জগতে প্রত্যেকটি জীব প্রতিনিয়ত জন্ম নিচ্ছে এবং যথাক্রমে মৃত্যুবরণ করছে। জগতে কেউ অমর নয়।এমনকি অবতার পুরুষেরা যেমন মায়ার অবলম্বনে জন্মগ্রহণ করে; তেমনি অবতারলীলা সংবরণ করে, তাঁদেরও মহাপ্রস্থানের পথে যেতে হয়। কেউ যদি অত্যন্ত মহৎকর্ম করে, তবে অমর হয়ে থাকে তাঁর কীর্তি। তাই বলা হয়, কীর্তিমানের মৃত্যু নেই; সে সর্বদা চিরঞ্জীব মানুষের মাঝে। জগত সংসারে বারংবার জন্ম-মৃত্যুর চক্রে আবর্তিত হয়ে প্রাণীদের অনন্ত মাতা-পিতা এবং পুত্র-কলত্রের অনুভব হয়। এ অনুভবে পড়ে জীব প্রতিনিয়ত মায়ার মোহনজালে আবদ্ধ হয়। জন্ম-মৃত্যুর ঘূর্ণাবর্তে অনন্ত অনন্ত জীবের পূর্বকালে থেকে আজ পর্যন্ত জন্মের সাথে সাথে মৃত্যুও হয়েছে। এ জন্ম-মৃত্যুর চক্র অতীতকালের সাথে সাথে বর্তমানকালেও যেমন আবর্তিত হচ্ছে ; তেমনি ভবিষ্যতে প্রলয়কাল পর্যন্তও হবে। এ নিয়ে আনন্দ বা শোকাভিভূত কোনটিই হওয়া উচিত নয়। জীবের উচিত এ জন্ম-মৃত্যুচক্রকে অতিক্রম করে এক অচিন্ত্যআনন্দময় সত্ত্বায় পৌছানো। নদী অনন্তকাল অনন্তপথ চলতেই থাকবে, যতক্ষণ সে সমুদ্রের দেখা না পায় এবং সমুদ্রের সাথে মিলিত না হয়। এ জগতে প্রতিদিনই যেমন আনন্দের বিষয় ঘটছে; তেমনি বেদনার বিষয় ঘটছে, বীরত্বের বিষয় ঘটছে এবং ভয়ের বিষয় ঘটছে। হাস্য, করুণ, রৌদ্র, বীর, ভয়ানক, বীভৎস, অদ্ভুত এবং শৃঙ্গার এ অষ্টরস প্রতিনিয়ত ক্ষণেক্ষণে আবর্তিত হচ্ছে মনুষ্য সহ প্রাণীকুলের জীবনে।এ জন্ম-মৃত্যুর বিষয়টি অজ্ঞানীকে আচ্ছন্ন করলেও জ্ঞানীকে কখনো আচ্ছন্ন বা মুগ্ধ করে না। তাই জ্ঞানীর উচিত আনন্দ, বেদনার ঊর্ধ্বে উঠে সদা আনন্দময় ব্রহ্মকেই জীবনের একমাত্র পাথেয় করে সকলের দৃষ্টান্ত হওয়া।
মাতাপিতৃসহস্রাণি পুত্রদ্বারশতানি চ।
সংসারেষ্বনুভূতানি যান্তি যাস্যন্তি চাপরে।।
হর্ষস্থানসহস্রাণি ভয়স্থানশতানি চ।
দিবসে দিবসে মূঢ়মাবিশন্তি ন পণ্ডিতম্।।
(মহাভারত: স্বর্গারোহণ পর্ব, ৫.৬০-৬১)
"এ জগত সংসারে এসে প্রাণীদের সহস্র সহস্র মাতা ও পিতা এবং শতশত পুত্র ও কলত্রের অনুভব করেছে। কারণ, প্রাণীগণের মধ্যে অনেকের পূর্বে মৃত্যু হয়েছে, কারো এখন মৃত্যু হচ্ছে এবং আগামী ভবিষ্যতেও মৃত্যু বরণ করবে।
প্রতিদিনই জগতে সহস্র সহস্র আনন্দের বিষয় ঘটছে, প্রতিদিনই সহস্র সহস্র ভয়ের বিষয় ঘটছে। এ বিষয়টি অজ্ঞানীকে আচ্ছন্ন করে ; কিন্তু জ্ঞানীকে নয়।"
শাস্ত্রে আছে জীব চুরাশি লক্ষ জন্ম জন্মান্তরের ধারাবাহিকতায় মনু্ষ্য-জন্ম লাভ লাভ করে। জগত সংসারে মনুষ্য জন্ম দুর্লভ। কারণ মনুষ্য জন্ম লাভ করেই জীব বেদোক্ত সাধনপ্রণালীর জ্ঞান অর্জন করতে পারে। স্বদিচ্ছা থাকলে এবং যুগপৎ যোগ্য অধিকারী হলে সেই সাধনপ্রণালীকে পরিপূর্ণভাবে অনুসরণ করতে পারে। তবে একথা স্মর্তব্য, শুধু মনুষ্য জন্ম পেলেই কেউ মুক্তির পথে অগ্রসর হতে পারে না। সর্বপ্রথম তাঁকে অধিকারী হতে হবে। পরবর্তীতে তাঁর মধ্যে সংসারবন্ধন থেকে মুক্তির জন্য সুতীব্র ইচ্ছারূপ মুমুক্ষুত্ববোধ থাকতে হয়। অধিকারী এবং মুমুক্ষুত্ববোধ থাকলে দৈবকৃপায় তাঁর মুক্তির পথ ধীরেধীরে প্রশস্ত হয়। মুক্তির সেই প্রশস্ত পথেই তখন ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের সঙ্গ লাভ হয়। তিনি মুক্তির মার্গদর্শন করান। তাই মনু্ষ্য-জন্ম লাভ, সংসারবন্ধন থেকে মুক্তির ইচ্ছা এবং মহাপুরুষসংশ্রয় জগতে এ তিনটি বিষয় অত্যন্ত সুদুর্লভ। প্রথমে সাধন পথের অধিকারী হতে হয়, পরবর্তীতে ঈশ্বরের অনুগ্রহ এবং কৃপায় - এ তিনটি লাভ হয়। বিষয়টি শ্রীশঙ্করাচার্য তাঁর বেদান্তদর্শনের প্রকরণগ্রন্থ 'বিবেকচূড়ামণি' গ্রন্থের শুরুতেই বলেছেন:
দুর্লভং ত্রয়মেবৈতদ্দেবানুগ্রহহেতুকম্ ।
মনুষ্যত্বং মুমুক্ষুত্বং মহাপুরুষসংশ্রয়ঃ ॥
লব্ধ্বা কথঞ্চিন্নরজন্ম দুর্লভং
তত্রাপি পুংস্ত্বং শ্রুতিপারদর্শনম্ ।
য়স্ত্বাত্মমুক্তৌ ন য়তেত মূঢধীঃ
স হ্যাত্মহা স্বং বিনিহন্ত্যসদ্গ্রহাত্ ॥
ইতঃ কো ন্বস্তি মূঢাত্মা য়স্তু স্বার্থে প্রমাদ্যতি ।
দুর্লভং মানুষং দেহং প্রাপ্য তত্রাপি পৌরুষম্ ॥
(বিবেকচূড়ামণি:৩-৫)
"মনু্ষ্য-জন্ম লাভ, সংসারবন্ধন থেকে মুক্তির ইচ্ছা ও ব্রহ্মজ্ঞ পুরুষের সঙ্গ, এই তিনটি এ জগতে দুর্লভ। ঈশ্বরের বিশেষ অনুগ্রহ হলে তবেই এ তিনটি পাওয়া যায়।
কোনও রকমে দুর্লভ নরজন্ম আর সেই জন্মে পুরুষশরীর ও বেদান্তবিচারে পারদর্শিতা লাভ করেও যে মূঢ়বুদ্ধির মানুষ নিজের মুক্তির জন্যে যত্ন করে না, সেই আত্মঘাতী পুরুষ অসৎ-বস্তু গ্রহণের ফলে নিজেকেই বিনষ্ট করে।
অনিত্য এ জগতে অকারণ বসে না থেকে সকলকেই মুক্তির পথে অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু কেউ যদি সাধ্য সামর্থ্য থাকার পরেও নিজের সর্বোচ্চ কল্যাণের পথকে না চিনতে পারে; তবে কি করার আছে। মুক্তির পথে কেউ কারো নয়। গুরু শুধু নির্দেশনা, শুভকামনা এবং আশীর্বাদ করতে পারবে। কিন্তু জীবকে মুক্তি দিতে পারবে না। তাই অন্যের আশায় না থেকে, নিজের মুক্তিরূপ কল্যাণের পথে নিজেকেই এগিয়ে যেতে হবে। উপলব্ধি করতে হবে, এ জগত অনিত্য; জগতে কেউ কারো নয়। শেষবেলায় যার যার নিজ নিজ সহায় সম্বল নিয়েই ভগসাগর পাড়ি দিতে হবে। এ প্রসঙ্গে মাতৃসাধক ভবা পাগলার অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি সংগীত রয়েছে।
"কেউ তো কারো নয়, এ কথাটি সত্য
বুঝেও বোঝোনা মন, তুমি যে অনিত্য।
ওই দেখো তোমার বন্ধু,
তরিতেছে ভব সিন্ধু
এক বিন্দু আশা তুমি করিও না আর
হরি বলো, হরি বলো, মন রে আমার।"
জীবের মুক্তিপ্রদাতা একমাত্র ভগবান। নৌকাকে পাড়ে বেঁধে রেখে, যদি নৌকার বৈঠা বাওয়া হয়; তবে সারাদিন বসে নৌকা বাইলেও নৌকা একহাত পরিমাণও আগাতে পারে না। কিন্তু বিপরীতে নৌকাটির বেঁধে রাখা দড়ির বন্ধন ছিন্ন করে দিয়ে যদি আমরা বৌঠা চলনা করি; তবে চাইলে নৌকাটিকে নিয়ে নদীর শেষে সমুদ্র পর্যন্ত যেতে পারি। তেমনি আমাদের দেহরূপ নৌকা কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্য -এ ষড়রিপুর বন্ধনে আবদ্ধ। বন্ধনের কারণে আমরা চাইলেও আগাতে পারি না, নৌকা চলে না। আগে ষড়রিপুর আসক্তির বন্ধন আমাদের ছিন্ন করতে হবে। তবেই সাধের আমাদের দেহনৌকা একদিন মুক্তির আনন্দসমুদ্রে ঠাঁই পাবে। সেই সমুদ্রে সাধের রংবেরঙের নৌকাটিকে ডুবিয়ে দিতে হবে। যেন নৌকাটির আর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব না থাকে। তখন দেহনৌকা এবং আনন্দ সমুদ্র সকলই একাকার। জীব আর ব্রহ্ম একাকার; মাঝে কোন বাঁধা নেই। বিষয়টি অত্যন্ত সুন্দর করে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর একটি ব্রহ্মসংগীতে বলেছেন।
" জানি আমি তোমায় পাব নিরন্তর
লোক-লোকান্তরে যুগ-যুগান্তর–
তুমি আর আমি মাঝে কেহ নাই,
কোনো বাধা নাই ভুবনে।"
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।