বাঙালির পরিচয় শুধু তার ভাষাতেই সীমাবদ্ধ নয়। বাঙালি পরিচয় ভাষার সাথে তার শাশ্বত সংস্কৃতির সাথেও অবিচ্ছেদ্যভাবে যুক্ত। এ শাশ্বত সর্বজনীন সংস্কৃতিকে যারা বিশ্বাস করে না তারা নামে বাঙালি হলেও আদতে বাঙালি নয়, বিদেশি সাম্রাজ্যবাদী ভাবাদর্শের অনুগামী।আজও প্রতি বাঙালির গৃহে প্রতি বৃহস্পতিবার এবং প্রতি পূর্ণিমাতিথিতে নারীরা অত্যন্ত নিষ্ঠার দেবী লক্ষ্মীর সন্তুষ্টির জন্য লক্ষ্মীর পাঁচালি পাঠ করেন। গৃহে বিভিন্ন লক্ষ্মীর চিহ্ন ধারণ করেন।পাঁচালিটি শুরুই হয়েছে দোলপূর্ণিমা শব্দটি দিয়ে।
"দোল পূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ।
ধীরে ধীরে বহিতেছে মলয় বাতাস ।।
লক্ষ্মীদেবী বামে করি বসি নারায়ণ।
করিতেছে নানা কথা সুখে আলাপন।।"
দোলপূর্ণিমা বাঙালি সংস্কৃতির সাথে এমন ওতোপ্রোতোভাবে জড়িয়ে আছে যে, চাইলেও দোলপূর্ণিমাকে বাঙালি সংস্কৃতি থেকে আলাদা করা যায় না।বিশ্বব্যাপী অধিকাংশ বাঙালি ছোটকাল থেকেই "দোল পূর্ণিমার নিশি নির্মল আকাশ" লক্ষ্মীর পাঁচালির এ লাইনগুলো গৃহের মা, মাসি, পিসি, দিদি, ঠাকুমা, দিদিমাদের অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পাঠ করতে দেখে।সমগ্র ভারতবর্ষের সাথে নেপাল, বাংলাদেশ, মরিশাস, গায়ানা, সুরিনাম,ত্রিনিদাদ এন্ড টোবাগো, আমেরিকা, ফিজি, ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, সিংগাপুর, গ্রেট ব্রিটেন সহ পৃথিবীর অনেক দেশেই যেখানে হিন্দু সংখ্যাধিক্য সেখানেই দশেরা, দেওয়ালী এবং হোলি এ প্রধান তিনটি উৎসব পালিত হয় রঙিন বর্ণাঢ্যভাবে। হিন্দুর প্রধান এ তিনটি উৎসবের মধ্যে রূপে-রসে-গন্ধে হোলি অনন্য। 'হোলি' নামটি সাধারণত উত্তরভারতেই প্রচলিত। সেখানে হোলির আরেক নাম 'ফাগোয়া'। এ ফাগোয়া বা হোলিকেই আমরা বাঙালীরা দোলযাত্রা নামে পালন করি। এ ছাড়া সারা ভারতবর্ষে বিভিন্ন নামেই এ উৎসব পালিত হয় যেমন : ওড়িশায় দোলোৎসব, মধ্যভারতে হরি (হোলি), গোয়ায় শিমাগা, দক্ষিণভারতে মদন-দহন বা কামায়ণ ইত্যাদি।
"দোল্যতে অস্মিন কৃষ্ণনেতি দোলি" অর্থাৎ শ্রীকৃষ্ণকে দোলারোহণ করে দোল দেয়া হয়, তাই এই উৎসবের নাম দোলযাত্রা। ফাল্গুনী পূর্ণিমাতিথিতে এ উৎসব আয়োজিত হয়। যে দিন অরুণোদয় কালে পূর্ণিমাতিথি লাভ হবে, সে পবিত্র দিনেই দোলযাত্রা হবে। এ দোলযাত্রা সম্পর্কে পদ্মপুরাণের পাতাল খণ্ডে বলা আছে তা খুবই তাৎপর্যবাহী।
"কলিযুগে এই দোলোৎসব সকল উৎসবের মধ্যে অন্যতম প্রধান। যথাবিধি ভক্তিপূর্বক সাদা, লাল, গেরুয়া, হলুদ এই চারপ্রকারের ফল্গুচূর্ণ (আবির) দ্বারা এবং নানাবিধ সুগন্ধ দ্রব্য তাতে মিশ্রিত করে ভগবান শ্রীকৃষ্ণেকে সন্তুষ্ট করবে। এ দোলোৎসব পাঁচদিন বা তিনদিনব্যাপী করবে। দক্ষিণাভিমুখে কৃষ্ণকে দোলযানে স্থাপন করবে। যারা এই দোলস্থ কৃষ্ণকে দর্শন করে, তারা নিঃসংশয়ে সকল প্রকার পাপ হতে মুক্তিলাভ করে। "
দোলযাত্রায় মহোৎসবে বর্তমানের আমরা বাজারে প্রাপ্ত কালো, সবুজ, বেগুনি সহ বিভিন্ন প্রকারের রং ব্যবহার করি। এ রঙগুলোর অধিকাংশই বিভিন্ন কেমিক্যাল কোম্পানিতে তৈরি হয়। তাই রঙগুলো শরীরের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর তো বটেই, ক্ষতিকরের সাথে সাথে অশাস্ত্রীয়।শাস্ত্রে প্রাকৃতিক উপাদানে তৈরি লাল, হলুদ, গেরুয়া এবং সাদা এ চারপ্রকারের ফল্গুচূর্ণ বা আবিরই ব্যবহার করতে নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। বিভিন্ন ফুলের পাপড়ি বা প্রাকৃতিক কোন উপাদান থেকেই আবির তৈরি করে, তবেই দোলোৎসবে ব্যবহার করতে হবে। চার রঙের আবিরের মধ্যেও অনেক অন্তর্নিহিত ভাব রয়েছে। লাল রাজসিকতার প্রতীক। আনন্দ উৎসব, বিবিধ অনুষ্ঠান এ সবই রাজসিকতার অংশ। হলুদ রঙ হল মায়ার প্রতীক। জগতে আমরা সকলেই মায়ার আবরণে আবদ্ধ। ভগবান শ্রীকৃষ্ণের গায়ের বস্ত্র হলুদ। এর কারণ হল, হলুদ মায়ার আবরণকে উন্মোচিত করতে পারলে ভগবান শ্রীকৃষ্ণকে পাওয়া যায়। মায়ার আবরণ থেকে মুক্তির জন্যে আমরা ভগবান শ্রীকৃষ্ণের সাথে সাথে শাক্তমতে দেবী বগলামুখির উপাসনা করি। দেবী বগলামুখী পূজায় সকল পুষ্পাদি সহ অধিকাংশ উপাচারই থাকে হলুদ বর্ণের। হলুদ রঙের মায়ার শৃঙ্খল থেকে মুক্তি পেয়ে মহামায়ার কাছে যাওয়ার জন্য। গেরুয়া রঙ হল ত্যাগ বৈরাগ্যের প্রতীক। সাদা হল সত্ত্বগুণ সম্পন্ন পরমেশ্বরের প্রতীক, সাত্ত্বিক ভাবের প্রতীক। শুধু পদ্মপুরাণ, গরুড়পুরাণ, নারদীয় পুরাণই নয় স্কন্ধপুরাণের উৎকলখণ্ডের ৪২ অধ্যায়ে দোলযাত্রার বিস্তারিত বিবরণ দেয়া আছে:
"দোলোৎসবে গোবিন্দের পূজা করতে হয়। যারা দোলে পূজা অবস্থায় গোবিন্দের দর্শন করে, তারা মুক্তি লাভ করে। এ সময়ে গোবিন্দকে তিনবার দোল প্রদানে পাপ নাশ হয় এবং তিনবার দোলোৎসব দর্শনে আধ্যাত্মিক, আধিদৈবিক ও আধিভৌতিক এই ত্রিতাপ হতে জীব মুক্ত হয়। যে রাজা এ দোলোৎসব আয়োজন করেন, তিনি রাজচক্রবর্তী হন। আর অন্যরা বেদবিদ হয়ে মুক্তিলাভ করেন।"
স্কন্দপুরাণ গ্রন্থের ফাল্গুনমাহাত্ম্য গ্রন্থাংশে হোলিকা ও প্রহ্লাদের উপাখ্যান বর্ণিত হয়েছে। হোলিকা ছিলেন মহর্ষি কশ্যপ ও তাঁর পত্নী দিতির পুত্র হিরণ্যকশিপুর ভগিনী। ব্রহ্মার বরে হিরণ্যকশিপু দেব ও মানব বিজয়ী হয়ে দেবতাদের অবজ্ঞা করতে শুরু করেন। কিন্তু তাঁর পুত্র প্রহ্লাদ ছিলেন বিষ্ণুর ভক্ত। প্রহ্লাদ বিষ্ণুকে নিজ পিতার উপরে স্থান দেওয়ায় ক্রুদ্ধ হয়ে হিরণ্যকশিপু নিজের পুত্রকে পুড়িয়ে মারার আদেশ দেন। দাদার আজ্ঞায় হোলিকা প্রহ্লাদকে কোলে নিয়ে আগুনে প্রবেশ করেন। কিন্তু ভগবান বিষ্ণুর কৃপায় প্রহ্লাদ অক্ষত থাকেন; বরং আগুনে পুড়ে হোলিকারই মৃত্যু হয়। হোলিকার বর ছিল আগুন থেকে নিজেকে রক্ষা করার জন্য। কিন্তু হোলিকা সেই আত্মরক্ষার ব্রহ্মার বরকে যখন প্রহ্লাদকে পুড়িয়ে মেরে ফেলতে ব্যবহার করে তখন হোলিকা নিজেও অগ্নিদগ্ধ হয়। অর্থাৎ অন্যকে অকারণ ক্ষতি করতে গেলে যে, নিজেই বিধ্বংস হয়ে যেতে হয় এর প্রত্যেক উদাহরণ হিরণ্যকশিপুর বোন হোলিকা। হোলিকার এ শিক্ষামূলক কাহিনীর স্মরণেই সকল অমঙ্গলের প্রতীক হোলিকার পুতুলে দোলযাত্রার পূর্বরাত্রে আগুন জ্বালিয়ে হোলিকাদহন করা হয়। প্রতীকী এ হোলিকাদহনের অন্যনাম ঢুণ্ঢারদাহ বা চাঁচর উৎসব। মহারাষ্ট্রে এ সময় আগুনের চারিদিকে তিনবার প্রদক্ষিণ করতে করতে হোলিকাসুরের উদ্দেশ্যে অনেক অশ্লীল বাক্য ব্যবহার করে হোলিকাসুর সহ সকল অসুরদের অনুরোধ করা হয়, মানুষের ক্ষতি না করতে।
বসন্তকাল ঋতুরাজ, আর সেই ঋতুরাজের পূর্ণিমাতিথি সৌন্দর্যময়তায় অনন্য ; এর তুলনা হয় না। তাই এই বসন্তপূর্ণিমাতে প্রাচীন কাল থেকেই চলে আসছে যুবক-যুবতীর চির আকাঙ্ক্ষিত কামদেব মদনের উপাসনা। অসংখ্য সংস্কৃত গ্রন্থে বিবরণ পাওয়া যায়। সপ্তম শতাব্দীর প্রখ্যাত কবি স্থাণীশ্বরের রাজা মহারাজ হর্ষবর্ধনের বিখ্যাত নাটকত্রয়ীর অন্যতম রত্নাবলীতে সেই সময়ের বসন্ত উৎসবের একটা প্রামাণ্য দলিল বলা চলে। এই বসন্তোৎসবই আজকের দিনে হোলি উৎসবে রূপান্তরিত। বাঙালির দোলোৎসব বর্তমানে হলি নামেই বেশি পরিচিত হয়ে যাচ্ছে। হলি শব্দটি সর্বভারতীয় শব্দ হিসেবে অত্যন্ত জনপ্রিয় হলেও, দোলোৎসব শব্দটিই বাঙালির সমাজ সংস্কৃতিতে ব্যবহৃত। কিন্তু হলি শব্দটি প্রচারমাধ্যমে এত বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে যে আজ বাঙালিরাও দোলযাত্রা শব্দটিকে কিছুটা পেছনে ফেলে হলি শব্দটিই বেশি ব্যবহার করছে।দোলযাত্রা বা হোলি আধ্যাত্মিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক সকল কারণ ছাপিয়ে বাঙালি জীবনে তৈরি করেছে এক অনন্য স্থান ; কারণ এই দিনেই জন্ম নিয়েছেন বাঙালির প্রাণপুরুষ শ্রীচৈতন্যদেব।
শ্রীচৈতন্যদেবের সাথে সাথে কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জীবনে এবং স্মৃতিতেও দোলযাত্রা এক অনন্য স্থান অধিকার করে আছে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরই এ দোলকে ধর্মের আবরণ থেকে মুক্ত করে এক সর্বজনীন উৎসবে পরিণত করেন। ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে তাঁর স্মৃতিবাহী শান্তিনিকেতনে তিনি বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ে সর্বজনীন দোল পূর্ণিমা উৎসবের প্রবর্তন করেন। দেশ-বিদেশের অসংখ্য মানুষ শান্তিনিকেতনের এ উৎসবে যোগদান করেন। শান্তিনিকেতনের গৌড় প্রাঙ্গণে বৈতালিকের মাধ্যমে শুরু হয় এ উৎসবের। অংশ নেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী, শিক্ষকসহ বিশিষ্টজনেরা। বাসন্তী রঙের শাড়ি পরে হাতে বিভিন্ন রংয়ের আবির নিয়ে বসন্ত উৎসবে মেতে ওঠেন ছাত্র-শিক্ষক সহ সবাই । দিনভর চলে নৃত্য -গীত আর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান।এই উৎসবে দেশ-বিদেশের অসংখ্য শিল্পীরা অংশ গ্রহণ করে নৃত্য -গীতে মুখরিত করে তোলে বিশ্বভারতীর গৌর প্রাঙ্গণ এবং গেয়ে চলে রবীন্দ্রনাথের দোলযাত্রার বা বসন্তের বিবিধ গান।
"ওরে গৃহবাসী খোল্, দ্বার খোল্, লাগল যে দোল।
স্থলে জলে বনতলে লাগল যে দোল।
দ্বার খোল্, দ্বার খোল্॥
রাঙা হাসি রাশি রাশি অশোক পলাশে,
রাঙা নেশা মেঘে মেশা প্রভাত-আকাশে,
নবীন পাতায় লাগে রাঙা হিল্লোল।
দ্বার খোল্, দ্বার খোল্॥
বেণুবন মর্মরে দখিন বাতাসে,
প্রজাপতি দোলে ঘাসে ঘাসে।
মউমাছি ফিরে যাচি ফুলের দখিনা,
পাখায় বাজায় তার ভিখারির বীণা,
মাধবীবিতানে বায়ু গন্ধে বিভোল।
দ্বার খোল্, দ্বার খোল্॥"
মথুরা-বৃন্দাবনের হলিও অনন্য। এর সাথে শ্রীচৈতন্যদেবের জন্মস্থান নবদ্বীপেও অতুলনীয় হলি উৎসবের আয়োজন করা হয়। নদীয়া জেলার নবদ্বীপের অনন্য অসাধারণ। এ দোলোৎসবে অংশ নেয় বিশ্বের প্রায় ৬০টির অধিক দেশসহ ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে থেকে লক্ষ-লক্ষ ধর্মপ্রাণ মানুষ। সকলের সক্রিয় অংশগ্রহণে নবদ্বীপ হয়ে ওঠে এক অক্ষয় আনন্দঘন ধামে। দোলযাত্রা বা হলি একটি বৈষ্ণব পর্ব হলেও, আজ জাতিধর্মের গণ্ডি পেরিয়ে সর্বজনীন মহোৎসব। হলি শব্দটি একটি মাহাত্ম্যপূর্ণ আধ্যাত্মিক কৃত্যানুষ্ঠানের শব্দ হলেও বর্তমানে আমরা নিজেদের অজ্ঞানতার কারণে শব্দটিকে নেতিবাচক অর্থে ব্যবহার করি প্রাত্যহিক জীবনে। রঙের সাথে রক্তকে সাদৃশ্য করে কোন স্থানে কোন বিভৎসতা ঘটনা সংগঠিত হলে আমরা বলে থাকি, "রক্তের হোলিখেলা"। এ কারণে অনেকে না বুঝে হোলি শবদটিকেই একটি নেতিবাচক শব্দ মনে করে। শাস্ত্রীয় এ আধ্যাত্মিক বিষয়টি সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান না থাকার কারণেই এ ঘটনাটি ঘটছে।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।

