ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

আমাদের আবহমান ভালবাসা দিবস, ১৪ ফেব্রুয়ারির হাতে হাইজ্যাক হয়ে গেছে ।

খুবই আশ্চর্যজনকভাবে ভারতবর্ষীয় কামদেব মদন এবং রোমান-ইংরেজদের কামদেব কিউপিড (Cupid) দেখতে প্রায় একই রকমের। দুজনেই হাতে কামবাণ নিয়ে সর্বদা সকল প্রেমিক প্রেমিকাদের হৃদয়ে কামবাসনা বিদ্ধ করতে সদা ব্যস্ত। ভারতবর্ষীয় মদন বা কন্দর্পের আরেকটি নাম 'অতনু'। 'অতনু' শব্দের অর্থ হল যার দেহ নেই। কিন্তু বর্তমানে দেহধারী অনেক মানুষের নামই অতনু রাখা হয়; বিষয়টি মজার। কামদেব ইন্দ্রাদি দেবতাদের অনুরোধে তারকাসুরকে বধ করার জন্য যোগীরাজ শিবের ধ্যান ভঙ্গ করার প্রচেষ্টা করেন। কারণ ভগবান শিব জাগরিত না হলে শিবশক্তির মিলন হবে না। জগতের পিতামাতা  শিবশক্তির মিলন না হলে তারকাসুরকে বধ করা সম্ভব নয়।  কারণ, দেবতারা জানতে পেরেছে তারকাসুরকে একমাত্র শিবশক্তির মিলনে উৎপন্ন সন্তান কার্তিকেয়ই বধ করতে পারবে। এর ব্যতিরেকে জগতের কেউ তারকাসুরকে বধ তো দূরে থাক সামান্যতম ক্ষতিও করতে পারবে না। কামদেব দেবতাদের পরামর্শে ভগবান শিবের ধ্যান ভঙ্গের প্রয়াস গ্রহণ করেন। তিনি ধ্যানস্থ ভগবান শিবের প্রতি পঞ্চশর নিক্ষেপ করেন। ভগবান শিব বিরক্ত  এবং ক্রদ্ধ হয়ে তৃতীয় নেত্রের অগ্নিতে কামদেবকে ভস্মীভূত করে দেন। সেই থেকে কামদেব দেহহীন হয়ে অতনুরূপে বিরাজিত। কামদেব মদনের ভস্মসাৎ হয়ে যাওয়ার পৌরাণিক এ কাহিনীটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'কল্পনা' কাব্যগ্রন্থে সুবিখ্যাত দুটি কবিতা আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর  ১৩০৪ বঙ্গাব্দের ১১ জৈষ্ঠ এবং ১২ জৈষ্ঠ 'মদনভস্মের পূর্বে' এবং 'মদনভস্মের পর' নামে পর্যায়ক্রমে পরপর দুটি কবিতা রচনা করেন কামদেবের দেহধারী এবং দেহহীন এ দুটি অবস্থা  নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, কামদেব আগে  শরীরধারী একজন ব্যক্তি ছিলেন । কিন্তু তিনি ভগবান শিবের ক্রোধে ভস্ম হয়ে যাওয়ার পরে তিনি আরও অনন্ত শক্তিশালী হয়ে গেছেন।  কামদেবের দেহভস্মের ছাই  বায়ুকে অবলম্বন করে সমগ্র জগতের সকল প্রেমিক-প্রেমিকার হৃদয় গভীরে আশ্রয় নিয়েছে।  "পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ একি সন্ন্যাসী, বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে! ব্যাকুলতর বেদনা তার বাতাসে উঠে নিশ্বাসি, অশ্রু তার আকাশে পড়ে গড়ায়ে। ভরিয়া উঠে নিখিল ভব  রতিবিলাপ-সংগীতে,  সকল দিক কাঁদিয়া উঠে আপনি। ফাগুন মাসে নিমেষ-মাঝে না জানি কার ইঙ্গিতে  শিহরি উঠি মুরছি পড়ে অবনী। আজিকে তাই বুঝিতে নারি কিসের বাজে যন্ত্রণা  হৃদয়বীণাযন্ত্রে মহাপুলকে! তরুণী বসি ভাবিয়া মরে কী দেয় তারে মন্ত্রণা মিলিয়া সবে দ্যুলোকে আর ভূলোকে কী কথা উঠে মর্মরিয়া বকুলতরুপল্লবে, ভ্রমর উঠে গুঞ্জরিয়া কী ভাষা!" ('মদনভস্মের পর', ১৩০৪, ১২ জৈষ্ঠ)  কামদেবকে মানুষের বাসনা-নির্ধারক গ্রহগুলির অধিপতি বলে বর্ণনা করা হয়। তিনি অতি সুদর্শন যুবাপুরুষ, এক আশ্চর্য তির-ধনুক তাঁর অস্ত্র। তাঁর ধনুক নির্মিত হয়েছে ইক্ষুদণ্ড দিয়ে, ধনুকের জ্যা মধু দিয়ে, তিরগুলি নির্মিত হয়েছে অশোক, পদ্ম ও আম্রমুকুল দিয়ে। কামদেবের বাহন টিয়াপাখি। তাঁর পত্নী রতিদেবী হলেন তাঁর প্রকৃতি স্বরূপা শক্তি।কামদেবের বীজমন্ত্র হল ‘ক্লীং’। এ গুহ্যতর বীজমন্ত্র উচ্চারণে এবং জপে কামদেব অত্যন্ত  প্রসন্ন হন।প্রেমিক-প্রেমিকাদের হৃদয়ে প্রেমবিদ্ধ করতে তাঁর হাতে পঞ্চবাণ বা পঞ্চশর নামক এক ব্রহ্মাস্ত্র আছে। পাঁচটি ফুলের সৌরভে বৈশিষ্ট্যে বাণগুলি হল: পদ্ম,অশোক, আম্র, নবমল্লিকা ও রক্তোৎপল এ পাঁচটি। এই পাঁচটি পুষ্পশরের অন্য নামান্তর হল: সম্মোহন,উন্মাদন, শোষণ,তাপন এবং স্তম্ভন। কাম জীবনের একটি অঙ্গ। তাই আমরা কেউ চাইলেই কামের হাত থেকে খুব সহজে মুক্তি পাই না। যত কামকে এড়িয়ে থাকতে চাই, কাম ততই আমাদের আমাদের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে।তাই মহাভারতে বলা হয়েছে, কাম থেকে দূরে না থেকে যথাকালে ধর্ম, অর্থ ও কামের সেবা করতে। অর্থাৎ ধর্মের চর্চা করা উচিত, তেমনি অর্থের চর্চা করা উচিত, ঠিক তেমনি অপরিহার্যভাবে কামেরও চর্চা করা উচিত। ধর্ম, অর্থ এবং কামের চর্চার ফলাফল ইহকালের সাথেসাথে পরলােকেও পাবে। সনাতন ধর্ম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। তাই এ জীবন ব্যবস্থায় কামের পথ থেকে মোক্ষের পথ সকলেই আছে। এ পথগুলোকে চতুর্বর্গ বলে। এ চতুর্বর্গের কোন একটি বর্গই পরিত্যাজ্য নয়, প্রত্যেকটি প্রয়োজনীয়।কিন্তু তা আসক্তিহীনচিত্তে করতে হবে, তবেই এ চতুর্বর্গ ফলপ্রসূ হবে; নচেৎ নয়। যাে ধর্মমর্থৎ কামঞ্চ যথাকালং নিষেবতে। ধর্মার্থকামসংযােগং সােঽমুত্রেহ চ বিন্দতি।। (মহাভারত:উদ্যোগ পর্ব,৩৭.৫০) "যে লােক যথাকালে ধর্ম, অর্থ ও কামের সেবা করে, সে লােক ইহলােকে এবং পরলােকে ধর্ম, অর্থ এবং কামের অভিষ্ট ফল লাভ করে।" ভারতীয় কামদেব মদন এবং ইউরোপীয় কামদেব কিউপিড এ দুজনের মধ্যে পার্থক্য সামান্যতম।ভারতীয় কামদেব মদন যুবক এবং ইউরোপীয় কামদেব কিউপিড শিশু। বিষয়টি নিয়ে অনেকে রসিকতা করে বলে থাকেন, ভারতবর্ষীয়রা যুবক অবস্থায় কামের ফাঁদে পরে,পক্ষান্তরে ইউরোপীয়রা শিশুকাল থেকেই কামের ফাঁদে পরে। তাই হয়ত ভারতীয় এবং ইউরোপীয় কামদেবের এমন যুবক এবং শিশুর প্রভেদ। প্রাচীন ভারতবর্ষে বসন্তকালে কামদেবকে উৎসর্গ করে অনুষ্ঠিত হত 'মদনোৎসব'। বর্ণিল এ আনন্দ উৎসবে মেতে উঠতো সেকালের প্রেমিকযুগলেরা। বিষয়টি অসংখ্য সংস্কৃত গ্রন্থে বর্ণাঢ্যভাবে উল্লেখ করা আছে।  গুপ্তযুগকে ভারতবর্ষের স্বর্ণযুগ বলে আখ্যায়িত করা হয়। এই সময়ে শিল্প, সাহিত্য এবং কলাবিদ্যার চর্চা ব্যপকভাবে বিস্তৃত হয়। সাধারণত কামের চর্চা মানুষের সুখি এবং সম্পদসমৃদ্ধ কালেই বেশি ঘটে। তাই সে সময়কালে কামদেবের মন্দির এবং উপাসনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পরেছিল বিভিন্ন নগরে জনপদে। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের কাব্য, নাটক থেকে সেকালের কামদেবের উপাসনা সম্পর্কিত অসংখ্য তথ্য জানা যায়। সেকালে কামদেবের মন্দিরগুলি ছিল প্রেমিক-প্রেমিকাদের নিয়মিত বিহারের স্থান। শূদ্রকের বিখ্যাত ‘মৃচ্ছকটিকম্’ প্রকরণে সেকালের মদনোৎসবের বর্ণনা রয়েছে। মদন ত্রয়োদশী তিথিতে কামদেবের সন্তুষ্টির জন্যে তাঁর উদ্দেশ্যে মদনোৎসব আয়োজিত হত।বসন্তকালের চৈত্র পূর্ণিমার দুইদিন আগে মদন ত্রয়োদশী তিথিতে  মদনোৎসব বা প্রেমের দেবতা, কামের দেবতা মদনদেবের পূজা অনুষ্ঠিত হত। সাধারণত তরুণ-তরুণী এবং যুবক যুবতীরাই মদনদেবের পূজায় অংশগ্রহণ করতো। এই তিথিতে জৈন সম্প্রদায়ের 'মহাবীরজয়ন্তী' এবং সারা আসাম ব্যাপী 'দেউরী বিহু' অনুষ্ঠিত হয়। শুক্লপক্ষের এ মদন ত্রয়োদশী তিথিটি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা ভারতবর্ষীয় ভালবাসা দিবস।কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ভারতবর্ষে আবহমান কাল থেকে চলে আসা প্রেমিক যুগলের ভালবাসার রঙিন বর্ণাঢ্য এ পবিত্র তিথিটি হাইজ্যাক হয়ে গেছে ইউরোপীয় ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটির কাছে। কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী  সহকারী অধ্যাপক,  সংস্কৃত বিভাগ,  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

খুবই আশ্চর্যজনকভাবে ভারতবর্ষীয় কামদেব মদন এবং রোমান-ইংরেজদের কামদেব কিউপিড (Cupid) দেখতে প্রায় একই রকমের। দুজনেই হাতে কামবাণ নিয়ে সর্বদা সকল প্রেমিক প্রেমিকাদের হৃদয়ে কামবাসনা বিদ্ধ করতে সদা ব্যস্ত। ভারতবর্ষীয় মদন বা কন্দর্পের আরেকটি নাম 'অতনু'। 'অতনু' শব্দের অর্থ হল যার দেহ নেই। কিন্তু বর্তমানে দেহধারী অনেক মানুষের নামই অতনু রাখা হয়; বিষয়টি মজার। কামদেব ইন্দ্রাদি দেবতাদের অনুরোধে তারকাসুরকে বধ করার জন্য যোগীরাজ শিবের ধ্যান ভঙ্গ করার প্রচেষ্টা করেন। কারণ ভগবান শিব জাগরিত না হলে শিবশক্তির মিলন হবে না। জগতের পিতামাতা শিবশক্তির মিলন না হলে তারকাসুরকে বধ করা সম্ভব নয়। কারণ, দেবতারা জানতে পেরেছে তারকাসুরকে একমাত্র শিবশক্তির মিলনে উৎপন্ন সন্তান কার্তিকেয়ই বধ করতে পারবে। এর ব্যতিরেকে জগতের কেউ তারকাসুরকে বধ তো দূরে থাক সামান্যতম ক্ষতিও করতে পারবে না। কামদেব দেবতাদের পরামর্শে ভগবান শিবের ধ্যান ভঙ্গের প্রয়াস গ্রহণ করেন। তিনি ধ্যানস্থ ভগবান শিবের প্রতি পঞ্চশর নিক্ষেপ করেন। ভগবান শিব বিরক্ত এবং ক্রদ্ধ হয়ে তৃতীয় নেত্রের অগ্নিতে কামদেবকে ভস্মীভূত করে দেন। সেই থেকে কামদেব দেহহীন হয়ে অতনুরূপে বিরাজিত। কামদেব মদনের ভস্মসাৎ হয়ে যাওয়ার পৌরাণিক এ কাহিনীটি নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের 'কল্পনা' কাব্যগ্রন্থে সুবিখ্যাত দুটি কবিতা আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৩০৪ বঙ্গাব্দের ১১ জৈষ্ঠ এবং ১২ জৈষ্ঠ 'মদনভস্মের পূর্বে' এবং 'মদনভস্মের পর' নামে পর্যায়ক্রমে পরপর দুটি কবিতা রচনা করেন কামদেবের দেহধারী এবং দেহহীন এ দুটি অবস্থা নিয়ে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেন, কামদেব আগে শরীরধারী একজন ব্যক্তি ছিলেন । কিন্তু তিনি ভগবান শিবের ক্রোধে ভস্ম হয়ে যাওয়ার পরে তিনি আরও অনন্ত শক্তিশালী হয়ে গেছেন। কামদেবের দেহভস্মের ছাই বায়ুকে অবলম্বন করে সমগ্র জগতের সকল প্রেমিক-প্রেমিকার হৃদয় গভীরে আশ্রয় নিয়েছে।

"পঞ্চশরে দগ্ধ করে করেছ একি সন্ন্যাসী,
বিশ্বময় দিয়েছ তারে ছড়ায়ে!
ব্যাকুলতর বেদনা তার বাতাসে উঠে নিশ্বাসি,
অশ্রু তার আকাশে পড়ে গড়ায়ে।
ভরিয়া উঠে নিখিল ভব রতিবিলাপ-সংগীতে,
সকল দিক কাঁদিয়া উঠে আপনি।
ফাগুন মাসে নিমেষ-মাঝে না জানি কার ইঙ্গিতে
শিহরি উঠি মুরছি পড়ে অবনী।
আজিকে তাই বুঝিতে নারি কিসের বাজে যন্ত্রণা
হৃদয়বীণাযন্ত্রে মহাপুলকে!
তরুণী বসি ভাবিয়া মরে কী দেয় তারে মন্ত্রণা
মিলিয়া সবে দ্যুলোকে আর ভূলোকে
কী কথা উঠে মর্মরিয়া বকুলতরুপল্লবে,
ভ্রমর উঠে গুঞ্জরিয়া কী ভাষা!"
('মদনভস্মের পর', ১৩০৪, ১২ জৈষ্ঠ)
কামদেবকে মানুষের বাসনা-নির্ধারক গ্রহগুলির অধিপতি বলে বর্ণনা করা হয়। তিনি অতি সুদর্শন যুবাপুরুষ, এক আশ্চর্য তির-ধনুক তাঁর অস্ত্র। তাঁর ধনুক নির্মিত হয়েছে ইক্ষুদণ্ড দিয়ে, ধনুকের জ্যা মধু দিয়ে, তিরগুলি নির্মিত হয়েছে অশোক, পদ্ম ও আম্রমুকুল দিয়ে। কামদেবের বাহন টিয়াপাখি। তাঁর পত্নী রতিদেবী হলেন তাঁর প্রকৃতি স্বরূপা শক্তি।কামদেবের বীজমন্ত্র হল ‘ক্লীং’। এ গুহ্যতর বীজমন্ত্র উচ্চারণে এবং জপে কামদেব অত্যন্ত প্রসন্ন হন।প্রেমিক-প্রেমিকাদের হৃদয়ে প্রেমবিদ্ধ করতে তাঁর হাতে পঞ্চবাণ বা পঞ্চশর নামক এক ব্রহ্মাস্ত্র আছে। পাঁচটি ফুলের সৌরভে বৈশিষ্ট্যে বাণগুলি হল: পদ্ম,অশোক, আম্র, নবমল্লিকা ও রক্তোৎপল এ পাঁচটি। এই পাঁচটি পুষ্পশরের অন্য নামান্তর হল: সম্মোহন,উন্মাদন, শোষণ,তাপন এবং স্তম্ভন।
কামদেবকে মানুষের বাসনা-নির্ধারক গ্রহগুলির অধিপতি বলে বর্ণনা করা হয়। তিনি অতি সুদর্শন যুবাপুরুষ, এক আশ্চর্য তির-ধনুক তাঁর অস্ত্র। তাঁর ধনুক নির্মিত হয়েছে ইক্ষুদণ্ড দিয়ে, ধনুকের জ্যা মধু দিয়ে, তিরগুলি নির্মিত হয়েছে অশোক, পদ্ম ও আম্রমুকুল দিয়ে। কামদেবের বাহন টিয়াপাখি। তাঁর পত্নী রতিদেবী হলেন তাঁর প্রকৃতি স্বরূপা শক্তি।কামদেবের বীজমন্ত্র হল ‘ক্লীং’। এ গুহ্যতর বীজমন্ত্র উচ্চারণে এবং জপে কামদেব অত্যন্ত  প্রসন্ন হন।প্রেমিক-প্রেমিকাদের হৃদয়ে প্রেমবিদ্ধ করতে তাঁর হাতে পঞ্চবাণ বা পঞ্চশর নামক এক ব্রহ্মাস্ত্র আছে। পাঁচটি ফুলের সৌরভে বৈশিষ্ট্যে বাণগুলি হল: পদ্ম,অশোক, আম্র, নবমল্লিকা ও রক্তোৎপল এ পাঁচটি। এই পাঁচটি পুষ্পশরের অন্য নামান্তর হল: সম্মোহন,উন্মাদন, শোষণ,তাপন এবং স্তম্ভন।

কাম জীবনের একটি অঙ্গ। তাই আমরা কেউ চাইলেই কামের হাত থেকে খুব সহজে মুক্তি পাই না। যত কামকে এড়িয়ে থাকতে চাই, কাম ততই আমাদের আমাদের আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে ধরে।তাই মহাভারতে বলা হয়েছে, কাম থেকে দূরে না থেকে যথাকালে ধর্ম, অর্থ ও কামের সেবা করতে। অর্থাৎ ধর্মের চর্চা করা উচিত, তেমনি অর্থের চর্চা করা উচিত, ঠিক তেমনি অপরিহার্যভাবে কামেরও চর্চা করা উচিত। ধর্ম, অর্থ এবং কামের চর্চার ফলাফল ইহকালের সাথেসাথে পরলােকেও পাবে। সনাতন ধর্ম একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনব্যবস্থা। তাই এ জীবন ব্যবস্থায় কামের পথ থেকে মোক্ষের পথ সকলেই আছে। এ পথগুলোকে চতুর্বর্গ বলে। এ চতুর্বর্গের কোন একটি বর্গই পরিত্যাজ্য নয়, প্রত্যেকটি প্রয়োজনীয়।কিন্তু তা আসক্তিহীনচিত্তে করতে হবে, তবেই এ চতুর্বর্গ ফলপ্রসূ হবে; নচেৎ নয়।
যাে ধর্মমর্থৎ কামঞ্চ যথাকালং নিষেবতে।
ধর্মার্থকামসংযােগং সােঽমুত্রেহ চ বিন্দতি।।
(মহাভারত:উদ্যোগ পর্ব,৩৭.৫০)
"যে লােক যথাকালে ধর্ম, অর্থ ও কামের সেবা করে, সে লােক ইহলােকে এবং পরলােকে ধর্ম, অর্থ এবং কামের অভিষ্ট ফল লাভ করে।"
ভারতীয় কামদেব মদন এবং ইউরোপীয় কামদেব কিউপিড এ দুজনের মধ্যে পার্থক্য সামান্যতম।ভারতীয় কামদেব মদন যুবক এবং ইউরোপীয় কামদেব কিউপিড শিশু। বিষয়টি নিয়ে অনেকে রসিকতা করে বলে থাকেন, ভারতবর্ষীয়রা যুবক অবস্থায় কামের ফাঁদে পরে,পক্ষান্তরে ইউরোপীয়রা শিশুকাল থেকেই কামের ফাঁদে পরে। তাই হয়ত ভারতীয় এবং ইউরোপীয় কামদেবের এমন যুবক এবং শিশুর প্রভেদ। প্রাচীন ভারতবর্ষে বসন্তকালে কামদেবকে উৎসর্গ করে অনুষ্ঠিত হত 'মদনোৎসব'। বর্ণিল এ আনন্দ উৎসবে মেতে উঠতো সেকালের প্রেমিকযুগলেরা। বিষয়টি অসংখ্য সংস্কৃত গ্রন্থে বর্ণাঢ্যভাবে উল্লেখ করা আছে।
গুপ্তযুগকে ভারতবর্ষের স্বর্ণযুগ বলে আখ্যায়িত করা হয়। এই সময়ে শিল্প, সাহিত্য এবং কলাবিদ্যার চর্চা ব্যপকভাবে বিস্তৃত হয়। সাধারণত কামের চর্চা মানুষের সুখি এবং সম্পদসমৃদ্ধ কালেই বেশি ঘটে। তাই সে সময়কালে কামদেবের মন্দির এবং উপাসনা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পরেছিল বিভিন্ন নগরে জনপদে। প্রাচীন সংস্কৃত সাহিত্যের কাব্য, নাটক থেকে সেকালের কামদেবের উপাসনা সম্পর্কিত অসংখ্য তথ্য জানা যায়। সেকালে কামদেবের মন্দিরগুলি ছিল প্রেমিক-প্রেমিকাদের নিয়মিত বিহারের স্থান। শূদ্রকের বিখ্যাত ‘মৃচ্ছকটিকম্’ প্রকরণে সেকালের মদনোৎসবের বর্ণনা রয়েছে। মদন ত্রয়োদশী তিথিতে কামদেবের সন্তুষ্টির জন্যে তাঁর উদ্দেশ্যে মদনোৎসব আয়োজিত হত।বসন্তকালের চৈত্র পূর্ণিমার দুইদিন আগে মদন ত্রয়োদশী তিথিতে মদনোৎসব বা প্রেমের দেবতা, কামের দেবতা মদনদেবের পূজা অনুষ্ঠিত হত। সাধারণত তরুণ-তরুণী এবং যুবক যুবতীরাই মদনদেবের পূজায় অংশগ্রহণ করতো।
এই তিথিতে জৈন সম্প্রদায়ের 'মহাবীরজয়ন্তী' এবং সারা আসাম ব্যাপী 'দেউরী বিহু' অনুষ্ঠিত হয়। শুক্লপক্ষের এ মদন ত্রয়োদশী তিথিটি প্রাচীনকাল থেকে চলে আসা ভারতবর্ষীয় ভালবাসা দিবস।কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, ভারতবর্ষে আবহমান কাল থেকে চলে আসা প্রেমিক যুগলের ভালবাসার রঙিন বর্ণাঢ্য এ পবিত্র তিথিটি হাইজ্যাক হয়ে গেছে ইউরোপীয় ১৪ ফেব্রুয়ারি দিনটির কাছে।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁