ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

ঐতিহাসিক ১১-ই সেপ্টেম্বর।

শান্তি এবং সংঘর্ষের যুগপৎ একটি দিন

১৮৯৩ খ্রিস্টাব্দে স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকার শিকাগো শহরে ১১ সেপ্টেম্বর থেকে ২৭ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সতেরো দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত বিশ্বমহাধর্ম সম্মেলনে বক্তৃতা করে জাতিসংঘের ন্যায় এক বৈশ্বিক ভ্রাতৃত্ববোধের জাগরণ করেন। বিশ্বমহাধর্ম সম্মেলনের এই দিনে স্বামী বিবেকানন্দ হিন্দুধর্ম সংস্কৃতি সহ সমসাময়িক বিভিন্ন বিষয়ের উপরে বক্তব্য দেন। এ বক্তব্যের মধ্যে তাঁর ১৯ সেপ্টেম্বর নবম দিবসের অধিবেশনে হিন্দুধর্ম বক্তব্যটি অত্যন্ত জনপ্রিয়তা পায়। তৎকালে ইউরোপ আমেরিকার অধিকাংশ মানুষেরই কোন সাধারণ ধারণা ছিলো না বেদ এবং হিন্দু ধর্মীয় বিষয়ে। স্বামী বিবেকানন্দের বক্তব্যে তারা ভারতীয় ধর্মদর্শন সম্পর্কে একটি সংক্ষিপ্ত ধারণা পায়।এ বিশ্বমহাধর্ম সম্মেলনের বক্তব্যে বেদের নিত্যতা এবং শ্বাশতস্বরূপ প্রসঙ্গে স্বামীজী বলেন:
ঐতিহাসিক ১১ সেপ্টেম্বর
"বেদ হইতে হিন্দুগণ তাঁহাদের ধর্ম লাভ করিয়াছেন। তাঁহারা বেদসমূহকে অনাদি ও অনন্ত বলিয়া বিশ্বাস করেন। একখানি পুস্তককে অনাদি ও অনন্ত বলিলে এই শ্রোতৃনণ্ডলীর কাছে তাহা হাস্যকর বলিয়া মনে হইতে পারে বটে, কিন্তু ‘বেদ’ শব্দদ্বারা কোন পুস্তক-বিশেষ বুঝায় না। ভিন্ন ভিন্ন ব্যাক্তি বিভিন্ন সময়ে যে আধ্যাত্মিক সত্যসমূহ আবিষ্কার করিয়া গিয়াছেন, বেদ সেই-সকলের সঞ্চিত ভাণ্ডারস্বরূপ। আবিষ্কৃত হইবার পূর্বেও মাধ্যাকর্ষণের নিয়মাবলী যেমন সর্বত্রই বিদ্যমান ছিল এবং সমুদয় মনুষ্য-সমাজ ভুলিয়া গেলেও যেমন ঐগুলি বিদ্যমান থাকিবে, আধ্যাত্মিক জগতের নিয়মাবলীও সেইরূপ। আত্মার সহিত আত্মার যে নৈতিক ও আধ্যাত্মিক সম্বন্ধ, প্রত্যেক জীবাত্মার সহিত সকলের পিতাস্বরূপ পরমাত্মার যে দিবা সম্বন্ধ, আবিষ্কৃত হইবার পূর্বেও সেগুলি ছিল এবং সকলে বিস্মৃত হইয়া গেলেও এগুলি থাকিবে।"
স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর বক্তব্যে হিন্দুত্বের অনেক শাশ্বত বিষয় স্মরণ করিয়ে এবং আত্মা যে অবিনাশী বেদ এবং গীতার এ তত্ত্বটি বিভিন্নভাবে স্মরণ করিয়ে দেন আমাদের। তিনি বলেন:
"হিন্দু নিজেকে আত্মা বলিয়া বিশ্বাস করে। ‘সেই আত্মাকে তরবারি ছেদন করিতে পারে না, অগ্নি দগ্ধ করিতে পারে না, জল আর্দ্র করিতে পারে না এবং বায়ু শুষ্ক করিতে পারে না।’ হিন্দু বিশ্বাস করে : সেই আত্মা এমন একটি বৃত্ত, যাহার পরিধি কোথাও নাই, কিন্তু যাহার কেন্দ্র দেহমধ্যে অবস্থিত, এবং সেই কেন্দ্রের দেহ হইতে দেহান্তরে গমনের নামই মৃত্যু। আর আত্মা জড়নিয়মের বশীভূত নন, আত্মা নিত্য-শুদ্ধ-বুদ্ধ -মুক্ত-স্বভাব। কিন্তু কোন কারণবশতঃ জড়ে আবদ্ধ হইয়াছেন ও নিজেকে জড় মনে করিতেছেন।"
শিকাগো বক্তৃতায় স্বামী বিবেকানন্দ ধর্মে ধর্মে হানাহানির তীব্র বিরোধিতা করে বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে দৃঢ়কণ্ঠে অখণ্ড মানবতার জয়ধ্বনি করে বলেন :
"যদি কেহ এরূপ স্বপ্ন দেখেন যে, অন্যান্য ধর্ম লোপ পাইবে এবং তাঁহার ধর্মই একমাত্র টিকিয়া থাকিবে, তবে তিনি বাস্তবিকই কৃপার পাত্র; তাঁহার জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত, তাঁহাকে আমি স্পষ্টভাবে বলিয়া দিতেছি, তাঁহার ন্যায় লোকেদের বাধাপ্রদান সত্ত্বেও শ্রীঘ্রই প্রত্যেক ধর্মের পতাকার উপর লিখিত হইবে-বিবাদ নয়, সহায়তা ; বিনাশ নয়, পরস্পরের ভাবগ্রহণ; মতবিরোধ নয়, সমন্বয় ও শান্তি।"
বহুত্বের মধ্যে একত্ব, এটাই হিন্দু ধর্মের প্রকৃত স্বরূপ। যা বেদ, গীতা এবং বেদান্তসূত্রের চতুর্থসূত্রে সুস্পষ্টভাবে বলা হয়েছে। আমরা যে শুধুমাত্র একজনেরই উপাসনা করি এটা বেদাদি-পৌরাণিক শাস্ত্রগ্রন্থাদিতে তো আছেই, অসংখ্য কবিরাও এ বিষয় নিয়ে লিখেছেন। এই একের মধ্যে বহু এবং বহুর মধ্যে একত্ব এ তত্ত্বের উপরেই দাঁড়িয়ে আছে আমাদের হিন্দু ধর্ম এবং দর্শন। কিন্তু অন্যদের ক্ষেত্রে বিষয়টি উল্টো। তাদের অনেকেরই আছে ধর্মের নামে জোড়জবড়দস্তি। হিন্দুধর্ম বক্তব্যে স্বামীজি অত্যন্ত সুন্দর একটা উদাহরণের মাধ্যমে তা উল্লেখ করেছেন:
"বহুত্বের মধ্যে একত্বই প্রকৃতির নিয়ম, হিন্দুগণ ইহা উপলব্ধি করিয়াছেন। অন্যান্য ধর্ম কতকগুলি নির্দিষ্ট মতবাদ বিধিবদ্ধ করিয়া সমগ্র সমাজকে বলপূর্বক সেগুলি মানাইবার চেষ্টা করে। সমাজের সন্মুখে তাহারা একমাপের জামা রাখিয়া দেয়; জ্যাক, জন, হেনরি প্রভৃতি সকলকেই ঐ এক মাপের জামা পরিতে হইবে। যদি জন বা হেনরির গায়ে না লাগে, তবে তাহাকে জামা না পরিয়া খালি গায়েই থাকিতে হইবে।"
১১ সেপ্টেম্বর, ১৮৯৩ স্বামী বিবেকানন্দ শিকাগো ধর্মসভার প্রথম দিবসের অধিবেশনে অভ্যর্থনার উত্তরে বলেন, সনাতন ধর্ম সারা বিশ্বকে সহিষ্ণুতা ও ভালবাসা জগতকে অনাদিকাল থেকে শিক্ষা দিয়ে এসেছে। তাই সেই শ্বাশত সর্বজনীন ধর্মের প্রতিনিধি হিসেবে প্রত্যেকের গর্বিত হওয়া প্রয়োজন। তিনি উদাত্তকণ্ঠে শিকাগো ধর্মসভায় ঘোষণা করেন, চিরন্তন ভাবে আমরা যে সবকিছু গ্রহণ করেছি তা নয়, আমরা জগতের সকল ভাবকেই আপন করে নিয়েছি। জগতে ধর্মের নামে নিপীড়িত উদ্বাস্তু অসহায় নর নারীকে আশ্রয় প্রদান করেছে, সনাতন ধর্ম ; সেই ধর্মের প্রতিনিধি হিসাবে তিনি গর্বিত। ইহুদীদের খাঁটি বংশধরগণের অবশিষ্ট অংশকে সাদরে হৃদয়ে ধারণ করে রাখে ভারতবর্ষের হিন্দু সম্প্রদায়। যে বৎসর রােমানদের ভয়ংঙ্কর উৎপীড়নে ইহুদিদের পবিত্র মন্দির বিধ্বস্ত হয়, সেই বৎসরই তারা দক্ষিণ ভারতে কেরালাতে এসে আশ্রয় নেয়। আজও সেই আশ্রিত ইহুদি সম্প্রদায়েরা বংশানুক্রমিকভাবে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে বসবাস করছে। জরথুষ্ট্রের অনুগামী প্রাচীন পারস্য জাতি পার্শ্ববর্তী আরবের আক্রমণকারীদের কাছে স্বেচ্ছায় ধর্মান্তরিত হতে না চাওয়ায় ; তাদের নির্মম অত্যাচার সহ্য করতে হয়। পরবর্তীতে তাদের সিংহভাগই আরবের ধর্মে ধর্মান্তরিত হয়ে যায়; অবশিষ্টাংশ জরথুষ্ট্র ধর্মাবলম্বিগণকে আশ্রয় প্রদান করে ভারতবর্ষের হিন্দু সম্প্রদায়। এমনিভাবে পৃথিবীর অসংখ্য জাতিকে প্রতিপালন করেছে, আশ্রয় দিয়েছে হিন্দু সম্প্রদায়। সম্প্রীতি এবং সমন্বয়ের মতপথের ধারা হিন্দু সম্প্রদায়ের রক্তনালীতে প্রবাহিত। এ বিষয়গুলো স্বামী বিবেকানন্দ প্রথম দিবসের অধিবেশনে অভ্যর্থনার উত্তরের বক্তব্যে অত্যন্ত যৌক্তিকভাবে ব্যাখ্যা করেন। গন্ধর্বরাজ পুষ্পদন্তের রচিত একটি অপূর্ব 'শিবমহিম্নঃস্তোত্র' আছে। কোটি কোটি হিন্দু নরনারী আজও এ স্তোত্রটি প্রতিদিন পাঠ করে। সকল মতপথ নির্বিশেষে অনন্য সম্প্রীতির কথা বলা হয়েছে, এ শিবমহিম্নঃস্তোত্রটিতে। তাই স্বামী বিবেকানন্দ তাঁর শিকাগো ধর্মসভায় প্রথম দিবসের অধিবেশনে এ স্তোত্রটির সপ্তম শ্লোকটির শেষাংশ উল্লেখ করেন।
ত্রয়ী সাংখ্যং যোগঃ পশুপতিমতং বৈষ্ণবমিতি
প্রভিন্নে প্রস্থানে পরমিদমদঃ পথ্যমিতি চ।
রুচীনাং বৈচিত্র্যাদৃজুকুটিলনানাপথজুষাং
নৃণামেকো গম্যস্ত্বমসি পয়সামর্ণব ইব।
"ত্রিবিধ মন্ত্রাত্মক চতুর্বেদ, সাংখ্যদর্শন, যোগদর্শন, শৈব, বৈষ্ণব ইত্যাদি ঈশ্বরের পথে যাওয়ার বহু ভিন্ন ভিন্ন প্রকার হিতকারী শাস্ত্রীয় পথ আছে।বিভিন্ন নদীর উৎস আলাদা হলেও, তারা সকলেই যেমন এক সমুদ্রের জলরাশি পতিত হয়ে সমুদ্রে মিলিয়ে যায়; তেমনি মানবমনের নিজ নিজ রুচির বৈচিত্রের কারণে সরল ও কুটিল নানা পথে যারা চলছে, হে ভগবান, তুমিই তাঁদের সকলের একমাত্র গতি। "
আমেরিকার রাস্তায় সহায়সম্বলহীন বা ভবঘুরের মত থেকেও, ১৮৯৩ সালের ১১ সেপ্টেম্বর স্বামী বিবেকানন্দ মানুষের ভালবাসায় তাদের হৃদয়ের সর্বশ্রেষ্ঠ আসনটি জিতে নিয়ে অধ্যাত্ম জগতের রাজসিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন। এর সূচনা হয় হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক মি. রাইটের সঙ্গে তাঁর ব্যক্তিগত পরিচয় হওয়ার পর থেকে। মি. রাইট স্বামীজীর সাথে পরিচয়ের দিনেই তাঁর কথাবার্তা এবং নিগূঢ়তম জ্ঞানে মুগ্ধ এবং বিস্মিত হয়ে যান।তিনিই ধর্মসভায় প্রতিনিধিত্ব করার জন্য স্বামী বিবেকানন্দকে পরিচয়পত্র লিখে দেন। সেই পরিচয়পত্রে তিনি লেখেন,“ইনি এমন একজন বিজ্ঞ ব্যক্তি যে, আমাদের সকল অধ্যাপককে এক করলেও এঁর সমকক্ষ হবে না।”
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হল, যে ১১ সেপ্টেম্বর স্বামী বিবেকানন্দ আমেরিকানদের হৃদয় জয় করে সকলকে ধর্মের নামে বিবাদ, হানাহানি, বিনাশ এ সকল জঙ্গিপনা থেকে মুক্ত হতে আহ্বান করলেন ; ভাবতে অবাক লাগে সেই ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর তারিখে আমেরিকাতেই ওসামা বিন লাদেনের নেতৃত্বে বর্বর তালিবান বাহিনী ওয়ার্ল্ড ট্রেড সেন্টারের টুইনটাওয়ারটি ধ্বংস করে দেয়। তাদের এ ঘৃণ্য বর্বরোচিত কর্মকাণ্ডে ১১ সেপ্টেম্বর হয়ে যায়, মানবসভ্যতার জন্যে কলঙ্কিত একটি দিন। ২০০১ সালের ১১ সেপ্টেম্বর মঙ্গলবার সকালে যুক্তরাষ্ট্রের উপর আল কায়েদা একইসাথে চারটি সমন্বিত সন্ত্রাসী হামলা চালায়। একবুক ঘৃণা নিয়ে পৃথিবীবাসী টিভিতে দেখে এ আক্রমনের ভিডিওচিত্র। ভয়ংকর এ আক্রমণে ২,৯৭৭ জন নিরপরাধ মানুষের নির্মম মৃত্যু হয়। ভয়াবহ আহত হয় ২৫,০০০ এর অধিক মানুষ। ১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অধিক অবকাঠামো ও সম্পদ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ঘটনাটিতে বিশ্ব হতবিহ্বল হয়ে যায়।
১১ সেপ্টেম্বর তারিখে যখন একজন বাঙালি গিয়ে বিশ্বসভায় বিশ্বশান্তির কথা ঘোষণা করে; ঠিক একইদিনে কয়েকজন আরবীয় তার দলবল নিয়ে গিয়ে টুইনটাওয়ার ধ্বংস করে মানবসভ্যতা সংস্কৃতির ধ্বংসের প্রচেষ্টা চালায়। ঘটনাক্রমে দিবালাকের মত স্পষ্ট বোঝা যায়, বাঙালি এবং আরবীয়দের মনোজগতের গতিপ্রকৃতি। ধ্বংস করাটা অত্যন্ত সহজ। কিন্তু কোন নতুন কিছু সৃষ্টি করতে মেধাপ্রজ্ঞার প্রয়োজন পরে। যে মেধাপ্রজ্ঞার সামর্থ্য সকল জাতির থাকে না; অন্ততপক্ষে ধ্বংসের মানসিকতাকারীদের থাকে না।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁