বাংলাদেশ সংবিধানের ২৮ অনুচ্ছেদে মৌলিক অধিকার অংশে সুস্পষ্টভাবে ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থান নির্বিশেষে সকল নাগরিকদের সমান অধিকারের কথা বলা হয়েছে।
"অনুচ্ছেদ -২৮: (১) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে কোন নাগরিকের প্রতি রাষ্ট্র বৈষম্য প্রদর্শন করিবেন না।
(২) রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারীপুরুষের সমান অধিকার লাভ করিবেন।
(৩) কেবল ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারী পুরুষভেদ বা জন্মস্থানের কারণে জনসাধারণের কোন বিনোদন বা বিশ্রামের স্থানে প্রবেশের কিংবা কোন শিক্ষা-প্রতিষ্ঠানে ভর্তির বিষয়ে কোন নাগরিককে কোনরূপ অক্ষমতা, বাধ্যবাধকতা, বাধা বা শর্তের অধীন করা যাইবে না ।
(৪) নারী বা শিশুদের অনুকূলে কিংবা নাগরিকদের যে কোন অনগ্রসর অংশের অগ্রগতির জন্য বিশেষ বিধান-প্রণয়ন হইতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই রাষ্ট্রকে নিবৃত্ত করিবে না।"
কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, দেশের সংবিধানে ধর্ম, গোষ্ঠী, বর্ণ, নারীপুরুষভেদ বা জন্মস্থান নির্বিশেষে সমানাধিকারের সুরক্ষাকবচ থাকলেও ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে সমান অধিকারের বিষয়টিকে সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করে পিছদুয়ারের নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাজেটে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের সাথে এক দৃশ্যমান ভয়াবহ বৈষম্য সৃষ্টি করা হয়েছে। যা সমানাধিকারের দৃষ্টিতে অত্যন্ত দৃষ্টিকটু। এ বিষয়টি নিয়ে দেশের প্রথম শ্রেণীর ইংরেজি দৈনিক 'দ্য ডেইলি স্টার' এর অনলাইন বাংলা সংস্করণে ‘প্রস্তাবিত বাজেটে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য বরাদ্দ দুঃখ ও উদ্বেগজনক’ (২৯.০৫.২০২১) -এ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে:
"২০২১-২২ অর্থবছরের প্রস্তাবিত বাজেটে অপ্রতুল বরাদ্দ নিয়ে নিন্দা ও ক্ষোভ জানিয়েছে বাংলাদেশ হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ।
আজ শনিবার এক বিবৃতিতে পরিষদ জানায়, ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বাজেটে চলমান প্রকল্প ও অন্যান্যে মোট বরাদ্দ হিসেবে ১৫,০৫৪.০৩ কোটি টাকা রাখা হলেও তার মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯০.০৮ কোটি টাকা যা মোট প্রকল্প বরাদ্দের শতকরা ১ দশমিক ৯৩ শতাংশ।
...পরিষদ জানায়, স্বাধীনতা-পরবর্তী বৈষম্য-বঞ্চনায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে বাজেটে ধারাবাহিকভাবে কোনোরূপ প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না।
...বিবৃতিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উন্নয়নে চলমান বৈষম্য নিরসনে অন্যুন ৫,০০০ কোটি টাকা থোক বরাদ্দের পাশাপাশি প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তানের মতো বাংলাদেশেও সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার জন্য জোর দাবি জানানো হয়েছে।"
তীব্রতর দৃশ্যমান বৈষম্যের বিষয়টি নিয়ে দ্য ডেইলি স্টারসহ বিভিন্ন জাতীয় দৈনিক পত্রিকায় সংবাদ প্রকাশিত হয়।দৈনিক 'ভোরের কাগজ' পত্রিকায়, "প্রস্তাবিত বাজেটে সংখ্যালঘুদের বরাদ্দ মাত্র ১ দশমিক ৯৩ শতাংশ" (২৯.০৫.২০২১) -এ শিরোনামে বলা হয়:
"শরিবার (২৯ মে) গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে সংগঠনের সভাপতি সাবেক সাংসদ ঊষাতন তালুকদার, ভারপ্রাপ্ত সভাপতি ড. নিমচন্দ্র ভৌমিক ও নির্মল রোজারিও এবং সাধারণ সম্পাদক এ্যাডভোকেট রাণা দাশগুপ্ত বলেন, অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদিত ধর্ম মন্ত্রণালয়ের বাজেটে চলমান প্রকল্প ও অন্যান্য খাতে মোট বরাদ্দ হিসেবে ১৫ হাজার ৫৪ কোটি ৩ লাখ টাকা রাখা হলেও এর মধ্যে ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের জন্য বরাদ্দ রাখা হয়েছে ২৯০ কোটি ৮ লাখ টাকা যা মোট প্রকল্প বরাদ্দের মাত্র ১.৯৩ শতাংশ।
বিবৃতিতে পরিষদের নেতারা বলেন, স্বাধীনতা-পরবর্তী বৈষম্য-বঞ্চনায় ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে বাজেটে ধারাবাহিকভাবে কোনরূপ প্রতিফলন লক্ষ্য করা যাচ্ছে না, যা দুঃখজনক। বাজেটে সংখ্যাগুরু সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উন্নয়নে বিভিন্ন প্রকল্পখাতে বিশেষ অর্থ বরাদ্দ থাকলেও একইভাবে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ধর্মীয় উন্নয়নে কোন বরাদ্দ নেই। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের আওতায় ধর্মীয় শিক্ষা, সংস্কৃত ও পালি বোর্ড এবং এর অধীনে পরিচালিত টোল ও পালি প্রতিষ্ঠানসমূহ একেবারেই জরাজীর্ণ ও সাইনবোর্ড সর্বস্ব হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।
বিবৃতিতে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে দীর্ঘকালব্যাপী চলমান বৈষম্য নিরসনে কমপক্ষে ৫ হাজার কোটি টাকা থোক বরাদ্দের পাশাপাশি প্রতিবেশী ভারত, পাকিস্তানের অনুরূপ বাংলাদেশেও সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় প্রতিষ্ঠার জোর দাবি জানানো হয়েছে।"
ধর্ম মন্ত্রণালয় যদি এভাবে তার নিরপেক্ষতা হারিয়ে একধর্মের মন্ত্রণালয়ের পরিণত হয়, তবে সংখ্যালঘুদের মধ্যে হতাশা, বঞ্চনা এবং ক্ষোভের উৎপত্তি হবেই। এই সীমাহীন বৈষম্যের যদি যথাযথ নিরসন না করা হয়, তবে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের জীবনে পর্যায়ক্রমে হতাশা বাড়তেই থাকবে। তাই রাষ্ট্রযন্ত্রের উচিত আসু সকলের সমানাধিকার নিশ্চিত করে ধর্ম মন্ত্রণালয়ের অর্থ বরাদ্দকে দেশের সকল সম্প্রদায়ের মাঝে ন্যায্যতার ভিত্তিতে সুষমবণ্টন করে দেয়া। বাংলাদেশের প্রস্তাবিত বাজেটে সংখ্যালঘু উন্নয়ন বরাদ্দের এমন তীব্র বৈষম্যের প্রেক্ষাপটে আমরা যদি পার্শ্ববর্তী ভারতের অথবা বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের উন্নয়নে ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট বরাদ্দ দিকে দৃষ্টি দেই, তবে নিজেকে নিজভূমে পরবাসীর মত মনে হয়। তীব্র বৈষম্য যাতনা বুকের ভিতরে মোচড় দিয়ে উঠে। বাংলাদেশের জনপ্রিয় দৈনিক 'প্রথম আলো' পত্রিকায় "সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে বড় বরাদ্দ মমতার"(১২.০৭.২০২১) -এ শিরোনামে বলা হয়:
"২০২১–২২ অর্থবছরের রাজ্য বাজেটে মমতা সংখ্যালঘু উন্নয়ন খাতে যে পরিমাণ বরাদ্দ রেখেছেন, তা দেশটির অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় ঢের বেশি। এমনকি তা জাতীয় বাজেটে এই খাতে কেন্দ্রীয় সরকারের বরাদ্দকে প্রায় ছুঁয়ে ফেলেছে।
সংখ্যালঘু সমাজের উন্নয়নে ভারতে কেন্দ্রীয় সংখ্যালঘু মন্ত্রণালয় রয়েছে। এই মন্ত্রণালয়ের জন্য ২০২০–২১ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে কেন্দ্রীয় সরকার শুরুতে ৫ হাজার ২৯ কোটি রুপি বরাদ্দ রেখেছিল। তবে সংশোধিত বাজেটে তা কমিয়ে ৪ হাজার ৫ কোটি রুপি করা হয়। আর ২০২১–২২ অর্থবছরের জাতীয় বাজেটে এ খাতে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৪ হাজার ৮১০ কোটি রুপি। সেই হিসাবে, এক বছরে দেশটিতে সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে বরাদ্দ বেড়েছে ৮০৫ কোটি রুপি।
...পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু সমাজের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ বরাদ্দ বাড়িয়েছে মমতার নেতৃত্বাধীন তৃণমূল সরকার। ২০২১-২২ অর্থবছরের রাজ্য বাজেটে এই খাতে ৪ হাজার ৭৭৭ কোটি রুপি বরাদ্দ রেখেছেন মমতা। অর্থাৎ, জাতীয় বাজেটের তুলনায় এই খাতে পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য বাজেটে বরাদ্দের পরিমাণ মাত্র ৩৩ কোটি রুপি কম। আগের অর্থবছরে সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে মমতার বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৬০০ কোটি রুপি। পশ্চিমবঙ্গে এক বছরে এই খাতে বরাদ্দ বাড়ানো হয়েছে ১ হাজার ১৭৭ কোটি রুপি।
... জনসংখ্যার বিবেচনায় দেশটির সবচেয়ে বড় রাজ্য উত্তর প্রদেশ। এখানে প্রায় ৪ কোটি মুসলিমের বসবাস, যা রাজ্যটির মোট জনসংখ্যার প্রায় ২০ শতাংশ। ২০২০-২১ অর্থবছরে উত্তর প্রদেশে সংখ্যালঘুদের উন্নয়নে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ৭ কোটি রুপি। আগের অর্থবছরে এর পরিমাণ ছিল ৩ হাজার ১৫৯ কোটি রুপি।"
কেউ যদি বাংলাদেশের ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেট এবং যুগপৎভাবে পশ্চিমবঙ্গের ২০২১-২২ অর্থবছরের বাজেটে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের উন্নয়ন বরাদ্দ বাজেটকে একটু লক্ষ্য করে; তবে সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করতে পারবে বাংলার প্রধান দুই অংশে সংখ্যালঘুদের অবস্থা এবং অবস্থান। সংখ্যালঘুদের প্রয়োজন ন্যায্য অধিকার। যা একটি কল্যাণকামী রাষ্ট্রের জন্য অনস্বীকার্য।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।