ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

"মহো অর্ণঃ সরস্বতী প্রচেতয়তি কেতুনা"; দেবী সরস্বতী বৈদিককাল থেকেই পূজিতা ।

অচিন্ত্য পরমেশ্বরের জ্ঞানময় মূর্তি হচ্ছে দেবী সরস্বতী। তিনি ব্রহ্মের সৃষ্টিরূপ ব্রহ্মার শক্তি স্বরূপা। তাই তাঁর নাম ব্রহ্মাণী, সাবিত্রী এবং গায়ত্রী। দেবী সরস্বতী বৈদিককাল থেকেই পূজিতা। বেদ-বেদান্তে দেবী সরস্বতীর সাকার নিরাকার উভয় রূপেরই বর্ণনা পাওয়া যায়।কখনো তিনি বাকশক্তিরূপা, কখনো সৃষ্টিশক্তিরূপা, কখনো সাবিত্রী মন্ত্ররূপা, কখনো নদীরূপা অথবা কখনো ব্রহ্মাণ্ডের অধিশ্বরীরূপা। এ বিবিধরূপেই বেদ এবং বেদ পরবর্তী মহাভারত সহ একাধিক পুরাণে দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। বেদে প্রেরণাদাত্রী, চেতনাদাত্রী এবং জ্ঞানমূর্তি রূপই প্রকাশিত হয়েছে দেবী সরস্বতীর অসংখ্য বেদমন্ত্রে।  চোদয়িত্রী সূনৃতানাং চেতন্তী সুমতীনাং। যজ্ঞং দধে সরস্বতী॥  মহো অর্ণঃ সরস্বতী প্রচেতয়তি কেতুনা। ধিয়ো বিশ্বা বিরাজতি॥  (ঋগ্বেদ সংহিতা :১.৩.১১-১২) "সত্য ও প্রিয়বাণীর প্রেরণাদাত্রী এবং সৎবুদ্ধির চেতনাদাত্রী মাতা সরস্বতী শুভকর্মকে ধারণ করে আছেন।জ্ঞানদাত্রী মাতা সরস্বতী প্রজ্ঞাশক্তি দ্বারা মহান জ্ঞান সমুদ্রকে প্রকাশ করেন এবং ধারণাবতী বুদ্ধি সমূহকে দীপ্তি দান করেন।" দেবী সরস্বতী বৈদিক যুগ থেকেই নিরবচ্ছিন্নভাবে পূজিতা হলেও, বৃহত্তর বাংলা, বিহার এবং আসামে সরস্বতী পূজার বর্তমান রূপটি গুপ্তযুগ পরবর্তীকালের। প্রাচীনকালে তান্ত্রিক সাধকরা সরস্বতী দেবীকে বিভিন্ন তান্ত্রিক পদ্ধতিতে পূজা করতেন। বিদ্যা-কলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে 'বাগেশ্বরী' নামটি প্রাচীনকালে  হিন্দু বৌদ্ধ এবং জৈন সম্প্রদায়ের সকলের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। দেবীর আরাধনার পবিত্রতিথির নাম 'শ্রীপঞ্চমী'। দিনটি বিদ্যা-কলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর আরাধনার এক শুদ্ধতম তিথি। শুক্লপক্ষের শ্রীপঞ্চমী তিথিতে আসনের তালপাতার পুঁথি এবং দোয়াত-কলমকে দেবীর প্রতীক হিসেবে পূজা করার প্রথা আজও প্রচলিত। এ তিথিতে ছাত্র-ছাত্রীরা বাড়িতে বাংলা-সংস্কৃত গ্রন্থ, দোয়াত-কলম, শ্লেট-চক  সরস্বতী প্রতিমার চরণে সমর্পণ করে তাঁর কাছে বিদ্যার প্রার্থনা করত। আধুনিক উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরস্বতী পূজার প্রচলন শুরু হয় ব্রিটিশ আমলের মাঝামাঝি সময়ে। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সকল প্রকারের আচারাদি মেনে সম্পন্ন করা হত। শুদ্ধ স্বরূপা দেবীর পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপাচার বা সামগ্রীর একান্ত আবশ্যকীয়। অভ্র-আবির, আমের মুকুল, দোয়াত এবং নল খগড়ার কলম, যবের শিষ, পলাশ ফুল, বাসন্তী রঙের গাঁদা সহ বিভিন্ন প্রকারের ফুল। লোকাচার অনুসারে ছাত্রছাত্রীরা সরস্বতী পূজার আগে কুল বড়ই খায় না। সরস্বতী দেবীকে কুল বড়ই নিবেদন করে, তবেই সে বছরের মত বড়ই ফল গ্রহণ করে ছাত্রছাত্রীরা। স্মৃতিশাস্ত্রে সরস্বতী পূজার দিনটিকে অনধ্যায় বলা হয়েছে,অর্থাৎ সেদিন বিদ্যা গ্রহণ নিষিদ্ধ। কারণ প্রথা অনুসারে শ্রীপঞ্চমীতে দেবীর পায়ে বইপত্র সমর্পিত করে দেবীর কাছে বিদ্যা যাচনা করতে হয়। যথাবিহিত দেবীর পূজা করে, পরবর্তীতে লেখনী-মস্যাধার, পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রেরও পূজা করতে হয়। দেবী সরস্বতীর পূজা মন্ত্র হল- "ওঁ সরস্বত্যৈ নমঃ"। দেবীর বীজমন্ত্র হল-'ঐং'।পূজাশেষে আবালবৃদ্ধবনিতা মিলে দেবীর শ্রীচরণে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করে। পুষ্পাঞ্জলিতে কল্যাণময়ী ভদ্রকালীরূপা সরস্বতীর কাছে বেদ-বেদান্ত-বেদাঙ্গ সহ সকল বিদ্যা প্রদানের প্রার্থনা করা হয়। ওঁ ভদ্রকাল্যৈ নমাে নিত্যং সরস্বত্যৈ নমাে নমঃ । বেদ-বেদান্ত-বেদাঙ্গ-বিদ্যাস্থানেভ্য এব চ স্বাহা৷ অনেক বনেদি পরিবারে সরস্বতী পূজার পরদিন সকালে পুনরায় দেবীর পূজা করা হয়। পূজা সমাপন করে চিড়া ও দই মেশানো দধিকরম্ব বা দধিকর্মা দেবীকে নিবেদন করে সন্ধ্যায় দেবীর প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। বসন্ত পঞ্চমীতে অনুষ্ঠিত সরস্বতী পূজার আগের দিনটিকে 'বরদা চতুর্থী', 'বিনায়ক চতুর্থী', 'গণেশ চতুর্থী' বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। এ চতুর্থী তিথিতে বৃহত্তর বঙ্গের বহুস্থানে ঋদ্ধি-সিদ্ধি এবং সৌভাগ্য কামনায় গণেশপূজা অনুষ্ঠিত হয়। সরস্বতী পূজার পরের দিনে 'শীতলষষ্ঠী' ব্রত অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন অরন্ধন পালন এবং গোটা-সেদ্ধ খাওয়ার প্রথা বঙ্গের বহুস্থানেই প্রচলিত।  দেবী সরস্বতীর ধ্যানমন্ত্রে তাঁকে দ্বিভুজা, চতুর্ভুজা রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। শ্রীচণ্ডীর উত্তর চরত্রের শুরুতে দেবী সরস্বতীর একটি ধ্যানমন্ত্র দৃষ্ট হয়। সেই ধ্যানমন্ত্রে দেবীকে অষ্টভুজা রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। দেবী সরস্বতী শ্বেতহংসবাহনা, তবে কোন কোন অঞ্চলের প্রতিমায় তাঁকে ময়ূরবাহনা রূপেও দেখা যায়। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সাধারণত ময়ূরবাহনা চতুর্ভুজা সরস্বতী পূজিত হয়। কিন্তু বৃহত্তর বঙ্গে প্রাচীনকালে চতুর্ভুজা রূপে পূজিত হলেও, বর্তমানে বঙ্গদেশে দেবী দ্বিভুজা হংসবাহনা রূপে ঘরে ঘরে পূজিতা। পদ্মপুরাণের সুবিখ্যাত  'সরস্বতীস্তোত্রম্' -এ দেবীর শ্বেতশুভ্র মাধুর্যমণ্ডিত রূপ বর্ণিত হয়েছে। দেবী সরস্বতী শ্বেতপদ্মে আসীনা, শ্বেতপুষ্পে শোভিতা, শ্বেতবস্ত্র-পরিহিতা এবং শ্বেতগন্ধানুলেপন দ্বারা শোভিতা ।তাঁর হাতে শ্বেত রুদ্রাক্ষের মালা; তিনি শ্বেতচন্দনে চর্চিতা, শ্বেতবীণাধারিণী, শুভ্রবর্ণা এবং শ্বেত অলঙ্কারে বিভূষিতা। শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেতপুষ্পোপশোভিতা। শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতগন্ধানুলেপনা।। শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চিতা। শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা।। দেবী সরস্বতীকে নিয়ে ভারববর্ষের অধিকাংশ কবিরাই কাব্য রচনা করেছেন। দেবীর কাছে কলা-বিদ্যার প্রার্থনা করেছেন। সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর বিখ্যাত সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রের প্রণেতা আচার্য দণ্ডী তাঁর 'কাব্যাদর্শ' গ্রন্থের শুরুতেই দেবী সরস্বতীর শ্রীচরণে প্রার্থনা জানিয়ে একটি অপূর্ব মঙ্গলাচরণ শ্লোক রচনা করেছেন। সেই শ্লোকে তিনি দেবী সরস্বতীকে অনন্তকাল তাঁর মানসলোকে ক্রিয়াশীল থাকতে আহ্বান করেছেন। চতুর্মুখ-মুখাম্ভোজ-বনহংসবধূর্মম। মানসে রমতাং নিত্যং সর্বশুক্লা সরস্বতী।। "চতুর্মুখ ব্রহ্মার মুখপদ্মরূপ, বনহংসবাহনা হে মা সর্বশুক্লা সরস্বতী ; তুমি অনন্তকাল আমার মানসলোকে  আনন্দের সাথে বিরাজ কর।" শুধুই সংস্কৃত নয় বাংলার প্রাচীন নবীন প্রায় সকল কবিদের রচনাতেই দেবী সরস্বতীর বন্দনা পাওয়া যায়।অষ্টাদশ শতকে মধ্যযুগের সর্বশেষ খ্যাতিমান কবি নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাকবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের তাঁর বিখ্যাত 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যে ত্রিপদী ছন্দে দেবী সরস্বতীর বন্দনা করেছেন। "শ্বেতবর্ণ শ্বেতবাস              শ্বেতবীণা শ্বেতহাস               শ্বেত সরসিজ-নিবাসিনি। বেদবিদ্যা তন্ত্র মন্ত্র             বেণু বীণা আদি যন্ত্র                   নৃত্যগীত বাদ্যের ঈশ্বরী।" বাংলা ভাষায় সরস্বতীর বন্দনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকাও অতুলনীয় । যদিও পারিবারিক বিশ্বাসে তিনি নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক ছিলেন। এরপরেও তিনি তাঁর সৃষ্টির বিভিন্ন স্থানেই দেবী সরস্বতীর বন্দনা করেছেন। এর মধ্যে তাঁর 'সোনার তরী' কাব্যগ্রন্থের 'পুরষ্কার' কবিতাটি অত্যন্ত সুবিখ্যাত। অনন্যসাধারণ কবিতাটিতে কবি প্রচণ্ড  আবেগঘনভাবে দেবী সরস্বতীর বন্দনা করেছেন। কবিতার কবি চরিত্রটি যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই, তা স্পষ্টভাবে টের পাওয়া যায়। 'প্রকাশো জননী নয়নসমুখে  প্রসন্ন মুখছবি।  বিমল মানসসরস-বাসিনী  শুক্লবসনা শুভ্রহাসিনী  বীণাগঞ্জিতমঞ্জুভাষিণী  কমলকুঞ্জাসনা,  তোমারে হৃদয়ে করিয়া আসীন  সুখে গৃহকোণে ধনমানহীন  খ্যাপার মতন আছি চিরদিন  উদাসীন আনমনা।  চারি দিকে সবে বাঁটিয়া দুনিয়া  আপন অংশ নিতেছে গুনিয়া,  আমি তব স্নেহবচন শুনিয়া  পেয়েছি স্বরগসুধা।  তুমি মানসের মাঝখানে আসি  দাঁড়াও মধুর মুরতি বিকাশি,  কুন্দবরণ-সুন্দর-হাসি  বীণা হাতে বীণাপাণি।  ভাসিয়া চলিবে রবি শশী তারা  সারি সারি যত মানবের ধারা  অনাদিকালের পান্থ যাহারা  তব সংগীতস্রোতে।  দেবী সরস্বতী বিদ্যা-কলার চর্চাকারী শিল্পীদের কাছে ইষ্টস্বরূপা, পরম আরাধ্যা। দেবীর প্রসন্নতাতেই তাঁদের শিল্পীসত্ত্বা প্রকাশিত হয়, বিকশিত হয়।তাই শুধুই ভারতবর্ষে নয়, পৃথিবী জুড়ে দেবীসরস্বতী পূজিতা। ভারববর্ষে তো বটেই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া সহ পৃথিবীর বহু দেশেই দেবী সরস্বতীর উপাসনা করা হয় অনাদিকাল থেকে।ঋতুচক্রে শীতের তীব্রতা উত্তরায়ণ সংক্রান্তি থেকে কমতে শুরু করে শ্রীপঞ্চমী তিথি অর্থাৎ সরস্বতী পূজার দিনে এসে তা প্রায় সম্পূর্ণ কমে যায়। শীতের তীব্রতা কমে গিয়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের দেহেই শ্রী বা সৌন্দর্যের আবির্ভাব ঘটে। তাই শ্রীচিহ্ন হিসেবে সকালবেলাতে সকলেই শ্রীপঞ্চমী তিথিতে গায়ে হলুদ মেখে স্নান করে। স্নান সম্পন্ন করে পবিত্র হয়ে শুভ্রবস্ত্র পরিধান করে, তবেই দেবীর চরণে অঞ্জলি প্রদান করা হয়।  কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী  সহকারী অধ্যাপক,  সংস্কৃত বিভাগ,  চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

অচিন্ত্য পরমেশ্বরের জ্ঞানময় মূর্তি হচ্ছে দেবী সরস্বতী। তিনি ব্রহ্মের সৃষ্টিরূপ ব্রহ্মার শক্তি স্বরূপা। তাই তাঁর নাম ব্রহ্মাণী, সাবিত্রী এবং গায়ত্রী। দেবী সরস্বতী বৈদিককাল থেকেই পূজিতা। বেদ-বেদান্তে দেবী সরস্বতীর সাকার নিরাকার উভয় রূপেরই বর্ণনা পাওয়া যায়।কখনো তিনি বাকশক্তিরূপা, কখনো সৃষ্টিশক্তিরূপা, কখনো সাবিত্রী মন্ত্ররূপা, কখনো নদীরূপা অথবা কখনো ব্রহ্মাণ্ডের অধিশ্বরীরূপা। এ বিবিধরূপেই বেদ এবং বেদ পরবর্তী মহাভারত সহ একাধিক পুরাণে দেবীর মাহাত্ম্য বর্ণনা করা হয়েছে। বেদে প্রেরণাদাত্রী, চেতনাদাত্রী এবং জ্ঞানমূর্তি রূপই প্রকাশিত হয়েছে দেবী সরস্বতীর অসংখ্য বেদমন্ত্রে।

চোদয়িত্রী সূনৃতানাং চেতন্তী সুমতীনাং।
যজ্ঞং দধে সরস্বতী॥
মহো অর্ণঃ সরস্বতী প্রচেতয়তি কেতুনা।
ধিয়ো বিশ্বা বিরাজতি॥
(ঋগ্বেদ সংহিতা :১.৩.১১-১২)
"সত্য ও প্রিয়বাণীর প্রেরণাদাত্রী এবং সৎবুদ্ধির চেতনাদাত্রী মাতা সরস্বতী শুভকর্মকে ধারণ করে আছেন।জ্ঞানদাত্রী মাতা সরস্বতী প্রজ্ঞাশক্তি দ্বারা মহান জ্ঞান সমুদ্রকে প্রকাশ করেন এবং ধারণাবতী বুদ্ধি সমূহকে দীপ্তি দান করেন।"
দেবী সরস্বতী বৈদিক যুগ থেকেই নিরবচ্ছিন্নভাবে পূজিতা হলেও, বৃহত্তর বাংলা, বিহার এবং আসামে সরস্বতী পূজার বর্তমান রূপটি গুপ্তযুগ পরবর্তীকালের। প্রাচীনকালে তান্ত্রিক সাধকরা সরস্বতী দেবীকে বিভিন্ন তান্ত্রিক পদ্ধতিতে পূজা করতেন। বিদ্যা-কলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী হিসেবে 'বাগেশ্বরী' নামটি প্রাচীনকালে হিন্দু বৌদ্ধ এবং জৈন সম্প্রদায়ের সকলের কাছে অত্যন্ত জনপ্রিয় ছিল। দেবীর আরাধনার পবিত্রতিথির নাম 'শ্রীপঞ্চমী'। দিনটি বিদ্যা-কলার অধিষ্ঠাত্রী দেবী সরস্বতীর আরাধনার এক শুদ্ধতম তিথি। শুক্লপক্ষের শ্রীপঞ্চমী তিথিতে আসনের তালপাতার পুঁথি এবং দোয়াত-কলমকে দেবীর প্রতীক হিসেবে পূজা করার প্রথা আজও প্রচলিত। এ তিথিতে ছাত্র-ছাত্রীরা বাড়িতে বাংলা-সংস্কৃত গ্রন্থ, দোয়াত-কলম, শ্লেট-চক সরস্বতী প্রতিমার চরণে সমর্পণ করে তাঁর কাছে বিদ্যার প্রার্থনা করত। আধুনিক উচ্চতর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে সরস্বতী পূজার প্রচলন শুরু হয় ব্রিটিশ আমলের মাঝামাঝি সময়ে। শাস্ত্রীয় বিধান অনুসারে, শ্রীপঞ্চমীর দিন সকালেই সরস্বতী পূজা সকল প্রকারের আচারাদি মেনে সম্পন্ন করা হত। শুদ্ধ স্বরূপা দেবীর পূজায় কয়েকটি বিশেষ উপাচার বা সামগ্রীর একান্ত আবশ্যকীয়। অভ্র-আবির, আমের মুকুল, দোয়াত এবং নল খগড়ার কলম, যবের শিষ, পলাশ ফুল, বাসন্তী রঙের গাঁদা সহ বিভিন্ন প্রকারের ফুল। লোকাচার অনুসারে ছাত্রছাত্রীরা সরস্বতী পূজার আগে কুল বড়ই খায় না। সরস্বতী দেবীকে কুল বড়ই নিবেদন করে, তবেই সে বছরের মত বড়ই ফল গ্রহণ করে ছাত্রছাত্রীরা। স্মৃতিশাস্ত্রে সরস্বতী পূজার দিনটিকে অনধ্যায় বলা হয়েছে,অর্থাৎ সেদিন বিদ্যা গ্রহণ নিষিদ্ধ। কারণ প্রথা অনুসারে শ্রীপঞ্চমীতে দেবীর পায়ে বইপত্র সমর্পিত করে দেবীর কাছে বিদ্যা যাচনা করতে হয়। যথাবিহিত দেবীর পূজা করে, পরবর্তীতে লেখনী-মস্যাধার, পুস্তক ও বাদ্যযন্ত্রেরও পূজা করতে হয়। দেবী সরস্বতীর পূজা মন্ত্র হল- "ওঁ সরস্বত্যৈ নমঃ"। দেবীর বীজমন্ত্র হল-'ঐং'।পূজাশেষে আবালবৃদ্ধবনিতা মিলে দেবীর শ্রীচরণে পুষ্পাঞ্জলি প্রদান করে। পুষ্পাঞ্জলিতে কল্যাণময়ী ভদ্রকালীরূপা সরস্বতীর কাছে বেদ-বেদান্ত-বেদাঙ্গ সহ সকল বিদ্যা প্রদানের প্রার্থনা করা হয়।
ওঁ ভদ্রকাল্যৈ নমাে নিত্যং সরস্বত্যৈ নমাে নমঃ ।
বেদ-বেদান্ত-বেদাঙ্গ-বিদ্যাস্থানেভ্য এব চ স্বাহা৷
অনেক বনেদি পরিবারে সরস্বতী পূজার পরদিন সকালে পুনরায় দেবীর পূজা করা হয়। পূজা সমাপন করে চিড়া ও দই মেশানো দধিকরম্ব বা দধিকর্মা দেবীকে নিবেদন করে সন্ধ্যায় দেবীর প্রতিমা বিসর্জন দেওয়া হয়। বসন্ত পঞ্চমীতে অনুষ্ঠিত সরস্বতী পূজার আগের দিনটিকে 'বরদা চতুর্থী', 'বিনায়ক চতুর্থী', 'গণেশ চতুর্থী' বিভিন্ন নামে অভিহিত করা হয়। এ চতুর্থী তিথিতে বৃহত্তর বঙ্গের বহুস্থানে ঋদ্ধি-সিদ্ধি এবং সৌভাগ্য কামনায় গণেশপূজা অনুষ্ঠিত হয়। সরস্বতী পূজার পরের দিনে 'শীতলষষ্ঠী' ব্রত অনুষ্ঠিত হয়। সেদিন অরন্ধন পালন এবং গোটা-সেদ্ধ খাওয়ার প্রথা বঙ্গের বহুস্থানেই প্রচলিত।
দেবী সরস্বতীর ধ্যানমন্ত্রে তাঁকে দ্বিভুজা, চতুর্ভুজা রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। শ্রীচণ্ডীর উত্তর চরত্রের শুরুতে দেবী সরস্বতীর একটি ধ্যানমন্ত্র দৃষ্ট হয়। সেই ধ্যানমন্ত্রে দেবীকে অষ্টভুজা রূপে বর্ণনা করা হয়েছে। দেবী সরস্বতী শ্বেতহংসবাহনা, তবে কোন কোন অঞ্চলের প্রতিমায় তাঁকে ময়ূরবাহনা রূপেও দেখা যায়। উত্তর ও দক্ষিণ ভারতে সাধারণত ময়ূরবাহনা চতুর্ভুজা সরস্বতী পূজিত হয়। কিন্তু বৃহত্তর বঙ্গে প্রাচীনকালে চতুর্ভুজা রূপে পূজিত হলেও, বর্তমানে বঙ্গদেশে দেবী দ্বিভুজা হংসবাহনা রূপে ঘরে ঘরে পূজিতা। পদ্মপুরাণের সুবিখ্যাত 'সরস্বতীস্তোত্রম্' -এ দেবীর শ্বেতশুভ্র মাধুর্যমণ্ডিত রূপ বর্ণিত হয়েছে। দেবী সরস্বতী শ্বেতপদ্মে আসীনা, শ্বেতপুষ্পে শোভিতা, শ্বেতবস্ত্র-পরিহিতা এবং শ্বেতগন্ধানুলেপন দ্বারা শোভিতা ।তাঁর হাতে শ্বেত রুদ্রাক্ষের মালা; তিনি শ্বেতচন্দনে চর্চিতা, শ্বেতবীণাধারিণী, শুভ্রবর্ণা এবং শ্বেত অলঙ্কারে বিভূষিতা।
শ্বেতপদ্মাসনা দেবী শ্বেতপুষ্পোপশোভিতা।
শ্বেতাম্বরধরা নিত্যা শ্বেতগন্ধানুলেপনা।।
শ্বেতাক্ষসূত্রহস্তা চ শ্বেতচন্দনচর্চিতা।
শ্বেতবীণাধরা শুভ্রা শ্বেতালঙ্কারভূষিতা।।
দেবী সরস্বতীকে নিয়ে ভারববর্ষের অধিকাংশ কবিরাই কাব্য রচনা করেছেন। দেবীর কাছে কলা-বিদ্যার প্রার্থনা করেছেন। সপ্তম-অষ্টম শতাব্দীর বিখ্যাত সংস্কৃত অলংকার শাস্ত্রের প্রণেতা আচার্য দণ্ডী তাঁর 'কাব্যাদর্শ' গ্রন্থের শুরুতেই দেবী সরস্বতীর শ্রীচরণে প্রার্থনা জানিয়ে একটি অপূর্ব মঙ্গলাচরণ শ্লোক রচনা করেছেন। সেই শ্লোকে তিনি দেবী সরস্বতীকে অনন্তকাল তাঁর মানসলোকে ক্রিয়াশীল থাকতে আহ্বান করেছেন।
চতুর্মুখ-মুখাম্ভোজ-বনহংসবধূর্মম।
মানসে রমতাং নিত্যং সর্বশুক্লা সরস্বতী।।
"চতুর্মুখ ব্রহ্মার মুখপদ্মরূপ, বনহংসবাহনা হে মা সর্বশুক্লা সরস্বতী ; তুমি অনন্তকাল আমার মানসলোকে আনন্দের সাথে বিরাজ কর।"
শুধুই সংস্কৃত নয় বাংলার প্রাচীন নবীন প্রায় সকল কবিদের রচনাতেই দেবী সরস্বতীর বন্দনা পাওয়া যায়।অষ্টাদশ শতকে মধ্যযুগের সর্বশেষ খ্যাতিমান কবি নদীয়ার মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাকবি ভারতচন্দ্র রায় গুণাকরের তাঁর বিখ্যাত 'অন্নদামঙ্গল' কাব্যে ত্রিপদী ছন্দে দেবী সরস্বতীর বন্দনা করেছেন।
"শ্বেতবর্ণ শ্বেতবাস শ্বেতবীণা শ্বেতহাস
শ্বেত সরসিজ-নিবাসিনি।
বেদবিদ্যা তন্ত্র মন্ত্র বেণু বীণা আদি যন্ত্র
নৃত্যগীত বাদ্যের ঈশ্বরী।"
বাংলা ভাষায় সরস্বতীর বন্দনার ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকাও অতুলনীয় । যদিও পারিবারিক বিশ্বাসে তিনি নিরাকার ব্রহ্মের উপাসক ছিলেন। এরপরেও তিনি তাঁর সৃষ্টির বিভিন্ন স্থানেই দেবী সরস্বতীর বন্দনা করেছেন। এর মধ্যে তাঁর 'সোনার তরী' কাব্যগ্রন্থের 'পুরষ্কার' কবিতাটি অত্যন্ত সুবিখ্যাত। অনন্যসাধারণ কবিতাটিতে কবি প্রচণ্ড আবেগঘনভাবে দেবী সরস্বতীর বন্দনা করেছেন। কবিতার কবি চরিত্রটি যে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেই, তা স্পষ্টভাবে টের পাওয়া যায়।
'প্রকাশো জননী নয়নসমুখে
প্রসন্ন মুখছবি।
বিমল মানসসরস-বাসিনী
শুক্লবসনা শুভ্রহাসিনী
বীণাগঞ্জিতমঞ্জুভাষিণী
কমলকুঞ্জাসনা,
তোমারে হৃদয়ে করিয়া আসীন
সুখে গৃহকোণে ধনমানহীন
খ্যাপার মতন আছি চিরদিন
উদাসীন আনমনা।
চারি দিকে সবে বাঁটিয়া দুনিয়া
আপন অংশ নিতেছে গুনিয়া,
আমি তব স্নেহবচন শুনিয়া
পেয়েছি স্বরগসুধা।
তুমি মানসের মাঝখানে আসি
দাঁড়াও মধুর মুরতি বিকাশি,
কুন্দবরণ-সুন্দর-হাসি
বীণা হাতে বীণাপাণি।
ভাসিয়া চলিবে রবি শশী তারা
সারি সারি যত মানবের ধারা
অনাদিকালের পান্থ যাহারা
তব সংগীতস্রোতে।
দেবী সরস্বতী বিদ্যা-কলার চর্চাকারী শিল্পীদের কাছে ইষ্টস্বরূপা, পরম আরাধ্যা। দেবীর প্রসন্নতাতেই তাঁদের শিল্পীসত্ত্বা প্রকাশিত হয়, বিকশিত হয়।তাই শুধুই ভারতবর্ষে নয়, পৃথিবী জুড়ে দেবীসরস্বতী পূজিতা। ভারববর্ষে তো বটেই দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া সহ পৃথিবীর বহু দেশেই দেবী সরস্বতীর উপাসনা করা হয় অনাদিকাল থেকে।ঋতুচক্রে শীতের তীব্রতা উত্তরায়ণ সংক্রান্তি থেকে কমতে শুরু করে শ্রীপঞ্চমী তিথি অর্থাৎ সরস্বতী পূজার দিনে এসে তা প্রায় সম্পূর্ণ কমে যায়। শীতের তীব্রতা কমে গিয়ে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে সকলের দেহেই শ্রী বা সৌন্দর্যের আবির্ভাব ঘটে। তাই শ্রীচিহ্ন হিসেবে সকালবেলাতে সকলেই শ্রীপঞ্চমী তিথিতে গায়ে হলুদ মেখে স্নান করে। স্নান সম্পন্ন করে পবিত্র হয়ে শুভ্রবস্ত্র পরিধান করে, তবেই দেবীর চরণে অঞ্জলি প্রদান করা হয়।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁