বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে গত ১৭.০৩.২০২১, বুধবার ছিল বাঙালি জাতির জন্য অত্যন্ত ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ আবেকমণ্ডিত একটি দিন।সে আবেকমণ্ডিত ভাবগাম্ভীর্যময় দিনেই মৌলবাদীদের দ্বারা অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আক্রান্ত হয় সুনামগঞ্জের সাল্লা উপজেলার হিন্দু সম্প্রদায়। ভয়ংকর সাম্প্রদায়িক আক্রমণে তাদের পিতৃপুরুষের বসতভিটা ক্ষত-বিক্ষত করে দেয়া হয়। একাধিক মন্দির সহ ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানকে বিধ্বস্ত করা হয়। কেউ যদি মনে করে থাকেন বিষয়টি অকস্মাৎ হয়েছে, তবে সে বোকার স্বর্গে বাস করে। পূর্ববর্তী পাবনার সাথিয়া, দিনাজপুরের চিরিবন্দর, কক্সবাজারের রামু, চট্টগ্রামে হাটহাজারী, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, রংপুরের গঙ্গাচড়া সহ সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষের বসতভিটায় যে আক্রমণগুলো হয়েছে এর সকলই বলা যায় পূর্বপরিকল্পিত।হামলার পরবর্তীতে মিডিয়ায় কল্যাণে অনেকটাই যে কারা এ কাজগুলো করছে। যারা করছে তারা সকলে একই নেটওয়ার্কের অন্তর্ভুক্ত। তাদের নেটওয়ার্ক হল পাকিস্তানপন্থী মানসিকতায় বিশ্বাসী মৌলবাদী নেটওয়ার্ক।
বাংলাদেশের যে সকল উপজেলা তুলনামূলক হিন্দু জনসংখ্যা বেশি বা ভোটে প্রভাব সৃষ্টি করতে পারে, সে সকল অঞ্চলই মৌলবাদীদের নীলনকশার অন্তর্ভুক্ত। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময়ে খুলনা জেলাটি হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল। সেই খুলনা ভেঙে তিনটি জেলা হয়েছে খুলনা, সাতক্ষীরা এবং বাগেরহাট। এ তিনটি জেলার একটিতেই আজ হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠতা নেই। সীমান্তবর্তী সাতক্ষীরা সহ এ জেলাগুলো থেকে প্রতিনিয়ত হিন্দু সম্প্রদায়ের জনসংখ্যা কমে শূণ্যের কাছাকাছি চলে যাচ্ছে।খুলনাকে হিন্দু শূন্য করার পঞ্চাশের দশক থেকে নব্বইয়ের দশক পর্যন্ত কিছু চিহ্নিত মৌলবাদী রাজনীতিবিদদের নেতৃত্বে বিভিন্ন কৌশল নেয়া হয়।ইতিহাসের দিকে আমরা যদি একটু নির্মোহ দৃষ্টিতে ফিরে তাকাই, তবেই সে বিষয়টি সুস্পষ্টভাবে স্বচ্ছ আয়নায় মত বোঝা যায়। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে দেশের সবচেয়ে ভয়াবহ গণহত্যা হয়েছে খুলনার চুকনগরে। পাখির মত গুলি করে এদেশের মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। এই গণহত্যার নেতৃত্বে ছিলো এদেশীয় পাকিস্তানি বাহিনীর রাজাকার সহযোগীরা।
সুনামগঞ্জের সাল্লা উপজেলার প্রতি মৌলবাদীদের ক্ষোভের প্রধান কারণ, সে উপজেলায় ব্যাপক হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বসবাস। সুনামগঞ্জ জেলার সাল্লা উপজেলাটি শান্তির জনপদ হিসেবেই পরিচিত ছিল। সুনামগঞ্জের সাল্লা উপজেলার আয়তন হল আয়তন হল ২৬০.৭৪ বর্গ কিমি। বাংলাদেশের জাতীয় জ্ঞানকোষ বাংলাপিডিয়ায় পরিসংখ্যান অনুসারে (আদমশুমারি রিপোর্ট -২০০১) সাল্লা উপজেলার জনসংখ্যা ১০১২৯৮। এর মধ্যে মুসলিম জনসংখ্যা ৪৯,৩৭৩ জন এবং হিন্দু জনসংখ্যা ৫১,৮৯৩ জন। অর্থাৎ সাল্লা উপজেলায় সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায় জনসংখ্যার দিক দিয়ে সংখ্যাগরিষ্ঠ। ঝুমন দাস আপনের (২৮) ফেসবুক স্টেটাস হলো শুধুই আইওয়াশ বা হাতির লোকদেখানো সামনের দাত।হাতি যে দাত দেখায় তা দিয়ে খায় না এবং যে দাত কেউ সহজেই দেখতে পায়না; সেই অদৃশ্যমান দাত দিয়েই মূলতঃ হাতি খাবার খায়। সুনামগঞ্জের সাল্লাতে এ সাম্প্রদায়িক আক্রমণের পিছনেও হাতির ভেতরের দাতের মত প্রধান বিষয় হল সাল্লাতে ব্যাপক হিন্দু জনসংখ্যা।যা মৌলবাদী গোষ্ঠীদের একেবারে বিরক্তির কারণ। সাল্লার হামলার পিছনে ইন্ধনদাতা হিসেবে উপজেলা চেয়ারম্যানের নাম এসেছে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। এতেই অনেকটা পরিস্কার যে, হিন্দু সম্প্রদায়ের উপরে এ ঘৃণ্য বর্বরোচিত আক্রমণের প্রধান কারণই হলো ভোট এবং রাজনীতি। সেই সাম্প্রদায়িক রাজনীতির নীলনকশা অনুসারে হিন্দু অধ্যুষিত অঞ্চল থেকে হিন্দুদের ভয় ভীতি দেখিয়ে ছলে-বলে-কৌশলে তাদের দেশত্যাগে বাধ্য করা। যাতে তাদের জনসংখ্যা পর্যায়ক্রমে হ্রাস পায়।
সুনামগঞ্জের সাল্লা উপজেলার নোয়াগাঁও ও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের হেফাজতে ইসলাম সমর্থকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া একটি পোস্টের অজুহাত দিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে নৃশংস হামলা চালায়।১৭ মার্চ সকালে দেশীয় অস্ত্র নিয়ে নোয়াগাঁও ও তার পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের কয়েক শ স্থানীয় হেফাজতে ইসলাম সমর্থক হামলা চালিয়ে হিন্দু সম্প্রদায়ের শতাধিক বাড়িঘরে ভাঙচুর, লুটপাট করে এবং মন্দির ধ্বংস করে।এ সাম্প্রদায়িক আক্রমণ প্রসঙ্গে শাল্লা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) নাজমুল হক দেশের জাতীয় দৈনিক 'ডেইলি স্টার' পত্রিকাকে (১৭.০৩.২১) বলেন:
"হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব মামুনুল হককে নিয়ে মঙ্গলবার ফেসবুকে কটূক্তিমূলক একটি পোস্ট দেন ওই গ্রামের যুবক ঝুমন দাস আপন। সে রাতেই স্থানীয়রা তাকে স্থানীয় শাঁসকাই বাজারে আটক করে পুলিশের কাছে সোপর্দ করেন এবং হেফাজতে ইসলামের স্থানীয় নেতারা এ ঘটনায় একটি মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
এ অবস্থার মধ্যেই আজ সকালে আশেপাশের কয়েকটি গ্রামের কয়েক শ হেফাজত সমর্থক বাসিন্দা দেশীয় অস্ত্র নিয়ে সংঘবদ্ধ হন। তারপর তারা ওই যুবকের বাড়িসহ আশেপাশের কয়েকটি হিন্দু বাড়িতে হামলা চালান। পরে পুলিশ ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।"
শাল্লা উপজেলার হবিবপুর ইউনিয়নের ধারাইন নদের দক্ষিণ পাড়ে নোয়াগাঁও গ্রামের অবস্থান। গ্রামের তিনটি পাড়ায় দুই শতাধিক ঘর আছে। বেশির ভাগ ঘরই টিনের বেড়া ও টিনের চালা দ্বারা নির্মিত। অধিকাংশ মানুষই নিন্মবিত্ত। ধারাইন নদের উত্তর দিকে বরাম হাওরের পারে শাল্লা উপজেলার কাশিপুর, দিরাই উপজেলার নাসনি, চন্দ্রপুর ও সন্তোষপুর গ্রাম। ওই চার গ্রামের লোকজনকে নোয়াগাঁও যেতে হয় ধারাইন নদ পার হয়ে। এই নদের উত্তর পাড়ের চার গ্রামের লোকজন লাঠিসোঁটা নিয়ে জড়ো হন। পরে সেখান থেকে শতাধিক লোক ওই গ্রামে গিয়ে নোয়াগাঁও গ্রামে হামলা চালায়।আক্রমণকারীদের মধ্যে কিশোর ও যুবকের সংখ্যাই বেশি বলে নির্যাতিত ক্ষতিগ্রস্তরা বলছে। কিশোর-যুবক যখন আক্রমণ হামলা এবং লুটপাটের সাথে যুক্ত হয়; তখন সেই অঞ্চলের আগামী ভবিষ্যৎ কিছুটা হলেও টের পাওয়া যাত।স্থানীয় অনিল দাস, হরিপদ দাস, দিগেন দাস, শৈলেন্দ্র দাস, রবিন্দ্র দাস, রন্টু দাস, অসীম চক্রবর্তী, দেবেন্দ্র কুমার দাস, মানকি দাস, নগেন্দ্র কুমার দাসসহ প্রায় শতাধিক হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের বসতভিটা ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।হামলার সময় বাড়িঘর ছেড়ে যাওয়া পুরুষেরা বাড়িতে ফিরলেও অনেক ঘরে নারী ও শিশুরা ফেরেনি।
বাংলাদেশে ধর্মীয় অনুভূতির অজুহাতে একই স্টাইলে সংখ্যালঘু সম্প্রদায় বিশেষ করে হিন্দু সম্প্রদায়ের মানুষের উপরে নিরবচ্ছিন্ন এ সাম্প্রদায়িক আক্রমণে মনে হয় সংখ্যালঘুরা নিজ ভূমেই তারা বুঝি আর পরবাসে আছে। নিজেই বাড়িতেই আজ তারা জেলখানায় বন্দি। এ প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের খ্যাতিমান কবি শামসুর রাহমানের একটি বিখ্যাত কবিতা "উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ" কবিতাটির কথা আজ খুব মনে পড়ছে। দেশ যেন সত্যি সত্যি কিছু মানুষ নামের দুপায়ের হিংস্র প্রাণীদের কারণে উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে। আমরা কেউ জানি না এ গন্তব্যের শেষ কোথায়?
"মনে হয় যেন উঠেছে জেগে সুদূর বিদেশে
যেখানে এখন কেউ কারো চেনা নয়, কেউ কারো
ভাষা ব্যবহার আদৌ বোঝে না; দেখে সে
উদ্ভট উটের পিঠে চলেছে স্বদেশ বিরানায়;
মুক্তিযুদ্ধ, হায়, বৃথা যায়, বৃথা যায় বৃথা যায়।
কোথায় পাগলাঘন্টি বাজে
ক্রমাগত, এলোমেলো পদধ্বনি সবখানে।
হামলাকারীরা ট্রাম্পেট বাজিয়ে ঘোরে শহরে ও গ্রামে
এবং ক্রন্দনরত পুলিশের গলায় শুকায় বেল ফুল।
দশদিকে কত একাডেমীতে নিশীথে
গোর-খোদকেরা গর্ত খোঁড়ে অবিরত,
মানুষের মুখগুলি
অতি দ্রুত হয়ে যাচ্ছে শিম্পাঞ্জীর মুখ।"
আগামী ২৬ মার্চ আমাদের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। দেশ এবং জাতি যখন এ সাতসমুদ্র সেঁচা 'স্বাধীনতা' নামক অমূল্য মাণিকের সুবর্ণজয়ন্তীর জন্যে প্রহর গুণছে। তখন দেশবিরোধী শক্তি -যারা দেশের স্বাধীনতায় বিশ্বাস করে না; বাঙালি জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করে না; ধর্মনিরপেক্ষতায় বিশ্বাস করে না; অসাম্প্রদায়িকতায় বিশ্বাস করে না ; জাতীয় সংগীতে বিশ্বাস করে না -সেই অশুভ শক্তিই জাতির পতাকা খামছে ধরছে সাধ্যমত। হয়ত সম্পূর্ণ সফল হতে পারছে না। কিন্তু এরপরেও বিরামহীনগতিতে চলছে তাদের সকল কর্মকাণ্ড।তারা শুধুই সময়ের প্রতিক্ষায়, সুযোগের প্রতিক্ষায়, অন্ধকারের প্রতিক্ষায়।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।