
১৪ সেপ্টেম্বর, ২৮ ভাদ্র, মঙ্গলবার বিকাল ৫.৩০ আমার জন্ম হয় বরিশাল সদর হাসপাতালে। বরিশালের কাউনিয়া আমার মামাবাড়ি। ছোটবেলায় আমার জীবনের বিশাল একটি অংশ কাটিয়েছি মামাবাড়িতে। মামাবাড়ির মামি মাসিরা বিশেষ করে আমার ছোটমাসি টুলি মাসি আমাকে আনেক ভালবাসত। বর্তমানের মত জন্মদিন সে সময়ে পালিত হত না, জন্মদিনগুলো ছিল সম্পূর্ণভাবে ঘরোয়া। হিন্দু ঐতিহ্যবাহী পরিবারগুলোতে ঐতিহ্য ছিল, জন্মদিনে গুরুজনেরা মাথায় ধানদূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করবে, মিষ্টান্ন তৈরি করা হবে ইত্যাদি এদেশীয় সংস্কার। দূর্বাকে অমর বলা হয়, দূর্বা যেখানেই পরে সেখান থেকেই নতুনভাবে বংশবৃদ্ধি ঘটায়। এ কারণেই জীবনে শতবছর পূর্ণায়ুর জন্যে দূর্বা দিয়ে আশীর্বাদ করা হয়। ধান সমৃদ্ধি এবং অন্নের প্রতীক, তাই আশীর্বাদ করতে দূর্বাঘাসের সাথে মাথায় ধান দেয়া হয় সমৃদ্ধি এবং পূর্ণায়ুর কামনা করে। জন্মদিনের দিন, যার জন্মদিন তার কল্যাণ কামনা করে দেবতাদের ভোগ নিবেদন করা করা হয়, দুধের মিষ্টান্ন তৈরি করে দেয়া হয়। আমাদের স্মৃতিশাস্ত্রে জন্মদিনের কৃত্যাদি বর্ণনা করা আছে; যে কিভাবে জন্মদিন পালন করতে হবে। ইদানীং সেই শাস্ত্রীয় করনীয় বিষয়গুলো থেকে আমাদের মনযোগ সরে পশ্চিমা সংস্কৃতির দিকে অনেকটা চলে গেছে।
শাস্ত্রীয় জন্মদিনের পদ্ধতির সাথে অধুনা পশ্চিমা সংস্কৃতির কয়েকটি আচার যুক্ত হয়েছে। এরমধ্যে অন্যতম দুটি আচার হল কেককাটা এবং কেককাটার আগে মোমবাতি নিভিয়ে ফেলা। কেক শব্দটির বাংলা অর্থ হয় পিঠা। জন্মদিনে এই কেক বা পিঠা কেন কাটতে হয়, তা আমার ঠিক বোধগম্য নয়। তবে জীবনের অখণ্ড পরমায়ু কেটেকেটে ভাগ করে আমরা ভোগ করে মৃত্যুর পথে এগিয়ে যাচ্ছি; কেক কাটার মূলে এ দার্শনিক ভাবটিও গ্রহণ করা যায়। তাই কেককাটা পশ্চিমা সংস্কৃতি হলেও আপত্তিকর নয়। আমাদের শিশুদের কাছে এটি অত্যন্ত জনপ্রিয়। শিশুরা কেক না কাটতে পারলে তাদের মন খারাপ হয়ে যায়, শিশুমনে কষ্ট পায়। কিন্তু জন্মদিনে পশ্চিমা সংস্কৃতিতে অন্য আরেকটি আচার হল কেককাটার আগে মোমবাতি নিভিয়ে ফেলা। এ আচারটি আপত্তিকর, আমাদের এ ভূখণ্ডের সংস্কৃতির যাথে মানানসই নয়। জন্মদিনে আমরা চাই সকলের জীবনের প্রদীপগুলো, আশার প্রদীপগুলো আরও বেশী করে প্রজ্জ্বলিত হোক। প্রদীপের আলোয় জীবনের অন্ধকার আলোকিত হয়ে উঠুক। তাই বেদমন্ত্রে আছে:
অসতো মা সদ্গময়,তমসো মা জ্যোতির্গময়,মৃত্যোর্মামৃতং গময়েতি।(বৃহদারণ্যকোপনিষদ:১.৩.২৮)
"হে প্রভু, অসৎ পথ হতে আমাকে সৎ পথে নিয়ে যাও, অন্ধকার হতে আলোতে নিয়ে যাও, মৃত্যু হতে অমৃতে নিয়ে যাও।"
জীবনের প্রতীক প্রদীপটি আমরা চাই প্রজ্জ্বলিত থাকুক, জীবনের প্রত্যেকটি বছরের প্রতীক মোমবাতিগুলো জ্বলতে থাক সাধ্যমত। আমরা চাইনা মোমগুলো হঠাৎ নিভে যাক, আমরা চাইনা জীবনের আলো নিভে যাক। তাই আমরা প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করে জন্মদিন করতে চাই, নিভিয়ে দিয়ে জীবনকে অন্ধকার করে দিয়ে নয়। অন্যান্য সংস্কৃতির অপ্রয়োজনীয় অংশ ছুড়ে ফেলে আমরা বিভিন্ন সংস্কৃতির ভাল অংশটুকু গ্রহণ করতে চাই। এ প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছেন, পশ্চিমের জ্ঞানের সাথে ভারতবর্ষের জ্ঞানের দ্বারকে যুক্ত করতে হবে। তাদের থেকে যতটুকু প্রয়োজনীয় ততটুকুই গ্রহণ করব। অন্ধের মত অনুসরণ নয়। "দিবে আর নিবে, মিলাবে মিলিবে" -এভাবেই জ্ঞানের আদানপ্রদানেই আমরা সমৃদ্ধ হব।
পাশ্চাত্য সংস্কৃতির অনুসরণে মোমবাতি নিভিয়ে জন্মদিন পালন করাটা আমাদের সংস্কৃতির সাথে ঠিক যায় না। আমরা মন্দিরে গেলে প্রথমেই দীপ প্রজ্জ্বলিত করি, সকল পূজা, গৃহ প্রবেশ, দীপাবলি সহ সকল উৎসবে আমরা প্রদীপ বা মোমবাতির আলোয় আলোকিত করি। অন্ধকার করে কোন মাঙ্গলিক কাজ আমরা শুরু করি না। ভগবান শ্রীরামচন্দ্রের লঙ্কায় রাবনকে হত্যা করে অযোধ্যা আগমন উপলক্ষে অযোধ্যাবাসী সারা নগরের দুইপাশে প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করেছিল। সেই দিনটিকে স্মরণ করে আজও পালিত হয় দীপাবলি উৎসব। জন্মদিন আনন্দের দিন, তাই আনন্দের দিনে প্রদীপ নিভিয়ে, মোমবাতি নিভিয়ে জন্মদিন পালন করাটা অযৌক্তিক। কেকের পাশে জীবনের প্রত্যেকটি বছরের নামে একএকটি মোমবাতি জ্বালিয়ে দেয়া হয়। সেই মোমবাতিগুলো নিভিয়ে দিয়ে, নিজের অজান্তেই আমরা সেই ব্যক্তির জীবনকে অন্ধকারাচ্ছন্ন হবার জন্য আশীর্বাদ করছি। বেদে বলা হয়েছে, অন্ধকার হতে আলোতে নিয়ে যাওয়ার জন্য, অথচ আমরা জন্মদিনের মত আনন্দের উৎসবকে মোমবাতি নিভিয়ে অন্ধকার বানিয়ে পালন করছি; বিষয়টি হাস্যকর। প্রদীপ প্রজ্জ্বলিত করার শ্লোকগুলো অসাধারণ। সেই শ্লোকগুলোতে প্রদীপের জ্যোতিকে শক্তিস্বরূপা বলা হয়েছে এবং প্রসন্নতা, সমৃদ্ধি, সুস্বাস্থ্য, ধনসম্পদের প্রাচুর্য্য, শত্রুবুদ্ধিকে বিনাশ সহ সকল কল্যাণের আধার বলা হয়েছে।
ত্বং জ্যোতিঃ শ্রী রবিশ্চন্দ্রো বিদ্যুৎসৌবর্ণতারকাঃ।সর্বেষাং জ্যোতিষাং জ্যোতি-দীপজ্যোতিঃস্থিতে নমঃ।।শুভং করোতি কল্যাণং আরোগ্যং ধনসম্পদা।শত্রুবুদ্ধি বিনাশায় দীপ জ্যোতির্নমোঽস্তুতে।।
"হে জ্যোতির্ময়ী, তুমি সূর্য, চন্দ্র,বিদ্যুৎ, সুবর্ণ এবং নক্ষত্রসহ সকল জ্যোতির্ময় বস্তুর জ্যোতি। এই প্রদীপের জ্যোতিতেও তুমি বিরাজিতা, তোমায় প্রণাম।আমি দীপজ্যোতিঃকে প্রণাম জানাই, যা প্রসন্নতা, সমৃদ্ধি, সুস্বাস্থ্য, ধনসম্পদের প্রাচুর্য্য আনে এবং শত্রুবুদ্ধিকে বিনাশ করে।"
জন্মদিন পালন নিয়ে খুব একটা মাথাব্যথা কোনদিনই ছিল না আমার। কিন্তু জন্মদিন যে নিরস ৩৬৫ টি দিনের মধ্যে সরস আনন্দঘন একটি দিন ; এ বিষয়টি প্রথম উপলব্ধি করলাম প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে। এখনো স্মৃতিতে হিরণ্ময় অক্ষরে ধরা আছে ২০০৩ সালে জগন্নাথ হলে অনুষ্ঠিত প্রথম জন্মদিনের স্মৃতিটি। ১৩ সেপ্টেম্বর রাত্রে ক্যান্টিন থেকে খেয়েদেয়ে অন্য আর পাঁচটি রাতের মতই আমি আমার ২৬২ রুমে আসি। তখনও বুঝতে পারিনি আমার জন্যে অপেক্ষা করছে একরাশ বিস্ময় এবং ভালবাসা। আমি পুকুরের পাড় সহ হলে ঘোরাঘুরি করে ১১. ৩০ এর পরে আমার রুমে আসি। এসে দেখতে পাই, রুমের সিনিয়র বিকাশদার নেতৃত্বে একটি কেক আনা হয়েছে এবং সাথে আনা হয়েছে জন্মদিনের বিভিন্ন উপহার। তখন আমি অনেকটা প্রথাবদ্ধ ঘরাণার ছিলাম। জন্মদিনের আয়োজন দেখে আমি বলতে থাকি, রাত্রি ১২ টার পরে জন্মদিন এটা আমাদের সংস্কৃতি না, কেককাটা এটা আমাদের সংস্কৃতি না। আমি এই কেক কাটতে পারব না এবং রাত্রি ১২ টার পরে মধ্যরাতে জন্মদিনও পালন করতে পারব না।কিন্তু কে শোনে আমার কথা। তাদের ভালবাসায় পরে আমাকে হার মানতে হল।
সেই রাত্রে আমার উপলব্ধি হল, বন্ধুবান্ধব নিয়ে জন্মদিন পালন ; শুধুই একটি অনুষ্ঠান নয়। এর মাধ্যমে আশেপাশের সকলের সাথে পারস্পরিক সম্পর্কের উন্নয়ন ঘটে। এ জগতে প্রত্যেকটি মানুষ দিনশেষে আত্মকেন্দ্রিক এবং স্বার্থপর। স্বার্থের সুতায় বদ্ধ জগতের সকল সম্পর্ক। স্বার্থের স্বার্থপর পুতুল হয়ে আমরা পৃথিবীর নাট্যমঞ্চে ৩৬৫ দিন খেলছি; অভিনয় করছি। এই ৩৬৫ দিনের মধ্যে একটি দিন যদি একজনের প্রতি সকল পরিবার,পরিজন, বন্ধু, বান্ধবরা সময় দেয় ; তবে ক্ষতি কি? সকলের ভালবাসায় স্নাত হয়ে সেই একটি দিন, ব্যক্তিটির জীবনে অক্ষয় স্মৃতি হয়ে থাকে। বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও উপলব্ধি করেছিলেন। তাই তিনি নিজেই স্বেচ্ছায় সবাইকে নিয়ে তাঁর জন্মদিন পালন করতেন। নিজ জন্মদিনকে উপলক্ষ করে, তিনি বেশকিছু কবিতা সহ বিবিধ লেখা লিখেছেন। অসুস্থ অবস্থায় ১৯৪১ সালে তাঁর জীবনের শেষ জন্মদিন পালন করেন। ৬ মে সকালবেলা শান্তিনিকেতনের উদয়নে বসে তাঁর জন্মদিন প্রসঙ্গে একটি অনন্য কবিতা লিখেছিলেন। কবিতাটি তাঁর মৃত্যুর পরে 'শেষলেখা' কাব্যগ্রন্থে প্রকাশিত হয়।
"আমার এ জন্মদিন-মাঝে আমি হারাআমি চাহি বন্ধুজন যারাতাহাদের হাতের পরশেমর্ত্যের অন্তিম প্রীতিরসেনিয়ে যাব জীবনের চরম প্রসাদ,নিয়ে যাব মানুষের শেষ আশীর্বাদ।শূন্য ঝুলি আজিকে আমার;দিয়েছি উজাড় করিযাহা-কিছু আছিল দিবার,প্রতিদানে যদি কিছু পাইকিছু স্নেহ, কিছু ক্ষমাতবে তাহা সঙ্গে নিয়ে যাইপারের খেয়ায় যাব যবেভাষাহীন শেষের উৎসবে।"
১৩ সেপ্টেম্বর রাত্রে রুমমেটদের সাথে প্রাকজন্মদিন পালনের পরে, আমার জন্যে আরও বিস্ময় অপেক্ষা করেছিল পরেরদিন। আমার বন্ধুদের মধ্যে যারা একটু নেতাগোছের, তাদের কয়েকজন আমাকে বললো, বন্ধু রাত্রি নয়টার দিকে হলের উপাসনালয়ের সামনে থাকবি, রাত্রে আমরা একসাথে খাব। জগন্নাথ হলে আবাসিক আমাদের ২০০২-০৩ সেশনের অনেককেই বলা হল থাকতে। আমি প্রথমে বুঝতে পারিনি, কিন্তু রাতে যখন উপস্থিত হলাম ; তখন আমার বিস্ময়ের ঘোর চলে আসল। আমি দেখলাম আমাদের সেশনের অনেক বন্ধুরাই উপস্থিত, হাতে ফুল সহ বিভিন্ন উপহার সামগ্রী নিয়ে। বিষয়টি আমার কাছে নতুন ছিল, তাই বুঝতে পারছিলাম না কি হচ্ছে এবং হতে যাচ্ছে। শুধু এতটুকই অনুভব হচ্ছিল যে, আমার মধ্যে একটা ভালালাগা কাজ করছিল।
উপাসনালয়ের সামনে থেকে জড়ো হয়ে সবাই পরে চলে গেলাম মাঠের গ্যালারিতে। অন্ধকারে মোমবাতি জ্বালিয়ে 'ক্যান্ডেল পার্টি' হবে। যেহেতু বিরানির প্যাকেট ছিল, মন্দিরের সামনে খাওয়াটা দৃষ্টিকটু তাই মাঠের গ্যালারিতে যাওয়া হল। অন্ধকার গ্যালারিতে জ্বলজ্বল করছে মোমের আলো, শুরু হল সেখানে আমাদের বন্ধুদের প্রতিভা প্রদর্শন। কেউ গান, কেউ কবিতা, কেউ কৌতুক, কেই বা বক্তব্য শুরু করে দিল। প্রশান্ত মণ্ডল নামে এক বন্ধু, ওকে আমরা মাইকেল নামেই ডাকতাম; মাইকেল আমাকে নিয়ে একটি সনেট কবিতা লিখেছিল।আমি বিস্মিত হলাম, আমাকে নিয়ে আবার সনেট! মাইকেল যখন তার মাইকেল নামটি স্বার্থক করে, তার স্বলিখিত সনেটটি পাঠ করে, ওর প্রতিভার পরিচয় দিচ্ছিল; তখন আমি লজ্জায় মুখ তুলতে পারছিলাম না। হঠাৎ করে একরাশ লজ্জা চলে আসে কোথা থেকে। কবিতাটির নাম ছিল 'কুশলকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা সনেট।'
"কুড়ি বসন্তের সুস্বপ্নের কোলাহলেশত শত ভাললাগা স্পন্দনের কোলেলক্ষ নক্ষত্রের আলো নিংড়ানো বেলাশুরু করে রঙিন চিত্রপটের খেলাধুধু মরুচর বুকে একান্ত গোপনেফিরে ফিরে আসে লাজুক চাঁদ স্বপনেকেউ কেউ আঁচড় কাটে ক্ষরণ ঘাটেভাবুক হৃদয়ে অবুজ-সবুজ বাটে।লগন পেরিয়ে যায় কলা কলা কথাবাঁশের বাঁশিতে জাগে ঘুণ ধরা ব্যথাসাধিকা মেঘ হয়ে যায় জলজ কালোরক্তিম নক্ষত্র মুছে ফ্যালে সাদা আলোইচ্ছেরা ফিরে আসে একদিন দহনেললনা তখনো স্বপ্ন উড়ায় স্বপনে।"
সেদিনের জন্মদিনের প্রসঙ্গে আরেকজনের স্মৃতি মনে পড়লে আজও নিজের অজান্তেই হাসি পায়। সে হল সুরেশ বিশ্বাস, আমাদের সাথেই সংস্কৃত বিভাগে পড়ত, বয়সে আমাদের থেকে কয়েকবছরের বড় ছিল। ওর বাড়ি ছিল গোপালগঞ্জে। সে সময়ে যেহেতু হলে ছাত্রদলের আধিপত্য ছিল, ও তখন ওর নিজস্ব ভঙ্গিতে এক রাজনৈতিক সচেতনতা সংক্রান্ত ঝাঁঝালো বক্তব্য দেয়। সহপাঠী সকল শ্রোতার মুহুর্মুহু করতালিতে সুরেশের বক্তব্য স্বরসপ্তকের চূড়ায় পৌঁছে যায়। শুকনা টিনটিনে দেহ, দুইগালে মেছতার গোলগাল দাগ ; বক্তব্যের সময়ে চোখের মণিটি মাঝখানে থাকত। ওর বক্তব্যে আমার জন্মদিনের অনুষ্ঠানটি কিছুক্ষণের মধ্যেই একটি প্রগতিশীল ছাত্ররাজনীতির মঞ্চে পরিণত হয়ে যায়। যেহেতু আমার জন্মদিন, প্রথমে সকল ঝোঁক ছিল আমার দিকে; পরে এ সকল ঝোঁক চলে গেল আমাদের সংখ্যালঘুদের অধিকার, বঞ্চনা এবং না পাওয়া দুঃখবেদনার দিকে।বিষয়গুলো নিয়ে অনেকেই বক্তব্য রাখল, আমিও আমার নিজস্ব দৃষ্টিভঙ্গিতে বক্তব্য রাখলাম। পরবর্তীতে সেই রাতের বক্তব্যের কারণে, হলে হঠাৎ জনপ্রিয় হয়ে যায় সুরেশ।আমাদের বন্ধুমহলে সুরেশ পায় একটি নতুন নাম, 'নেতা'। বিষয়টি নিয়ে আমাদের ইয়ারের অনেকেই সুরেশের সাথে মাঝেমধ্যে মজা করত।
সেদিন থেকে ঘটনাচক্রে আমরা যারা সহপাঠী ছিলাম, তাদের মধ্যে কয়েকজনের সাথে পরবর্তীতে এক গভীর বন্ধুত্ব তৈরি হয়ে যায় আমার।যে বন্ধুত্ব এখনও অক্ষুণ্ণ আছে। এদের মধ্যে প্লাবন মজুমদার, উত্তম বিশ্বাস এবং দেবাশীষ বিশ্বাস অন্যতম। জন্মদিনে আমাকে দেয়া অনেক উপহারের মধ্যে একটি উপহার আমার খুব পছন্দ হয়, সেটি হল রবীন্দ্রনাথের একটি সম্পূর্ণ সিরামিকের দাড়ানো মূর্তি। রবীন্দ্রনাথের মূর্তিতে হলে আমার পড়ার টেবিলের উপরে থাকত। পড়ার ফাঁকে ফাঁকে রবীন্দ্রনাথকে দেখতাম। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দিকে তাকিয়ে প্রতিদিন বিস্মিত হতাম।একজন্মে একজন মানুষের এত বৈচিত্র্যময় প্রতিভা কি করে সম্ভব? রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সহ বিভিন্ন মূর্তিগুলি তখন কার্জনহলের সামনে ফুটপাতের দোকানগুলোতে প্রচুর পাওয়া যেত। বর্তমানে মৌলবাদীদের রক্তচক্ষুর কারণে মাটির অন্যান্য বস্তু পাওয়া গেলেও, বিভিন্ন প্রকারের মূর্তির সরবরাহ একদমই কমে গেছে। ঘটনাটি শুধু কার্জনহলের সামনেই নয়, শাহবাগ আজিজ মার্কেটের মার্বেল ডাস্টের একমাত্র 'মর্মর' নামক দোকানটিও বন্ধ হয়ে গেছে।মর্মর' নামক দোকানটি বন্ধের পিছনে কারণটিও একই।
বন্ধু এবং রুমমেটদের আয়োজনে ২০০৩ সালে হলে প্রথম জন্মদিনের পরে, প্রতিবছর এ জন্মদিনের আয়োজন এবং অংশগ্রহণকারীদের সংখ্যা বাড়তেই থাকে। একজনকে না বললে অন্যজন মনক্ষুন্ন হয়। আমি বুঝতে পারলাম বন্ধুদের স্বতঃস্ফূর্ত সেই জন্মদিনটি হারিয়ে গেছে, এখন সেটি দিনেদিনে সামাজিক দায়বদ্ধতায় পরিণত হয়েছে। যতবেশী সকলের সাথে হলে পরিচিত হচ্ছি, আমাকে সবাই ভালবাসছে ; ততই বেশী আমি দায়বদ্ধতার শৃঙ্খলে জড়িয়ে যাচ্ছি। মানুষের ভালবাসা যেমন বাড়ছে, তাদের আমার প্রতি প্রত্যাশাও বাড়ছে। এ সামাজিক দায়বদ্ধতা দিনে দিনে হাতির মত হয়ে যাচ্ছে, যা বহন করা সর্বদা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। মনে হল এর থেকে আমার একটি সাময়িক বিরতি প্রয়োজন। এরমধ্যেই ২০০৭ সালের আগস্ট মাসে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে ছাত্র-সেনাদের মধ্যে এক অনাকাঙ্ক্ষিত সংঘর্ষ ভুলবোঝাবুঝি হয়। কয়েকজন শিক্ষক ও ছাত্র লাঞ্চিত হয়। সে প্রেক্ষাপটে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনির্দিষ্টকালের জন্যে বন্ধ হয়ে যায়। হল বন্ধের প্রায় একমাস পরে সেপ্টেম্বর মাসের মাঝামাঝি আসে আমার জন্মদিন।জন্মদিনটি হল বন্ধের মধ্যেই পরে যায়। ফলে জজগন্নাথ হলে জন্মদিন পালনে একটি ছেদরেখা পরে যায়।
পরে মাসের পরে মাস বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকার পরে, আমরা ক্যাম্পাসে আসি ২০০৮ সালে। একবছর জন্মদিন পালনে ছেদ পরে যাওয়ায়, এরপরে সেই আগের মত জন্মদিন পালন করা আর হয়নি। পালনের আমেজটিই হারিয়ে ফেলি। এরপরে শুরু হয় হল থেকে চলে যাওয়ার প্রস্তুতি। ততদিনে অসংখ্য ছোটভাইদের ভালবাসায় স্নাত হতে থাকি। আমার জন্মদিনটি তখন রূপান্তরিত হয়, কাছের এবং স্নেহের ছোটভাইদের একটি পুনর্মিলনী অনুষ্ঠানে। বন্ধুদের পরিমণ্ডল ছাড়িয়ে দিনটি পায়, অন্য একটি ভালবাসার রূপ; যাদের কারো সাথেই নেই কোন স্বার্থের সম্পর্ক। প্রতিবছর জন্মদিন আসে আমাদের স্মরণ করিয়ে দিতে, আমাদের জীবনের মালা থেকে একটি একটি বছররূপ ফুল ঝড়ে পড়ছে।জীবনে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া শিক্ষাগুলি দেখে শুনেও, আমরা জীবনে খুব একটা ব্যবহার করি না।এরপরেও, নতুনভাবে জীবনকে দেখার এবং গড়ে তোলার প্রত্যাশা নিয়ে প্রতিবছর আসে জন্মদিন। বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর 'স্ফুলিঙ্গ' কাব্যগ্রন্থে অত্যন্ত সুন্দর করে বলেছেন:
"জন্মদিন আসে বারে বারেমনে করাবারে—এ জীবন নিত্যই নূতনপ্রতি প্রাতে আলোকিতপুলকিতদিনের মতন।"
জীবনে সম্পর্কগুলি বাইনারি নাম্বারের মত ০১,০১ করে এগিয়ে চলে। তাই আশাহত বা আশাবাদী কোনটিই চিরস্থায়ী নয়। জন্মদিনে অন্ততপক্ষে একদিনের জন্যে হলেও যদি কিছু মানুষের ভালবাসা পাওয়া যায়; তবে ক্ষতি কি? হোক না হয় সে ভালবাসা লোকদেখানো, এরপরেও হাতির দাঁতের মত লোকদেখানো ভালবাসার মাঝেমধ্যে প্রয়োজন আছে।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।