বাংলাদেশের নির্মম বাস্তবতায় অধিকাংশের কাছে জীবন মানে রূঢ় বাস্তবতা। কিন্তু আমাদেরই অনেক মাসি, বৌদি, দিদিদের কাছে জীবন মানে শুধুমাত্র উপভোগ এবং হাসিঠাট্টা। বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের দৃষ্টিতেও পড়েছে। তিনি তাঁর 'মানসী' কাব্যগ্রন্থের 'নববঙ্গদম্পতির প্রেমালাপ' কবিতায় বিষয়টি অত্যন্ত সরসভাবে চিত্রিত করেছেন। শয্যায় সুয়ে স্বামী যখন স্ত্রীকে প্রেম নিবেদন করতে গিয়ে বলে, হে আমার প্রিয়ে! জীবন যৌবন ক্ষয় করে সমগ্র জগৎ তন্নতন্ন করে তোমার জন্য কি এনে দিব যাতে তুমি খুশি হবে ? স্বামীর এই ভালবাসার প্রতুত্তরে স্ত্রী চাহিদা শুধুই গোটা-ছয় কুল বড়ই। বিষয়টি হাস্যকর হলেও, অনেকটা বাস্তব। হতাশ হয়ে বেচারা স্বামী পরবর্তীতে বলে, আমি চলে গেলে কি করে আমার বিরহে তুমি কাল কাটাবে? প্রতুত্তরে স্ত্রী বলে, আমার প্রিয় পুতুলের বিয়ে দিয়েই সময় কেটে যাবে। সম্পূর্ণ কবিতায় দেখা যায় স্বামী যতই স্ত্রীকে আবেগঘন প্রেম নিবেদন করে, স্ত্রী ততই তার নিজের জগত নিয়ে আছে। বাইরের জগত এবং বাস্তবতা সম্পর্কে, তার কোন আগ্রহ নেই। এ বাস্তবতাটি বর্তমান কালেও দেখা যায়।
"জগৎ ছানিয়া কী দিব আনিয়া
জীবন যৌবন করি ক্ষয়?
তোমা তরে, সখী, বলো করিব কী?
কনে॥ আরো কুল পাড়ো গোটা-ছয়।
বর॥ তবে যাই সখী, নিরাশাকাতর
শূন্য জীবন নিয়ে।
আমি চলে গেলে এক-ফোঁটা জল
পড়িবে কি আঁখি দিয়ে?
বসন্তবায়ু মায়ানিশ্বাসে
বিরহ জ্বালাবে হিয়ে?
ঘুমন্তপ্রায় আকাঙ্ক্ষা যত
পরানে উঠিবে জীয়ে।
বিষাদিনী বসি বিজন বিপিনে
কী করিবে তুমি প্রিয়ে?
বিরহের বেলা কেমনে কাটিবে?
কনে॥ দেব পুতুলের বিয়ে।"
একই শয্যায় স্বামী-স্ত্রী দিনের পরে দিন অবস্থান করেও, তাদের মধ্যে যোজন যোজন মানসিক দূরত্ব রয়ে যায়। স্বামী যদি জাতি, ধর্ম, সম্প্রদায়ের কল্যাণের জন্যে কাজ করতে চায়; তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তাদের স্ত্রীদের এ মহত্তর কর্মে সমর্থন খুব একটা পাওয়া যায় না। স্ত্রীরা থাকে তাদের পুতুলের বিয়ের নিজস্ব অলীক বাস্তবতায়। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে মনােহৃদয়ের বোঝাপড়া যত বেশি থাকে; তাদের মধ্যে প্রীতির ভাব ততই বেশি থাকে। সম্পর্কের এ মানসিক বিষয়টির প্রসঙ্গে মহাভারতের বনপর্বেও বলা হয়েছে।
ইন্দ্রিয়াণাঞ্চ পঞ্চাণাং মনসাে হৃদয়স্য চ।
বিষয়ে বর্তমানানাং যা প্রীতিরূপজায়তে।।
(মহাভারত:বনপর্ব, ৩৩. ৩৭)
"পঞ্চেন্দ্রিয়, মনােহৃদয় স্ব স্ব বিষয়ে বর্তমান থেকে চিত্তে যখন প্রীতির ভাব জাগে এবং প্রীতির সুখ স্পর্শ পাওয়ার জন্য মনে যখন সঙ্কল্প জাগে তাকেই বলে কাম।"
শ্রীরামচন্দ্রের সাথে তাঁর স্ত্রী সীতাদেবীর মানসিক সম্পর্কটি অত্যন্ত তীব্রতর ছিল বলে, তিনি যখন পিতৃসত্য পালন করে বনে গিয়েছিলেন; তখন স্ত্রী সীতাদেবীকেও সাথে পেয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানকালে কোন মহত্তম নিঃস্বার্থ কাজে স্ত্রীকে কয়জনেই বা সাথেপাছে পাই? গুটিকয়েক পেলেও অধিকাংশই পাই না।
আজ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় প্রতিনিয়ত হাজারটা সমস্যার মুখোমুখি হচ্ছি। খাবারের পরিমাণ যখন কম থাকবে, সেই খাবার খেতে কাকেরা খাবার নিয়ে মারামারি করবে, কামড়াকামড়ি করবে। এটাই স্বাভাবিক। অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়ায় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকাংশ পরিবারে সম্পদের চাহিদার যোগান ঠিকমত হয় না। অর্থনৈতিক টানাটানি গ্রাম-গঞ্জ এবং শহরের নিম্নবিত্ত পরিবারগুলোতে। খাবার এবং সম্পদের সরবরাহ কম থাকায় নিজেদের মধ্যে পারিবারিক বিরোধ লেগে যায়। স্বার্থের প্রশ্নে মা-বাবার সাথে পর্যন্ত বিরোধ লেগে যায়। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে পারিবারিক সম্পর্কগুলো ধীরেধীরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।আগে হিন্দু পরিবারগুলো ছিল যৌথ পরিবার। কিন্তু সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে যাওয়ায়, যৌথ পরিবারও ভেঙে যাচ্ছে।পারিবারিক বন্ধনও নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।জীবন মানেই পুষ্পশয্যা নয়, জীবন মানে রূঢ় বাস্তবতা।
অহেতুক স্বপ্নালু স্বভাব পরিত্যাগ করে, অর্থনৈতিক স্বাবলম্বীতার কথা ভাবা প্রয়োজন। পরিবারের সবাইকে নিয়ে সমন্বিতভাবে না থাকার মানসিকতা, বর্তমানে আমাদের পারিবারিক সম্প্রীতিতে ধীরেধীরে ক্ষয়িষ্ণুতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমাদের একটি বাঙালি প্রবাদ আছে, "দশের লাঠি একের বোঝা"। সবাই মিলেমিশে ঐক্যবদ্ধ থাকলে সকল সমস্যারই সমাধান সম্ভব। আমাদের মধ্যে সমাজে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে আমিত্বভাব প্রচণ্ড গতিতে বেড়ে যাচ্ছে। এই আমিত্ববোধের অভিঘাতে আশেপাশের সকল কিছুই আমরা স্বার্থপরতার সংকীর্ণ সীমাবদ্ধ দৃষ্টিতে দেখছি। স্বামী-স্ত্রীর একে অন্যের মনজগতের ভূগোলের সম্যক পাঠ নেয়ার ক্ষেত্রেও ঠিক একই ঘটনা ঘটছে।কিন্তু আমাদের একথা স্মর্তব্য যে, প্রতিদিন আমরা সংসার নামক এক বিশাল কণ্টকাকীর্ণ পথ পাড়ি দিচ্ছি। সে পথে চলতে গিয়ে আমরা চাই বা না চাই, আমাদের পা ক্ষত-বিক্ষত হবেই।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।