছে। সে সময়ে আশ্রমে অবস্থিত নয়জন সন্ন্যাসী সকলেই হরিনাম কীর্তন করছিলেন। সন্ন্যাসীরা মনে করেছিলো কীর্তনরত অবস্থায় পাকিস্তানি বাহিনী তাদের কোন ক্ষতি করবে না। কিন্তু শান্তিপ্রিয় সর্বস্ব ত্যাগী সন্ন্যাসীদের সকল ধারণাকে নস্যাৎ করে দিয়ে অসভ্য পাকিস্তানি বাহিনী কীর্তনরত আটজন সন্ন্যাসীকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এদের মধ্যে হরিপ্রিয় ব্রহ্মচারী সিঁড়ি কোঠার আড়ালে লুকিয়ে এবং জঙ্গলের আড়ালে গিয়ে নিজের জীবনকে রক্ষা করে। কিন্তু হরিপ্রিয় ব্রহ্মচারীকে সচক্ষে দেখতে হয় মঠের অন্য আট সন্ন্যাসীর পাকিস্তানি বাহিনী কর্তৃক ব্রাশফায়ার করে নির্মম হত্যা। এ অষ্ট সন্ন্যাসী হলেন মুক্তিযুদ্ধে ফরিদপুরের প্রথম শহীদ। দেশের জন্যে আত্মাহুতি দানকারী শ্রীঅঙ্গনের সন্ন্যাসীরা হলেন, কীর্তনব্রত ব্রহ্মচারী, নিদানবন্ধু ব্রহ্মচারী, অন্ধকানাই ব্রহ্মচারী, বন্ধুদাস ব্রহ্মচারী, ক্ষিতিবন্ধু ব্রহ্মচারী, গৌঢ়বন্ধু ব্রহ্মচারী, চিরবন্ধু ব্রহ্মচারী ও রবিবন্ধু ব্রহ্মচারী। পাকিস্তানি এবং রাজাকার বাহিনীর নৃশংসতার স্মৃতি হিসেবে শ্রীঅঙ্গন মন্দিরের চালতা তলার অষ্ট সন্ন্যাসীর স্মৃতিস্তম্ভ দাঁড়িয়ে আছে।
১৯৭১ সালের ২১ এপ্রিলের গণহত্যায় বেঁচে যাওয়া একমাত্র সন্ন্যাসী হরিপ্রিয় ব্রহ্মচারী প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে বিভিন্ন সময়ে স্মৃতিচারণ করেছেন সেদিনের ঘটনার। নিত্যদিনের মতো নামকীর্তন করছিলেন হরিপ্রিয় ব্রহ্মচারী সহ নয়জন সাধু। সন্ধ্যা হতেই হঠাৎ হামলা, কামান আর গোলাগুলির শব্দ।কিন্তু এরপরও কেউ কীর্তন বন্ধ করেনি এক মুহূর্তের জন্য। কয়েকজন বাঙালি রাজাকার সহ পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী প্রবেশ করলো মন্দিরে।মন্দিরে প্রবেশ করে তারা কীর্তনরত সাধুদের সামনে চলে যায়। অন্য সাধুরা পলায়ন না করে নির্ভীক মনোভাব নিয়ে কীর্তন করে চলছিলেন। হরিপ্রিয় ব্রহ্মচারী কিছুক্ষণ পরে কি ঘটতে চলছে, এটি উপলব্ধি করে সিঁড়ি কোঠার থামের আড়ালে লুকিয়ে পরেন। এরপরে তিনি পেছনমুখো হয়ে পা টিপে টিপে মন্দির থেকে বের হয়ে ব্রাউনিয়া ফুলগাছের জঙ্গলে লুকিয়ে থাকেন। তাঁর চোখের সামনেই লাইন ধরে দাঁড় করিয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী হত্যা করলো কীর্তনরত আটজন ভক্তকে। ঘটনার আকস্মিকতা এবং বিভৎসতায় তিনি ভয়ে কাঁপছিলেন। কিন্তু প্রাণের ভয়ে তিনি নিঃশব্দে রইলেন, যেন তাঁর উপস্থিতি কেউ টের না পায়। একে একে ব্রাশফায়ার করে পাকিস্তানি বাহিনী অষ্ট নিরপরাধ সন্ন্যাসীকে হত্যা করে তাদের নিথর দেহগুলো টেনে নিয়ে মন্দিরের সংলগ্ন চালতা তলায় ফেলে দেয়। রক্তে ভেসে গেলো মন্দির সহ চালতা তলা। এরপরে শুরু হয় রাজাকার বাহিনীর নেতৃত্বে আশ্রমের ধনসম্পদ লুট।
১৯৭১ সালের এ ঘটনাটি পৃথিবীর ইতিহাসে একটি কলঙ্কিত ঘটনা। ঘটনাটি থেকে আমরা বেশ কয়েকটি বিষয়ে শিক্ষা নিতে পারি। শান্তিপ্রিয় সন্ন্যাসীদের বিশ্বাস ছিল দুটি, প্রথমত পাকিস্তানি সেনারা অকারণ নিরস্ত্র নিরহ সাধুদের কিছুই করবে না; আর কিছু হলে ভগবান হরি এসে রক্ষা করবে। কিন্তু তাদের এ দুটো বিশ্বাসকে মিথ্যা প্রমাণিত করে সাধুরা নির্মমভাবে পাকিস্তানি সেনাদের গুলিতে নিহত হন। এর প্রথম কারণটি পাকিস্তানিদের অসভ্যতা নিয়ে কিছুই বলতে চাইনা, তারা যে জাতিগতভাবে অসভ্য বর্বর এটা পৃথিবীব্যাপী স্বীকৃত। পরাশর স্মৃতির এ বচন সহ শাস্ত্রের অসংখ্য স্থানে বিপদেআপদে সর্বপ্রথমে আত্মরক্ষার বিধান দেয়া আছে, তাকে বলা হয় আপদধর্ম। আপদধর্মে ধর্মের রূপ পরিবর্তিত হয়। জীবন রক্ষাই তখন প্রধান ধর্ম হয়ে উঠে। নিরহ সাধুরা কিন্তু শাস্ত্রের এ বিধানটি মানেননি। তাদের মনে বা বিবেকে যেটা সায় দিয়েছে তাই করেছেন। ঠিক বেঠিক আজ আমরা বিচার করছি। কিন্তু তাদের বিশ্বাসের কাছে তারাই সঠিক ছিলেন। হরিনামের অবশ্যই প্রয়োজন আছে। কিন্তু কর্ম না করে যদি সারাদিন হরিনাম জপ করলেই সকল কিছুই হত, তবে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধই হতো না। ভগবান শ্রীকৃষ্ণ অর্জুনকে যুদ্ধ করতে নিষেধ করে, হাতে জপমালা দিয়ে শুধু হরিনাম জপ করতে বলতেন। হরিনামের যেমন প্রয়োজন আছে, তেমনি কর্মের প্রয়োজন আছে, তেমনি আপদধর্মেরও অত্যন্ত প্রয়োজনীয়তা রয়েছে।জগতে কোন কিছুই হিতাহিতজ্ঞানশূন্য হয়ে করতে নেই।ভগবান প্রত্যেকটি জীবের একমাত্র কর্মফল দাতা। যার যেমনটি কর্মপ্রচেষ্টা, ভগবান তাকে সেভাবেই দয়া করেন। কিন্তু আপদকালীন সময়ে, সর্বপ্রথম নিজেকে রক্ষা করাই ধর্ম। এ বিষয়টি আমাদের সর্বাগ্রে এবং সর্বদা মনে রাখা প্রয়োজন। তবে এক্ষেত্রে একটি প্রশ্ন রয়ে যায় যে, মন্দির সহ সাধারণ মানুষের উপরে আক্রমণ করা হলে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই দেখা যায়, কেউ সে আক্রমণ প্রতিরোধ না করে দৌড়ে পালিয়ে যায়। শত্রু ভয়ংকর হলে, সর্বপ্রথমে যেহেতু নিজেকে রক্ষা করাই ধর্ম, সে দৃষ্টিতে পালিয়ে যাওয়াটা বৈধ। কিন্তু সনাতন শাস্ত্র তা বলে না। শাস্ত্র বলে শত্রুকে সকল শক্তি দিয়ে যথাসম্ভব প্রতিরোধ করতে হবে। তবে শত্রু যদি অত্যন্ত শক্তিশালী হয়, তবে সাময়িক বিরতি নিয়ে সুযোগের অপেক্ষা করতে হবে,শত্রুকে সম্পূর্ণভাবে বিনাশের।মহাভারতের আদিপর্বে একটি কলসীর উদাহরণ দিয়ে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে।যতদিন শত্রুকে প্রতিরোধের অনুকূল পরিবেশ না আসে ততদিন পর্যন্ত শত্রুকে সহ্য করবে অথবা শত্রু থেকে পলায়ন করে দূরে থাকবে। কিন্তু পরবর্তীতে যখন শত্রুকে প্রতিরোধের অনুকূল পরিবেশ সামনে আসবে, তখন শত্রুকে কলসীর মত ছুড়ে ফেলে দিয়ে সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত করে দিতে হবে।
বহেদমিত্রং স্কন্ধেন যাবৎ কালস্য পর্যয়ঃ।
ততঃ প্রত্যাগতে কালে ভিদ্যাদঘটমিবাশ্মনঃ।।
(মহাভারত :আদিপর্ব, ১৩৫.২১)
"যতদিন পর্যন্ত কালের পরিবর্তন না হয়,ততদিন পর্যন্ত কাঁধে করে শত্রুকে বহন করবে। পরবর্তীতে যখন অনুকূল পরিবেশ আসবে, তখন পাথরের উপর কলসীকে ছুড়ে ফেলে দিলে যেমন কলসী ভেঙে চুরমার হয়ে যায় ; তেমনিভাবে শত্রুকেও বিধ্বস্ত করবে।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।