বেদের মধ্যে বলা আছে, অন্নই ব্রহ্ম। বেদের বিভিন্ন স্থানে বিশেষ করে তৈত্তিরীয় উপনিষদের ভৃগুবল্লীতে সুস্পষ্টভাবে বিষয়টি রয়েছে।
"অন্নং ব্রহ্মেতি ব্যজানাৎ।
অন্নাদ্ধ্যেব খল্বিমানি ভূতানি জায়ন্তে।
অন্নেন জাতানি জীবন্তি।"
(তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ভৃগুবল্লী, দ্বিতীয় অনুবাক)
"অন্নই ব্রহ্ম। অন্ন থেকেই সকল প্রাণীর উৎপত্তি এবং অন্নতেই সবাই বেঁচে থাকে।"
অন্নং ন পরিচক্ষীত। তদ্ ব্রতম্। আপো বা অন্নম্।
(তৈত্তিরীয় উপনিষদ, ভৃগুবল্লী, অষ্টম অনুবাক)
"অন্নের অবহেলা করবে না, পরিত্যাগ করবে না এটাই ব্রত। জলই অন্ন।"
অন্নং হি ভূতানাং জ্যেষ্ঠম্। তস্মাৎ সর্বৌষধমুচ্যতে।
সবং বৈ তে অন্নমাপ্নুবন্তি যে অন্নং ব্রহ্মোপাসতে।
অন্নং হি ভূতানাং জ্যেষ্ঠম্। তস্মাৎ সর্বৌষধমুচ্যতে।
অন্নাদ্ভূতানি জায়ন্তে। জাতান্যন্নেন বর্ধন্তে
(তৈত্তিরীয় উপনিষদ:ব্রহ্মানন্দবল্লী, দ্বিতীয় অনুবাক)
"অন্ন সমস্ত জীবের জ্যেষ্ঠ। তাই তাকে সর্ব ঔষধরূপ বলা হয়। অন্নকে ব্রহ্মভাবে যারা উপাসনা করেন, তারা অবশ্যই অন্নরূপ ব্রহ্মকে প্রাপ্ত হন।অন্নতেই জগতের সকল জীব জন্মগ্রহণ করে এবং অন্নতেই বর্ধিত হয়।"
অন্নকে ব্রহ্ম বলে, অন্নতেই সকল প্রাণী জীবিত থাকে, তাই অন্নের নিন্দা করতে নিষেধ করা হয়েছে মন্ত্রগুলিতে। অন্নকে পরিত্যাগ করতে নিষেধ করা হয়েছে এবং অন্নের উপাসনা করতে বলা হয়েছে। কারণ অন্নতেই জগতের জীব জন্মগ্রহণ করে এবং অন্নতেই বর্ধিত হয়। বেদে যেহেতু বলা হয়েছে অন্নই ব্রহ্ম, তাই এই অন্নব্রহ্মের অধিষ্ঠাত্রী হলেন দেবী অন্নপূর্ণা। তিনি কাশী পুরীরও অধিষ্ঠাত্রী। তিনি শিবের শক্তি। সংস্কৃতে শ্রীশঙ্করাচার্য থেকে বাংলায় ভারতচন্দ্র সহ অসংখ্য কবিরা অসাধারণ পদলালিত্যে দেবীর মাহাত্ম্যগাঁথা স্তোত্র প্রকাশ করেছেন। এ সকল স্তোত্রের মধ্যে শ্রীশঙ্করাচার্য বিরচিত অন্নপূর্ণাস্তোত্র বিখ্যাত। এক কথায় অন্নপূর্ণা দেবীর স্তোত্রের মধ্যে শিরোমণি বলা চলে। এই স্তোত্রের সর্বশেষ দ্বাদশ শ্লোকে শ্রীশঙ্করাচার্য একটি বৈশ্বিক সাম্যবাদী প্রেরণা দিয়েছেন। এ প্রেরণাটি এককথায় অনন্য অসাধারণ।তিনি বলেছেন, এই জগতের মাতা যেহেতু পার্বতী এবং পিতা দেব মহেশ্বর; তাই জগদ্বাসী সকলেই আমরা একে অন্যের পরমাত্মীয়। কেউ আমাদের দূরের নয়, শত্রু নয়; সকলেই পরম বান্ধব। আমাদের স্বদেশ কোন সংকীর্ণ ভৌগোলিক গণ্ডিতে আবদ্ধ নয়। স্বর্গ, মর্ত ও পাতাল এ ত্রিভুবন জুড়েই আমার স্বদেশ বিরাজিত। এই বোধ এবং বিশ্বাস এবং আমাদের মধ্যে আসবে, তখন আর কেউ আমরা কারো সাথে বিদ্বেষ করবো না বা চাইলেও করতে পারবো না। পৃথিবীর সকল জাতিগোষ্ঠীর মানুষকে এক করার জন্যে জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠার পিছনেও এই একাত্ম সাম্যবাদী চেতনা কাজ করেছে।
অন্নপূর্ণা স্ত্রোত্রম্
নিত্যানন্দকরী বরাভয়করী সৌন্দর্য-রত্নাকরী,
নির্দ্ধূতাখিলঘোরপাবনকরী প্রত্যক্ষমাহেশ্বরী ।
প্রালেয়াচলবংশপাবনকরী কাশীপুরাধীশ্বরী,
ভিক্ষাং দেহি কৃপাবলম্বনকরী মাতান্নপূর্ণেশ্বরী ।। ১
নানারত্নবিচিত্রভূষণকরী হেমাম্বরাড়ম্বরী,
মুক্তাহারবিলম্বমানবিলসদ্বক্ষোজকুম্ভান্তরী ।
কাশ্মীরাগুরুবাসিতা রুচিকরী কাশীপুরাধীশ্বরী,
ভিক্ষাং দেহি কৃপাবলম্বনকরী মাতান্নপূর্ণেশ্বরী ।। ২
যোগানন্দকরী রিপুক্ষয়করী ধর্ম্মার্থনিষ্ঠাকরী,
চন্দ্রার্কনলভাসমানলহরী ত্রৈলোক্যরক্ষাকরী ।
সর্বৈশ্বর্য্যসমস্তবাঞ্ছিতকরী কাশীপুরাধীশ্বরী,
ভিক্ষাং দেহি কৃপাবলম্বনকরী মাতান্নপূর্ণেশ্বরী ।। ৩
কৈলাসাচলকন্দরালয়করী গৌরী উমা শঙ্করী,
কৌমারী নিগমার্থ-গোচরকরী ওঙ্কারবীজাক্ষরী ।
মোক্ষদ্বার-কপাটপাটনকরী কাশীপুরাধীশ্বরী,
ভিক্ষাং দেহি কৃপাবলম্বনকরী মাতান্নপূর্ণেশ্বরী ।। ৪
দৃশ্যাদৃশ্য-প্রভূতবহনকরী ব্রহ্মাণ্ডভাণ্ডোদরী,
লীলানাটকসূত্রভেদনকরী বিজ্ঞানদীপাঙ্কুরী ।
শ্রীবিশ্বেশ-মনঃপ্রসাদনকরী কাশীপুরাধীশ্বরী,
ভিক্ষাং দেহি কৃপাবলম্বনকরী মাতান্নপূর্ণেশ্বরী ।। ৫
উর্বীসর্ব্বজনেশ্বরী ভগবতী মাতান্নপূর্ণেশ্বরী,
বেণীনীলসমানকুন্তলহরী নিত্যান্নদানেশ্বরী ।
সর্বানন্দকরী দশাশুভকরী কাশীপুরাধীশ্বরী,
ভিক্ষাং দেহি কৃপাবলম্বনকরী মাতান্নপূর্ণেশ্বরী ।। ৬
আদীক্ষান্তসমস্তবর্ণনকরী শম্ভোস্ত্রিভাবাকরী,
কাশ্মীরা ত্রিজনেশ্বরী ত্রিলহরী নিত্যাঙ্কুরী শর্ব্বরী ।
কামাকাঙ্ক্ষকরী জনোদয়করী কাশীপুরাধীশ্বরী,
ভিক্ষাং দেহি কৃপাবলম্বনকরী মাতান্নপূর্ণেশ্বরী ।। ৭
দর্বী স্বর্ণবিচিত্ররত্ন-রচিতা দক্ষে করে সংস্থিতা,
বামে স্বাদুপয়োধরী সহচরী সৌভাগ্যমাহেশ্বরী ।
ভক্তাভীষ্টকরী দৃশা শুভকরী কাশীপুরাধীশ্বরী,
ভিক্ষাং দেহি কৃপাবলম্বনকরী মাতান্নপূর্ণেশ্বরী ।। ৮
চন্দ্রার্কনলকোটিকোটিসদৃশা চন্দ্রাংশুবিম্বাধরী,
চন্দ্রার্কাগ্নিসমানকুণ্ডলধরী চন্দ্রার্কবর্ণেশ্বরী ।
মালাপুস্তকপাশকাঙ্কুশধরী কাশীপুরাধীশ্বরী
ভিক্ষাং দেহি কৃপাবলম্বনকরী মাতান্নপূর্ণেশ্বরী ।। ৯
ক্ষত্রত্রাণকরী মহাভয়করী মাতা কৃপাসাগরী,
সাক্ষান্মোক্ষকরী সদা শিবকরী বিশ্বেশ্বরশ্রীধরী ।
দক্ষাক্রন্দকরী নিরাময়করী কাশীপুরাধীশ্বরী,
ভিক্ষাং দেহি কৃপাবলম্বনকরী মাতান্নপূর্ণেশ্বরী ।। ১০
অন্নপূর্ণে সদাপূর্ণে শঙ্কর-প্রাণবল্লভে ।
জ্ঞানবৈরাগ্যাসিদ্ধ্যর্থং ভিক্ষাং দেহি চ পার্ব্বতী ।। ১১
মাতা মে পার্ব্বতী দেবী পিতা দেবো মহেশ্বরঃ ।
বান্ধবাঃ শিবভক্তাশ্চ স্বদেশো ভুবনত্রয়ম্ ।। ১২
ইতি অন্নপূর্ণা-স্তোত্রং সম্পূর্ণম
বঙ্গানুবাদ
হে দেবী, তুমি সর্বদা আনন্দবিধায়িনী, বর এবং অভয়প্রদায়িনী, সৌন্দর্যের সাগরস্বরূপা , অখিল পাপ নাশ করে ভক্তকে পবিত্র করে দাও , সাক্ষাৎ মহেশ্বরী , হিমালয় বংশ তোমার দ্বারা পবিত্র হয়েছে, তুমি কাশীপুরীর অধীশ্বরী, তুমি সকল কৃপার আধার, জগতের জননী হে মা অন্নপূর্ণা, তুমি আমায় ভিক্ষা দাও । ১
তুমি বহুবিধ রত্নে খচিত সজ্জায় সজ্জিতা , তুমি স্বর্ণময় বস্ত্র পরিধান পূর্বক সুশোভিতা , বিলম্বিত মুক্তামালার দ্বারা তোমার স্তনদ্বয়ের মধ্যস্থল উদ্ভাসিত, তুমি কুঙ্কুম ও অগুরুর দ্বারা সুবাসিতা ও কান্তিময়ী ; তুমি কাশীপুরীর অধীশ্বরী, তুমি সকল কৃপার আধার, জগতের জননী হে মা অন্নপূর্ণা, তুমি আমায় ভিক্ষা দাও । ২
তুমি যোগানন্দ- প্রদায়িনী, রিপু বিনাশিনী, ধর্ম এবং অর্থের পূর্তিবিধায়িনী , চন্দ্র সূর্য এবং অগ্নির আভার সদৃশ জ্যোতিস্তরঙ্গময়ী , ত্রিলোকের রক্ষাকারিণী , সকল ঐশ্বর্য এবং সকল বাঞ্ছিত বস্তু প্রদায়িনী ; তুমি কাশীপুরীর অধীশ্বরী, তুমি সকল কৃপার আধার, জগতের জননী হে মা অন্নপূর্ণা, তুমি আমায় ভিক্ষা দাও । ৩
তুমি কৈলাস পর্বতের গুহায় নিবাসিনী গৌরী, উমা, শঙ্করী ও কৌমারী ; তুমি বেদার্থ – প্রকাশিনী , ওঙ্কারবীজের অক্ষররূপিণী , মুক্তি- দ্বারের কপাট উন্মোচনকারিণী , তুমি কাশীপুরীর অধীশ্বরী, তুমি সকল কৃপার আধার,জগতের জননী হে মা অন্নপূর্ণা, তুমি আমায় ভিক্ষা দাও । ৪
তুমি দৃশ্য ও অদৃশ্য বহু বস্তুকে বহন কর; তুমি উদরে ব্রহ্মাণ্ড ধারণ কর ও সংসারলীলারূপ নাটকের প্রস্তাবনা ছিন্ন কর ; তুমি বিজ্ঞানদীপের কারণ, শ্রীবিশ্বেশ্বরের চিত্তপ্রসাদকারিণী, তুমি কাশীপুরীর অধীশ্বরী,তুমি সকল কৃপার আধার, জগতের জননী হে মা অন্নপূর্ণা, তুমি আমায় ভিক্ষা দাও । ৫
তুমি পৃথিবীর সকল লোকের ঈশ্বরী , ভগবতী, মাতা, অন্নপূর্ণা , ঈশ্বরী ; তুমি নদীস্রোততুল্য চঞ্চল ও সুদীর্ঘ কেশরাশি এবং নীলকান্তমণিতুল্য নীলকুন্তলধারিণী , সর্বদা অন্নদানতৎপরা , সকলের আনন্দদায়িনী , সৌভাগ্যবিধায়িনী, তুমি কাশীপুরীর অধীশ্বরী, তুমি সকল কৃপার আধার,জগতের জননী হে মা অন্নপূর্ণা, তুমি আমায় ভিক্ষা দাও । ৬
তুমি অ হইতে ক্ষ পর্যন্ত সমস্ত বর্ণের প্রকাশিকা , শম্ভুর অবস্থাত্রয়ের কারণ ও কুঙ্কুমবর্ণা ; ভূমি স্বর্গ মর্ত এবং পাতালের অধীশ্বরী , সৃষ্টি স্থিতি ও প্রলয়রূপ তরঙ্গস্বরূপা , নিত্য কারণরূপিণী , প্রলয়ান্ধকারস্বরূপা , কামনার প্রেরয়িত্রী, লোকের উন্নতিবিধায়িনী, তুমি কাশীপুরীর অধীশ্বরী, তুমি সকল কৃপার আধার, জগতের জননী হে মা অন্নপূর্ণা, তুমি আমায় ভিক্ষা দাও । ৭
তোমার ডান হাতে স্বর্ণ ও বিচিত্র রত্নে খচিত হাতা শোভা পাচ্ছে এবং তোমার বামভাগে স্বাদুপয়োধরবতী সহচরী বিদ্যমান ; তুমি সৌভাগ্যবিধাত্রী , ভক্তের চির বাঞ্ছিতপ্রদায়িনী, কৃপাকটাক্ষে মঙ্গলবিধায়িনী ;তুমি কাশীপুরীর অধীশ্বরী, তুমি সকল কৃপার আধার, জগতের জননী হে মা অন্নপূর্ণা; তুমি আমায় ভিক্ষা দাও । ৮
তুমি কোটি কোটি চন্দ্র সূর্য ও অগ্নির সদৃশা, তোমার অধর চন্দ্রকিরণের ন্যায় স্নিগ্ধ মনোহর , তোমার কুণ্ডল চন্দ্র সূর্য ও অগ্নির তুল্য এবং তোমার গাত্রবর্ণ চন্দ্র ও সূর্যের ন্যায়, তুমি ঈশ্বরী, তোমার হস্তে অক্ষমালা, বেদাদিপুস্তক, পাশ এবং অঙ্কুশ , তুমি কাশীপুরীর অধীশ্বরী, তুমি সকল কৃপার আধার,জগতের জননী হে মা অন্নপূর্ণা, তুমি আমায় ভিক্ষা দাও । ৯
তুমি ক্ষত্রিয়দিগের ত্রাণকারিণী , জীবের একমাত্র অভয়দায়িনী ; হে মা তুমি করুণাসিন্ধুস্বরূপা এবং সাক্ষাৎ মুক্তিদায়িনী, নিরন্তর কল্যাণকারীনি , দক্ষের ক্রন্দনের কারণ, সকল রোগবিনাশিনী, তুমি কাশীপুরীর অধীশ্বরী, তুমি সকল কৃপার আধার, হে মা অন্নপূর্ণা, তুমি আমায় ভিক্ষা দাও । ১০
হে অন্নপূর্ণে , তুমি নিরন্তর সর্বদা পূর্ণরূপে বিরাজিতা, তুমি শঙ্করের প্রাণতুল্য প্রিয়া, তুমি পার্বতী ; হে মা তুমি আমায় এরূপ ভিক্ষা দাও যেন আমার জ্ঞান, বৈরাগ্য এবং মোক্ষলাভ হয় । ১১
জগতের মাতা ভগবতী পার্বতী হলেন আমার মা এবং জগতের পিতা দেব মহেশ্বর হলেন আমার পিতা ; আমার পরম বান্ধব হলেন জগতের পিতামাতার ভক্তগণ এবং স্বর্গ, মর্ত ও পাতাল এ ত্রিভুবন জুড়েই আমার স্বদেশ। ১২
অন্নপূর্ণা-স্তোত্র সমাপ্ত
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।