১৯৮২ সালের ৩০ এপ্রিল পশ্চিমবঙ্গের কোলকাতার বালিগঞ্জের বিজন সেতুতে আনন্দমার্গীয় ১৭ জন সন্ন্যাসীকে প্রকাশ্য দিনেরবেলায় নৃশংসভাবে আগুনে পুরিয়ে হত্যা করা হয়। এর মধ্যে নারী সন্ন্যাসিনীও ছিলেন। অর্থাৎ নারী পুরুষ কেউ রেহাই পায়নি বামপন্থী ক্যাডার বাহিনীর থেকে।সেদিন কোলকাতার তিলজলাতে আনন্দমার্গের প্রধান কার্যালয়ে একটি শিক্ষা সম্মেলন ছিল। সন্ন্যাসীরা সে সম্মেলনে যাচ্ছিলেন। এ সময়ে সিপিএম এর ক্যাডার বাহিনী তাদের তিনটি ভিন্ন স্থানে ছেলেধরা গুজব রটিয়ে একসাথে আক্রমণ করে। সবাইকে ব্যাপক মারধর করে ক্ষত-বিক্ষত করে তাদের দেহতে আগুন লাগিয়ে দিয়ে হত্যা করে। প্রকাশ্য দিনের বেলাতে সংঘটিত এ ঘটনা পশ্চিম বাংলার তথাকথিত হাজার হাজার সেকুলাররা প্রত্যক্ষ করেছিল।
১৭ সন্ন্যাসী হত্যাকাণ্ডে, দোষীরা আজও শাস্তি পায়নি।
বিজন সেতুর বন্ডেল গেটে সকাল সাতটা থেকে আটটা,
মাত্র ঘন্টা খানেকের অভূতপূর্ব নির্মমতায় খুন হয়ে গেলেন ১৭ জন আনন্দমার্গী সন্ন্যাসী৷ কিছু বুঝে ওঠার আগেই তিলজলা আশ্রম যাওয়ার পথে আনন্দমার্গী সন্ন্যাসীদের এক এক করে ট্যাক্সি থেকে টেনে-হিঁচড়ে নামিয়ে শাবলে মাথা থেঁতলে দিয়ে, ছোরা দিয়ে চোখ উপড়ে ফেলে, গায়ে পেট্রোল আর অ্যাসিড ঢেলে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারা হয়েছিল৷ আহত হয়েছিলেন বহু৷ হত্যাকাণ্ডের স্থান থেকে থানা ছিল পাঁচ মিনিটের হাটা পথ। অথচ একঘন্টার উপরে সংগঠিত হত্যাকাণ্ডে জ্যোতি বসুর পুলিশের আসার ফুরসৎ হয়নি। সংগঠিত ঘটনাটা নিয়ে বিকেলে দমদম বিমানবন্দরে তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসু বিবৃতি দিলেন, "এটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা৷" তার চেয়েও একধাপ এগিয়ে সিপিএম পার্টির রাজ্য সম্পাদক প্রমোদ দাশগুপ্ত বিবৃতি দিলেন, "সাধারণ জনগণ এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে৷ "
বিভিন্ন কারণে তৎকালীন বাম সরকারের চক্ষুশূল হয়ে উঠেছিল আনন্দমার্গ। তাই নৃশংস, বর্বরোচিত ঘটনাটি ঘটিয়ে শাসক বামদের প্রধান লক্ষ্য ছিল সন্ত্রাসের পরিবেশ সৃষ্টি করে ভয় দেখানো। সে কারণে বাড়বাড়ন্ত আনন্দমার্গীদের শিক্ষা দিতে ষড়যন্ত্রের রোডম্যাপ বা রূপরেখা তৈরী হয় ১৯৮২ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি। তবে চূড়ান্ত রূপরেখাটি বাস্তবায়িত করেন কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়, রবীন দেবরা, এমনটি আনন্দমার্গী সাধুদের অভিযোগ৷ সাধুদের বর্ণনা মতে,১৯৮২ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারি পিকনিক পার্কে একটি কনভেনশন ডাকা হয়৷ সেই কনভেনশনে উপস্থিত থাকা ক্ষমতাসীন বাম নেতারা প্রত্যেকেই আনন্দমার্গের বিরুদ্ধে জ্বালাময়ী ভাষণ দিয়ে সবাইকে উত্তেজিত করে। আনন্দমার্গের তথ্যানুযায়ী সেদিনের কনভেনশনে যারা উপস্থিত ছিলেন, তারা হলেন: সত্যসাধন চক্রবর্তী, কান্তিগাঙ্গুলী (তৎকালীন কমিশনার যাদবপুর পুরসভা ও প্রাক্তন মন্ত্রী), সুজন চক্রবর্তী , সন্তোষ মিত্র , ক্ষুদিরাম ভট্টাচার্য, গঙ্গাধর নস্কর, রবীনদেব , বিজনবিহারী পুরকায়স্থ, অধ্যাপক নির্মাল্য বাগচী, অধ্যাপক অবন্তীকুমার সান্যাল, অধ্যাপক রথীন্দ্র নারায়ণ বসু, রজত বন্দ্যোপাধ্যায়, মিহির চট্টোপাধ্যায় (নাট্যকার), আশুতোষ সেন (অ্যাড্ভোকেট), কবি অরুণ মিত্র, বাদল দাশগুপ্ত, সুনীল চক্রবর্ত্তী (চেয়ারম্যান যাদবপুরপুরসভা), বীরেন ঘোষ (ভাইস চেয়ারম্যান, যাদবপুর পুরসভা) প্রশান্ত দাশগুপ্ত (কমিশনার যাদবপুর পুরসভা), প্রণব সেন (কমিশনার যাদবপুর পুরসভা), অধ্যাপক রবি রায়।
ঘটনার ঠিক একদিন আগে হত্যাকাণ্ডের চূড়ান্ত ছক নিয়ে ২৯ এপ্রিল কান্তি গঙ্গোপাধ্যায়ের সভাপতিত্বে সন্তোষপুর লোকাল কমিটির সেক্রেটারি স্বপন চক্রবর্ত্তী ওরফে বাবলু, রামনাথ সিং, অর্জুন মুখোপাধ্যায়, গোপাল রায়, নির্মল হালদার সহ সিপিএমের বেশ কিছু কর্মীদের রুদ্ধদ্বার বৈঠক হয়৷ সে মিটিংয়েই আনন্দমার্গীদের হত্যার ছক পুরোপুরি তৈরি করে দায়িত্ব বণ্টন করে দেয়া হয়৷ সে ছকানুসারেই প্রথমে আনন্দমার্গীদের বিরুদ্ধে বারবার মিছিল করে পরিস্থিতি উত্তপ্তের চেষ্টা করা হয়৷
পরিকল্পনা অনুসারে সিপিএমের সন্ত্রাসী ক্যাডারবাহিনী বিজন সেতু, বালিগঞ্জ রেলওয়ে স্টেশন ও বালিগঞ্জ রেলওয়ের জিনিসপত্র রাখার স্থান এ তিনভাগে বিভক্ত হয়ে আনন্দমার্গীদের জন্যে অপেক্ষা করতে থাকে৷ তিনটি দলের নেতৃত্ব দেয় বাবলু, রামনাথ সিং ও নির্মল হালদার ও কুখ্যাত বাহিনী৷ যখনই আনন্দমার্গীরা তিলজলার আশ্রমের দিকে যায় তখন তাদের উপরে আক্রমণ করে ক্যাডার বাহিনী। এ হত্যাকাণ্ড সংগঠিত করার জন্যে এ তিনটি দলের কাছে আগে থেকেই প্রচুর পরিমাণে জ্বালানিও মজুত রাখা হয়েছিল৷ এভাবেই সুপরিকল্পিতভাবে প্রকাশ্য দিবালোকে ঝরে পরে নিরস্ত্র ১৭ জন সন্ন্যাসীর জীবন।
মানবসভ্যতার ইতিহাসে অন্যতম পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড এটি।
কিন্তু এ হত্যাকাণ্ডের সাথে যুক্ত ব্যক্তিদের আজ ৩৮ বছরেও বিচার হয়নি, সাজা হয়নি। বিচার দীর্ঘসূত্রিতার কারণে হত্যাকারীদের অনেকেই মৃত্যুবরণ করেছেন। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ক্ষমতায় আসার পরে ঘটা করে বিচারপতি লালা’র নেতৃত্বে যে কমিশন গঠন করেছিলেন -সে কমিশনও অদৃশ্য ইংগিতে ঠূঠো হয়ে বসে আছে। ২০২০ সালের ১৬ এপ্রিল মহারাষ্ট্রে পুলিশের সামনে প্রকাশ্যে দুইজন সন্ন্যাসী এবং তাদের ড্রাইভারকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। হতভাগ্য সন্ন্যাসীরা হলেন সুনীলগিরি মহারাজ (৩৫), কল্পবৃক্ষগিরি মহারাজ(৭০) এবং গাড়ির চালক নীলেশ তেলগড়ে। মুম্বাইয়ের কান্দিবালি থেকে সুরাটে তাঁদের গুরুর অন্তিম সংস্কারের উদ্দেশ্যে তাঁরা রওনা হয়েছিলেন । দেশব্যাপী লকডাউনের জেরে মুম্বাই-গুজরাট বর্ডার এলাকায় পুলিশ তাঁদের ফেরত পাঠিয়ে দেয় । এরপর পালঘরের একটি গ্রামের কাছাকাছি আসতেই দুই সন্ন্যাসীকে পাথর ও লাঠি দিয়ে নৃশংসভাবে হত্যা করে। আশ্চর্যের বিষয় হিন্দু সাধু হত্যার জন্যে ১৯৮২ সালেও ছেলে ধরা গুজব তুলে হত্যা করেছিল; আজ ২০২০ সালেও কল্পবৃক্ষ গিরিদের হত্যা করেছে ছেলেধরা গুজব তুলে। স্টাইলটি একই। মতাদর্শও একই।
অধুনা নওমুসলিম কবির সুমন ঢাকায় এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন,
১৯৯৯ সালের ২৩ জানুয়ারি যেদিন ওড়িশাতে অস্ট্রেলিয়ান খ্রিস্টান পাদ্রি গ্রাহাম স্টেইন মারা যান, সেদিনই নাকি তিনি ঠিক করেছেন তিনি তার ধর্ম ত্যাগ করবেন। গ্রাহাম স্টেইনের হত্যাকারীদের সাথে হিন্দু ধর্মের কোন সম্পর্ক নেই, স্থানীয় গরিব আদিবাসীদের সাথে খ্রিস্টান মিশনারীদের বিরোধ ছিল হত্যাকাণ্ডের অন্যতম কারণ। কিন্তু ১৯৮২ সালে কোলকাতায় যখন প্রকাশ্য ১৭ জন সন্ন্যাসীকে হত্যা করা হয় তখন এ হত্যাকাণ্ডের সাথে সরাসরি যুক্ত বাম শাসকদের কর্মী, সমর্থক এবং উচ্ছিষ্টভোগি ছিল সুমন। তথাকথিত বুদ্ধিজীবী সুমনের কি তখন মনে হয়নি, মতাদর্শের ভিন্নতায় যারা প্রকাশ্য মানুষকে হত্যা করতে পারে তারা কি আদতে মানুষ? সুমন কিন্তু খুনীদের মতাদর্শ আকরে থেকে কলা-মূলা খেয়েই গেছেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের আশ্রয়ে-প্রশ্রয়ে আসার আগ পর্যন্ত। সুমনের মত পশ্চিম বাংলার তথাকথিত সেকুলার বুদ্ধিজীবীরা আজও একচোখা। তারা দিবান্ধ, দেখেও দেখেন না; শুধুমাত্র নিজ স্বার্থেই তাদের চোখ খোলে। তথাকথিত বামপন্থী বুদ্ধিজীবীরা দিনরাত্রি যাদের অসহিষ্ণু বলে, ফ্যাসিবাদী বলে, দিনশেষে তারা নিজেরাও জানে; তারা আদতে মতাদর্শের নামে দলকানা ফ্যাসিস্টদের আজ্ঞাবহ দাস।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।