সাধন জগতে আমরা সামান্যতেই অধৈর্য হয়ে যাই।সকল কিছুতেই আমাদের সময় আছে, ধৈর্য্য আছে, শুধু ঈশ্বরের শরণ নিতে আমাদের সময় নেই। অজুহাতের অন্ত নেই। বহু জন্মজন্মান্তরে ফলে আমাদের মনুষ্য জন্ম। এই জন্মে যদি সাধনার কৃষি যথাযথ সময়ে না করতে পারি, তবে সেই মুক্তিরূপ ধান উৎপন্ন হবে কি করে? এমন মানব শরীর পেয়েও আমরা যদি দৈবী পথে অগ্রসর না হতে পারি, তবে পরবর্তীতে আমাদের আরও আত্মার আরও নিন্ম গতি হবে। সে ধীরেধীরে অন্ধকার থেকে গহীন অন্ধারে তলিয়ে যেতে থাকবে।
এ বিষয়টি অষ্টাদশ শতাব্দীর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সমসাময়িক রামপ্রসাদ সেনের লেখা গানে অত্যন্ত মর্মস্পর্শী ভাষায় পাওয়া যায়। তিনি এই দুর্লভ মানব জীবনে মুক্তির ফসল ফলাতে বলেছেন। সেই ফসল যেন কেউ নষ্ট করতে না পারে, তছরুপ করতে না পারে; তাই তিনি সেই ফসলের মাঠিকে কালী নামের বেড়া দিয়ে ঘেরাও করে দিতে বলেছেন। কালী নামের বেড়াই সকল বাধাবিপত্তি আগলে রাখবে। এই কালী নামের বেড়াকে যমরাজ স্পর্শ করে না। দক্ষিণ দিক যমের দিক। সেই দক্ষিণমুখি হয়ে কালী সর্বদা বিরাজিতা।দেবীর সেই দৃষ্টিতে যমরাজও ভয়ে তটস্থ। তাই তাঁর নাম দক্ষিণা কালী। যে দেবীর শরণে থাকে যমরাজ তাকে অকালে গ্রাস করেন না। তবে জন্যে মুক্তিকেশি দেবীর নামের বেড়াটি শক্ত করে দিতে হবে। হতাশ হলে চলবে না। দেবীর কৃপায় সকলেই মুক্ত হতে হয়, এ জন্মে অথবা আগামী কোন জন্মে।তীব্র বিশ্বাস এবং বুকভরা এক প্রচণ্ড আকুতি থাকতে হবে মুক্তিকেশি দেবীর প্রতি। তবেই জীবের মুক্তির শস্যক্ষেতে দেবীর কৃপাকটাক্ষ পরে জীব মুক্ত হবে।
"মন রে কৃষি কাজ জান না।
এমন মানব-জমিন রইলো পতিত,
আবাদ করলে ফলতো সোনা।।
কালীর নামে দেও রে বেড়া,
ফসলে তছরুপ হবে না।
সে যে মুক্তকেশীর (মন রে আমার) শক্ত বেড়া,
তার কাছেতে যম ঘেঁসে না।।
অদ্য অব্দ-শতান্তে বা বাজেয়াপ্ত হবে জান না।"
আত্মবোধে সদা জাগ্রত থাকাটাই মুক্তির লক্ষণ। এ পথে অধিকারী হয়ে জাগ্রত হয়েও, অনেক সময়ে মানব মুক্ত হয় না। পূর্ব জন্মের প্রারব্ধকর্ম রয়ে যায়। আবার কারো পূর্বজন্মজন্মান্তরের সুকৃতির ফলে এজন্মে সামান্যতেই মুক্তি লাভ হয়। বিষয়টি নিয়ে একটি সুন্দর মর্মস্পর্শী গল্প আছে। এক ব্যক্তি বনের মধ্যে সঙ্গীদের সাথে বিচ্ছিন্ন হয়ে পথহারা হয়ে যায়। এমন সময় বনের মধ্যে অন্ধকার নেমে, রাত্রি হয়ে যায়। সে তখন চিন্তা করে এমনিতেই আজ অমাবস্যা, এরপরে রাত্রি হয়ে গেছে, এ ঘোর জঙ্গলে যেকোন অনাকাঙ্ক্ষিত বিপদ ঘটতে পারে। এ কথা চিন্তা করে, সে একটি বৃহৎ গাছের উপরে আশ্রয় নেয়। সারাদিন পরিশ্রান্ত থাকার কারণে, সে গাছের ডাল ধরেই ঘুমিয়ে পরে। ঠিক মধ্যরাত্রে তার ঘুম ভেঙে যায়, কিছু শব্দে। তিনি লক্ষ্য করলেন গাছের নিচে একব্যক্তি তান্ত্রিকমতে মা কালীর সাধনার প্রস্তুতি নিচ্ছে। সকল প্রস্তুতি নিয়ে তিনি যখন, দেবীর মন্ত্রজপ শুরু করবেন; ঠিক তখনই কোথা থেকে এক হিংস্র বাঘ এসে তাকে আক্রমণ করে এবং শরীরের কিছু অংশ খাবলে নিয়ে তাকে ক্ষতবিক্ষত করে চলে যায়।
বাঘের আক্রমণে আহত ব্যক্তিটি মৃতপ্রায় হয়ে যায়।এবং ঘটনায় আকস্মিকতায় হতভম্ব হয়ে যায় গাছের উপরের ব্যক্তিটি। কিছু পরে বাঘটি কি মনে করে, লোকটিকে সম্পূর্ণ গলাধঃকরণ না করেই চলে যায়। বাঘটি চলে যাওয়ার পরে গাছের উপরের ব্যক্তিটি সাহস করে নিচে নেমে আসে। সে শুনেছে বাঘ কখনো পেছনে আসে না, শুধুই সামনে যায়।তাই তার ধারণা হল, বাঘ আর এ পথে পিছনে আসবে না। গাছে আশ্রয় নেয়া ব্যক্তিটি,গাছ থেকে নেমে আক্রান্ত মৃতপ্রায় ব্যক্তিটির কাছে যায়। মৃতপ্রায় ব্যক্তিটি গাছের উপরে মানুষটিকে দেখে হতবাক হয়। তখন গাছে আশ্রয় নেয়া ব্যক্তিটি, তার গাছে আশ্রয় নেয়ার কাহিনীটি খুলে বলে।সকল কথা শুনে তখন মৃত্যুপথযাত্রী ব্যক্তিটি বলে, এ স্থানটি একটি মাহাত্ম্যপূর্ণ স্থান এবং আজকের তিথিটিও মাহাত্ম্যপূর্ণ। আমি সারাজীবন বিভিন্ন তান্ত্রিকদের সাথে ঘুরে এ স্থানটি এবং তিথিটির মাহাত্ম্য জানতে পেরেছে। আজকের সাধনে এক রাত্রেই মায়ের দর্শন লাভ সম্ভব। মাকে দর্শনের জন্যে আজকে সাধনার প্রত্যেকটি বিষয় এবং উপাদান আমি সংগ্রহ করেছিলাম। যা তুমি চোখের সামনে দেখতে পাচ্ছ বাবা। শুধু একটি বিষয় সংগ্রহ করতে পারিনি, তা হল একটি শব। আমার মনে হয় আমি আর বেশীক্ষণ বাঁচব না। আমার এ সাজানো তান্ত্রিক উপাচারে, তুমি দেবীর মন্ত্রজপ কর। আমি তোমাকে মন্ত্র শিখিয়ে দিচ্ছি। আমি মৃত্যুবরণ করলে, তুমি আমার মৃতদেহের উপরে বসেই মন্ত্রজপ করবে। মন্ত্র এবং শবসাধনার পদ্ধতি শিখিয়ে দিয়ে বাঘে আক্রান্ত ব্যক্তিটি মুক্তির এক অতৃপ্তি নিয়ে মৃত্যুবরণ করে।গাছে আশ্রয় নেয়া ব্যক্তিটি, মৃতব্যক্তিটির নির্দেশিত সকল নির্দেশনা অনুসরণ করে তার শবের উপরে পদ্মাসনে বসে দেবীকে একাগ্রচিত্তে স্মরণ করে।
হুঁ হুঁ কারে শবারূঢ়ে নীল নীরজ লোচনে।
ত্ৰৈলোক্যৈক মুখে দিব্যে কালিকায়ৈ নমোঽস্তু তে॥১
প্রত্যালীয় মহাঘোরে মুণ্ডমালা বিভূষিতে।
খর্বে লম্বোদরে ঘোরে কালিকায়ৈ নমোঽস্তু তে৷৷ ২
নবযৌবনসম্পন্নে সগজকুম্ভোপস্থানি।
বাণীশ্বরি শিবে শান্তে কালিকায়ৈ নমোঽস্তু তে৷৷ ৩
লোলজিহ্বে দূরারোহে নেত্রত্রয়বিভূষিতে।
ঘোরহাস্যোৎকটাকারে কালিকায়ৈ নমোঽস্তু তে॥ ৪
ব্যাঘ্রচর্ম্মাম্বরধারে খড়্গকর্ত্তরিকাকরে।
কপালেন্দীবরে বামে কালিকায়ৈ নমোঽস্তু তে॥ ৫
নীলোৎকট জটাভারে সিন্দূরেন্দু সুখোদরে।
স্ফারবক্রোষ্ঠ দশনে কালিকায়ৈ নমোঽস্তু তে ৬
প্রলয়ানলধূম্রাভে চন্দ্রাসূর্যাগ্নিলোচনে।
শৈলাবামে শুভে মাতঃ কালিকায়ৈ নমোঽস্তু তে॥ ৭
ব্রহ্মণোক্তজলৌঘে তু শবমধ্যে প্রসংস্থিতে।
প্রেতকোটি সমাযুক্তে কালিকায়ৈ নমোঽস্তু তে॥ ৮
কৃপাময়ি হরের্মাতঃ সর্বাশাপরিপূরণি।
বরপ্রদে হরের্মাতঃ কালিকায়ৈ নমোঽস্তু তে॥৯
ইত্যেতৎ কালিকাস্তোত্রং যঃ পঠেদ্ ভক্তিসংযুতঃ।
কৃতকৃত্যে ভবেন্মন্ত্রী নাত্র কার্যাবিচারণা। ১০
দেবীর মন্ত্রজপ শুরু করে। আশেপাশে ভয়ংকর শব্দ হতে থাকে, কিন্তু সে একাগ্র মনে দেবীকে স্মরণ করে তাঁর সিদ্ধমন্ত্র জপ করতে থাকে। রাত্রির শেষ প্রহরে দেবী তাকে দর্শন দেন। সমস্ত বন আলোকিত হয়ে যায়। দেবীর জ্যোতিপ্রভায় চর্মনেত্রে তাকানো অসম্ভব হয়ে পরে। দেবীকালী তখন তাঁকে মুক্তির বরদান করেন। স্বল্প সময়ে একরাত্রের সাধনাতে দেবীর দর্শনে; সে আনন্দিত হয়ে ওঠে। তখন সে দেবীর কাছে জিজ্ঞাসা করে, মা আমি না চাইতেই তুই আমাকে দর্শন দিলি; মুক্তির আশ্বাসবাণী দিলি।কিন্তু মা যিনি এ সকল আয়োজন করলো তাকে কেন হিংস্র বাঘের মুখে পড়ে মৃত্যুবরণ করতে হল?
তখন দেবী স্মিত হাসি দিয়ে বললেন, বৎস তুমি এমনি এমনিতেই আজ এখানে আসোনি, আর তাকে এমনিতেই বাঘে খায়নি। তুমি কি জান যে পূর্ববর্তী কতশত জন্মে আমাকে পাবার জন্যে, সাধনা করতে গিয়ে তোমাকে এমন কত বাঘের পেটে গিয়ে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে? কত সাপে কেঁটেছে, কত বনের পশুরা হত্যা করেছে, তুমি জান না। কারণ পূর্ববর্তী জন্মের ঘটনাগুলো তোমার মনে নেই। যদি মনে থাকত তাহলে ভয়ে শিউরে উঠতে। যে মারা গিয়ে শব হয়েছে, সেও আমার দর্শন পাবে।ওর কিছু কর্মফল অসমাপ্ত আছে; তা খণ্ডিত হলেই আগামী কোন এক জন্মে সে আমার দর্শনে মুক্তি লাভ করবে।এ বলেই দেবী অন্তর্হিত হলেন।
ব্যক্তিটি তখন মৃতদেহটিকে অগ্নিসংস্কার করে তার গৃহে চলে গেছেন। তার কাছে গতরাত্রের ঘটনাগুলো সকলই একটি স্বপ্নের মত বোধ হল।এ কারণেই আশাবাদী হয়ে যার যার সাধ্যানুসারে সাধনপথে আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। মুক্তি যদি তীব্র ইচ্ছা এবং প্রচেষ্টা থাকে, তবে কোন না কোন জন্মে সে মুক্ত হবেই। পথ কঠিন, এ মনে করে বসে থাকা যাবে না।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।