ধর্ম নির্ণয়ে বেদই একমাত্র প্রমাণ; পুরাণ এবং স্মৃতি সহায়ক মাত্র

বর্তমানে সনাতন ধর্মাবলম্বী কিছু ব্যক্তি প্রধান ধর্মগ্রন্থ বেদকে পাশ কাটিয়ে শুধু পৌরাণিক গ্রন্থ অথবা বিভিন্ন বাবাগুরুদের লেখা ছড়ার বই, গ...

প্রহ্লাদ অদ্বৈতসিদ্ধিতে মুক্ত হয়েছিলো।

"যদগ্নে স্যামহং ত্বং ত্বং বা ঘাস্যা অহম্";  আমাদের দেহের অভ্যন্তরে সুষুম্না নাড়ীর পথে অতি সূক্ষ্ম পদ্মাকৃতিমূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা-ছয়টি চক্র আছে, যাকে ষটচক্র বলে।সকলের উর্দ্ধে আছে সহস্র পাপড়ির সহস্রার পদ্ম। সাধক যখন মুক্তি লাভ করে তখন তার এই সহস্র পাপড়ির পদ্মটির একটি একটি পাপড়ি প্রস্ফুটিত হচ্ছে এমন উপলব্ধি হয়। সাধকের মুক্তির পথে পৃথিবীর সকল পরিবার পরিজনের মায়ারূপ বন্ধন থেকে মুক্তির পথে যখন অগ্রসর হয়, তখন পৃথিবীর সকল সকল সম্পর্কই তার কাছে অসার মনে হয়। সে তখন জাগতিক সকল বিষয় থেকেই নিজেকে প্রত্যাহৃত করে নেয়। সে উপলব্ধি করতে পারে, জগতের স্রষ্টার সাথে তাঁর সম্পর্ক। সে বুঝতে পারে আমিই সেই ।সে জগতের সাথে এবং এবং জগত স্রষ্টার সাথে ধীরেধীরে একত্ব অনুভব করতে থাকে। এ একত্ববোধই তাকে মুক্তির পথে নিয়ে যায়।ঋগ্বেদ সংহিতার অষ্টম মণ্ডলেও বিষয়টি বলা হয়েছে : যদগ্নে স্যামহং ত্বং ত্বং বা ঘাস্যা অহম্। স্যুষ্টে সত্যা ইহাশিষঃ।। (ঋগ্বেদ সংহিতা:৮.৪৪.২৩) "হে প্রকাশ স্বরূপ অগ্নি, যখন আমি তুমি হয়ে যাই এবং তুমি আমি হয়ে যাও; তখনই সংসারে তোমার আশীর্বাদ সার্থক হয়।" সাধকের পরমেশ্বরের সাথে যে আত্মতত্ত্বের একত্ব "তুমি আমি" এবং "আমি তুমি" সম্পর্ক গুলিয়ে ফেলে। ফলশ্রুতিতে সে উপলব্ধি করতে পারে যে, স্রষ্টা এবং সৃষ্টির মাঝে কেউ নেই,কোনো বাধা নেই। জগতের সকলই এক এবং অদ্বিতীয় পরমেশ্বরেরই প্রকাশ। বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর একটি ব্রহ্মসংগীতেও বলেছেন: "জানি শুধু তুমি আছ তাই আছি, তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি, যত পাই তোমায় আরো তত যাচি, যত জানি তত জানি নে। জানি আমি তোমায় পাব নিরন্তর লোকলোকান্তরে যুগযুগান্তর- তুমি আর আমি মাঝে কেহ নাই, কোনো বাধা নাই ভুবনে।।" বৈদিক অদ্বৈতের ভাবটি আমরা বিষ্ণুমহাপুরাণের প্রথমাংশের উনবিংশ অধ্যায়ে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে খুঁজে পাই। দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর সন্তান প্রহ্লাদ একাগ্র চিত্তে ভগবান অচ্যুতের স্তব করতে করতে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর সাথে একত্ববোধ করতে লাগলেন। ভক্ত এবং ভগবানে আর কোন বাধা রইলো না। সকলই মিলেমিশে একাকার।প্রথমে একত্ববোধের পূর্বে তিনি ভগবান শ্রীহরিকে পুণ্ডরীকাক্ষ, পুরুষোত্তম, সর্ব্বলোকাত্মন্, তীক্ষ্ণচক্রিণ, জগতের হিতস্বরূপ কৃষ্ণ গোবিন্দকে নমস্কার করেছেন। তিনি স্তোত্রে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সেই অদ্বিতীয় পরমেশ্বরই ত্রিমূর্তি ধারণ করে ব্রহ্মারূপে জগতের সৃষ্টি করেন, বিষ্ণুরূপে পালন করেন এবং কল্পান্তে প্রলয়কালে রুদ্ররূপে জগতের লয় করেন। নমস্তে পুণ্ডরীকাক্ষ নমস্তে পুরুষোত্তম। নমস্তে সর্ব্বলোকাত্মন্ নমস্তে তিগ্মচক্রিণে।। নমো ব্রহ্মণ্যদেবায় গোব্রাহ্মণহিতায় চ। জগদ্ধিতায় কৃষ্ণায় গোবিন্দায় নমো নমঃ। ব্রহ্মতে সৃজতে বিশ্বং স্থিতৌ পালয়তে পুনঃ। রুদ্ররূপায় কল্পান্তে নমস্তুভ্যং ত্রিমূর্তয়ে।। (বিষ্ণুপুরাণ:১.১৯.৬৪-৬৫) "হে পুণ্ডরীকাক্ষ! তোমাকে নমস্কার। হে পুরুষোত্তম! তোমাকে নমস্কার। হে সর্ব্বলোকাত্মন্! তোমাকে নমস্কার। হে তীক্ষ্ণচক্রিণ! তোমাকে নমস্কার। গো-ব্রাহ্মণের হিতকারী ব্রহ্মণ্যদেবকে নমস্কার; জগতের হিতস্বরূপ কৃষ্ণকে নমস্কার। গোবিন্দকে নমস্কার। ব্রহ্মারূপে তুমি সৃষ্টি কর, বিষ্ণুরূপে পালন কর এবং কল্পান্তে রুদ্ররূপে জগতের লয় কর; এ ত্রিমূর্তিধারী হে পরমেশ্বর তোমাকে নমস্কার।" এইভাবে সর্বব্যাপী অনন্ত ভগবান অচ্যুতের স্তব ও ধ্যান করিতে করতে ভক্ত প্রহ্লাদের মাঝে অদ্বৈতবোধের সিদ্ধি চলে আসে। তাঁর নিজের মধ্যেই তখন তিনি জগতকে দেখতে শুরু করেন। এই অদ্বৈতবোধে তিনি উপলব্ধি করতে শুরু করেন তিনিই জততের সৃষ্টি, পালন এবং লয়ের কারণ। তিনিই শাশ্বত, তিনিই অবিনশ্বর, তিনিই অক্ষয়। অর্থাৎ নিজের প্রহ্লাদ সত্ত্বাকে সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলেন তিনি। সর্ব্বগত্বাদনন্তস্য স এবাহমবস্থিতঃ। মত্তঃ সর্বমহং সর্বং ময়ি সর্ব্বং সনাতনে।।  অহমেবাক্ষয়ো নিত্যংপরমাত্মাত্মসংশ্রয়ঃ। ব্রহ্মসংজ্ঞোহহমেবাগ্রে তথান্তে চ পুরঃ পূমান্।।  (বিষ্ণুপুরাণ:১.১৯.৮৫-৮৬) "অনন্তের সর্বব্যাপিত্বজন্য তিনিই আমি, আমা হতে সমস্ত উৎপন্ন; আমিও সর্ব্বরূপে বর্তমান এবং সনাতনরূপ আমাতেই পরিশেষে বিলয় হবে। আমিই সৃষ্টির পূর্ব্বে অক্ষয়, নিত্য ও সমস্ত জীবাত্মার অধিষ্ঠাতা ব্রহ্মনামক পরমাত্মা এবং আমিই শেষে পরমপুরুষ।" এরপরে শ্রীভগবান বিষ্ণুকে নিজ থেকে অভিন্ন ভাবতে ভাবতে নিতান্ত তন্ময়ত্ব প্রাপ্ত হয়ে প্রহ্লাদ নিজের স্বতন্ত্রতা বিস্মৃত হয়ে গেলেন। তিনি নিজে সহ চারিদিকে শুধুই বিষ্ণুময় দেখতে পেলেন।  বং সঞ্চিন্তয়ন্ বিষ্ণুমভেদেনাত্মনো দ্বিজ। তন্ময়ত্বমবাপাগ্র্যং মেনে চাত্মানমচ্যুতম্।।১ বিসস্মার তথাত্মানং নান্যৎ কিঞ্চিদজানত। অহমেবাব্যয়োহনন্তঃ পরমাত্মেত্যচিন্তয়ৎ।।২ তস্য তদ্ ভাবনাযোগাৎ ক্ষীণপাপস্য বৈ ক্রমাৎ। শুদ্ধেহন্তঃকরণে বিষ্ণুস্তস্থৌ জ্ঞানময়েঽচ্যুতঃ।।৩ (বিষ্ণুপুরাণ:১.২০.১-৩) "পরাশর বললেন-হে দ্বিজ! শ্রীভগবান বিষ্ণুকে এইরূপে আপনা হইতে অভিন্ন ভাবতে ভাবতে নিতান্ত তন্ময়ত্ব প্রাপ্ত হইয়া প্রহ্লাদ নিজেকে অচ্যুত থেকে অভিন্ন মনে করেছিলেন। সেই সময়ে তিনি নিজের স্বতন্ত্রতা বিস্মৃত হয়ে বিষ্ণুময় হয়ে গিয়েছিলেন। বিষ্ণু ব্যতীত অন্য কিছুই জানতে পারেন নাই এবং আমিই অব্যয় অনন্ত পরমাত্মা এইরূপে চিন্তা করিয়াছিলেন। এইরূপ ভাবনাযোগে ক্রমে নিষ্পাপ (সমস্ত কর্ম্মবাসনারহিত) হলে, তাঁর জ্ঞানময় শুদ্ধ অন্তঃকরণে অচ্যুত বিষ্ণু স্থিত হয়ে গিয়েছিল।" বিষয়টির উদাহরণ আমরা বেদের সংহিতাতেই শুধু নয়, বেদের উপনিষদ নামক আধ্যাত্মিক অংশেও সুস্পষ্টভাবে পাই। প্রহ্লাদের মত ত্রিশঙ্কু ঋষি আত্মতত্ত্ব লাভ করে ব্রহ্মের সাথে একাকার হয়ে যান। সেই অভেদ অবস্থায় তিনি ঘোষণা করেন, যে তিনিই এ জগৎ সংসারের প্রবর্তক এবং পর্বতশৃঙ্গের মত সমুন্নত তাঁর কীর্তি। অহং বৃক্ষস্য রেরিবা। কীর্তিঃ পৃষ্ঠং গিরেরিব। ঊর্ধ্ব পবিত্রো বাজিনীব স্বমৃতমস্মি।  দ্রবিণং সবর্চসম্। সুমেধা অমৃতোঽক্ষিতঃ। ইতি ত্রিশঙ্কোর্বেদানুবচনম্।। (তৈত্তিরীয় উপনিষদ: ১.১০.১) "আমিই এ জগৎ সংসারের প্রবর্তক। পর্বতশৃঙ্গের মতো সমুন্নত আমার কীর্তি।আমি পরমব্রহ্মে আত্মভাবাপন্ন হয়ে পবিত্র হয়েছি। সূর্যে যেমন অমৃত, আমিও তেমন শোভন অমৃত। আমি দীপ্তিমান ব্রহ্মরূপ ধন, আমি সুমেধাসম্পন্ন, আমি অমৃত এবং আমিই অক্ষয়"-ত্রিশঙ্কু নামক ঋষি আত্মতত্ত্ব লাভ করে এ ব্রহ্মতত্ত্ব প্রকাশিত করেছিলেন।" নদী যেমন সহস্র সহস্র গ্রাম, নগর পরিভ্রমণ করে সমুদ্রের বুকেই আশ্রয় নেয়। সমুদ্রের সাথে মিলিত হয়ে পরিশেষে সমুদ্রের সাথে একাকার হয়ে যায়। তখন নদীর জলের সাথে সমুদ্রের জলের আর কোন ভেদরেখা টানা যায় না। তেমনি সনাতন ধর্মে মৃত্যু পরবর্তীতে কোন অনন্ত স্বর্গের বা অনন্ত নরকের কথা বলা হয়নি। শাস্ত্রে স্বর্গ এবং নরক রয়েছে। কিন্তু সেই লোভনীয় স্বর্গকেই পরম পুরুষার্থ ঘোষণা করে স্বর্গকে মাহাত্ম্যপূর্ণ করা হয়নি। ধর্মে স্বর্গ হলো আত্মার জন্মজন্মান্তরে পথরেখায় সাময়িক সুখভোগের একটি স্থান। পুণ্যকর্ম ক্ষয় হয়ে গেলে আত্মা আবার জগতে জন্ম নিয়ে জন্মজন্মান্তরের আবর্তে ঘুরতে থাকে। এ আবর্তন শেষ হয় তখনি যখন সে মুক্ত হতে পারে। আত্মা নিষ্পাপ অপাপবিদ্ধ হলেই তবে তার পথপরিক্রমা শেষ হয়। বিষয়টি কঠ উপনিষদে ধর্মরাজ যম নচিকেতাকে বলেছেন। যথােদকং শুদ্ধে শুদ্ধমাসিক্তং তাদৃগেব ভবতি।  এবং মুনেৰ্বিজানত আত্মা ভবতি গৌতম।  (কঠ উপনিষদ:২.১.১৫ ) "হে গৌতম (নচিকেতা), শুদ্ধ জলের মধ্যে যেমন শুদ্ধ জল ফেলা হলে তা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়; ঠিক তেমনি জ্ঞানবান আত্মজ্ঞ ঋষির আত্মাও একই অবস্থা প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ তিনি ব্রহ্মের সাথে যুক্ত হয়ে ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হয়ে অভেদ হয়ে যান।" যতক্ষণ আমারা জীবন্মুক্ত হয়ে অদ্বৈতসিদ্ধ না হতে পারবো, ততক্ষণই আমরা জগতের সকল কিছুই বহু দেখে প্রতারিত হব। কিন্তু যখন এই বহু চলে গিয়ে আত্মায় অদ্বৈত অভেদজ্ঞানের সিদ্ধি হবে ঠিক তখনই আমাদের হৃদয়ের জন্ম জন্মান্তরের ঘন অন্ধকার কেটে যাবে। একটি প্রদীপ সহস্র সহস্র বছরের অন্ধকার কক্ষকে নিমেষেই আলোকিত করতে পারে। অন্ধকার বিদূরিত করার প্রদীপের শিখার মতই আমরাও অজ্ঞানের অন্ধকারে বিভ্রান্ত হতেই থাকবো। যতক্ষণ আমাদের মধ্যে অদ্বৈততত্ত্বের বোধ না হয়। যেখানেই অদ্বৈত, সেখানেই সমগ্র।পক্ষান্তরে যেখানেই খণ্ডিত, সেখানেই বহুত্ব। শ্রীকুশল বরণ চক্রবর্ত্তী সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।

 "যদগ্নে স্যামহং ত্বং ত্বং বা ঘাস্যা অহম্";

আমাদের দেহের অভ্যন্তরে সুষুম্না নাড়ীর পথে অতি সূক্ষ্ম পদ্মাকৃতিমূলাধার, স্বাধিষ্ঠান, মণিপুর, অনাহত, বিশুদ্ধ ও আজ্ঞা-ছয়টি চক্র আছে, যাকে ষটচক্র বলে।সকলের উর্দ্ধে আছে সহস্র পাপড়ির সহস্রার পদ্ম। সাধক যখন মুক্তি লাভ করে তখন তার এই সহস্র পাপড়ির পদ্মটির একটি একটি পাপড়ি প্রস্ফুটিত হচ্ছে এমন উপলব্ধি হয়। সাধকের মুক্তির পথে পৃথিবীর সকল পরিবার পরিজনের মায়ারূপ বন্ধন থেকে মুক্তির পথে যখন অগ্রসর হয়, তখন পৃথিবীর সকল সকল সম্পর্কই তার কাছে অসার মনে হয়। সে তখন জাগতিক সকল বিষয় থেকেই নিজেকে প্রত্যাহৃত করে নেয়। সে উপলব্ধি করতে পারে, জগতের স্রষ্টার সাথে তাঁর সম্পর্ক। সে বুঝতে পারে আমিই সেই ।সে জগতের সাথে এবং এবং জগত স্রষ্টার সাথে ধীরেধীরে একত্ব অনুভব করতে থাকে। এ একত্ববোধই তাকে মুক্তির পথে নিয়ে যায়।ঋগ্বেদ সংহিতার অষ্টম মণ্ডলেও বিষয়টি বলা হয়েছে :
যদগ্নে স্যামহং ত্বং ত্বং বা ঘাস্যা অহম্।
স্যুষ্টে সত্যা ইহাশিষঃ।।
(ঋগ্বেদ সংহিতা:৮.৪৪.২৩)
"হে প্রকাশ স্বরূপ অগ্নি, যখন আমি তুমি হয়ে যাই এবং তুমি আমি হয়ে যাও; তখনই সংসারে তোমার আশীর্বাদ সার্থক হয়।"
সাধকের পরমেশ্বরের সাথে যে আত্মতত্ত্বের একত্ব "তুমি আমি" এবং "আমি তুমি" সম্পর্ক গুলিয়ে ফেলে। ফলশ্রুতিতে সে উপলব্ধি করতে পারে যে, স্রষ্টা এবং সৃষ্টির মাঝে কেউ নেই,কোনো বাধা নেই।
জগতের সকলই এক এবং অদ্বিতীয় পরমেশ্বরেরই প্রকাশ। বিষয়টি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর একটি ব্রহ্মসংগীতেও বলেছেন:
"জানি শুধু তুমি আছ তাই আছি, তুমি প্রাণময় তাই আমি বাঁচি,
যত পাই তোমায় আরো তত যাচি, যত জানি তত জানি নে।
জানি আমি তোমায় পাব নিরন্তর লোকলোকান্তরে যুগযুগান্তর-
তুমি আর আমি মাঝে কেহ নাই, কোনো বাধা নাই ভুবনে।।"
বৈদিক অদ্বৈতের ভাবটি আমরা বিষ্ণুমহাপুরাণের প্রথমাংশের উনবিংশ অধ্যায়ে অত্যন্ত সুস্পষ্টভাবে খুঁজে পাই। দৈত্যরাজ হিরণ্যকশিপুর সন্তান প্রহ্লাদ একাগ্র চিত্তে ভগবান অচ্যুতের স্তব করতে করতে ভগবান শ্রীবিষ্ণুর সাথে একত্ববোধ করতে লাগলেন। ভক্ত এবং ভগবানে আর কোন বাধা রইলো না। সকলই মিলেমিশে একাকার।প্রথমে একত্ববোধের পূর্বে তিনি ভগবান শ্রীহরিকে পুণ্ডরীকাক্ষ, পুরুষোত্তম, সর্ব্বলোকাত্মন্, তীক্ষ্ণচক্রিণ, জগতের হিতস্বরূপ কৃষ্ণ গোবিন্দকে নমস্কার করেছেন। তিনি স্তোত্রে স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন, সেই অদ্বিতীয় পরমেশ্বরই ত্রিমূর্তি ধারণ করে ব্রহ্মারূপে জগতের সৃষ্টি করেন, বিষ্ণুরূপে পালন করেন এবং কল্পান্তে প্রলয়কালে রুদ্ররূপে জগতের লয় করেন।
নমস্তে পুণ্ডরীকাক্ষ নমস্তে পুরুষোত্তম।
নমস্তে সর্ব্বলোকাত্মন্ নমস্তে তিগ্মচক্রিণে।।
নমো ব্রহ্মণ্যদেবায় গোব্রাহ্মণহিতায় চ।
জগদ্ধিতায় কৃষ্ণায় গোবিন্দায় নমো নমঃ।
ব্রহ্মতে সৃজতে বিশ্বং স্থিতৌ পালয়তে পুনঃ।
রুদ্ররূপায় কল্পান্তে নমস্তুভ্যং ত্রিমূর্তয়ে।।
(বিষ্ণুপুরাণ:১.১৯.৬৪-৬৫)
"হে পুণ্ডরীকাক্ষ! তোমাকে নমস্কার। হে পুরুষোত্তম! তোমাকে নমস্কার। হে সর্ব্বলোকাত্মন্! তোমাকে নমস্কার। হে তীক্ষ্ণচক্রিণ! তোমাকে নমস্কার।
গো-ব্রাহ্মণের হিতকারী ব্রহ্মণ্যদেবকে নমস্কার; জগতের হিতস্বরূপ কৃষ্ণকে নমস্কার। গোবিন্দকে নমস্কার। ব্রহ্মারূপে তুমি সৃষ্টি কর, বিষ্ণুরূপে পালন কর এবং কল্পান্তে রুদ্ররূপে জগতের লয় কর; এ ত্রিমূর্তিধারী হে পরমেশ্বর তোমাকে নমস্কার।"
এইভাবে সর্বব্যাপী অনন্ত ভগবান অচ্যুতের স্তব ও ধ্যান করিতে করতে ভক্ত প্রহ্লাদের মাঝে অদ্বৈতবোধের সিদ্ধি চলে আসে। তাঁর নিজের মধ্যেই তখন তিনি জগতকে দেখতে শুরু করেন। এই অদ্বৈতবোধে তিনি উপলব্ধি করতে শুরু করেন তিনিই জততের সৃষ্টি, পালন এবং লয়ের কারণ। তিনিই শাশ্বত, তিনিই অবিনশ্বর, তিনিই অক্ষয়। অর্থাৎ নিজের প্রহ্লাদ সত্ত্বাকে সম্পূর্ণভাবে হারিয়ে ফেলেন তিনি।
সর্ব্বগত্বাদনন্তস্য স এবাহমবস্থিতঃ।
মত্তঃ সর্বমহং সর্বং ময়ি সর্ব্বং সনাতনে।।
অহমেবাক্ষয়ো নিত্যংপরমাত্মাত্মসংশ্রয়ঃ।
ব্রহ্মসংজ্ঞোহহমেবাগ্রে তথান্তে চ পুরঃ পূমান্।।
(বিষ্ণুপুরাণ:১.১৯.৮৫-৮৬)
"অনন্তের সর্বব্যাপিত্বজন্য তিনিই আমি, আমা হতে সমস্ত উৎপন্ন; আমিও সর্ব্বরূপে বর্তমান এবং সনাতনরূপ আমাতেই পরিশেষে বিলয় হবে।
আমিই সৃষ্টির পূর্ব্বে অক্ষয়, নিত্য ও সমস্ত জীবাত্মার অধিষ্ঠাতা ব্রহ্মনামক পরমাত্মা এবং আমিই শেষে পরমপুরুষ।"
এরপরে শ্রীভগবান বিষ্ণুকে নিজ থেকে অভিন্ন ভাবতে ভাবতে নিতান্ত তন্ময়ত্ব প্রাপ্ত হয়ে প্রহ্লাদ নিজের স্বতন্ত্রতা বিস্মৃত হয়ে গেলেন। তিনি নিজে সহ চারিদিকে শুধুই বিষ্ণুময় দেখতে পেলেন।
বং সঞ্চিন্তয়ন্ বিষ্ণুমভেদেনাত্মনো দ্বিজ।
তন্ময়ত্বমবাপাগ্র্যং মেনে চাত্মানমচ্যুতম্।।১
বিসস্মার তথাত্মানং নান্যৎ কিঞ্চিদজানত।
অহমেবাব্যয়োহনন্তঃ পরমাত্মেত্যচিন্তয়ৎ।।২
তস্য তদ্ ভাবনাযোগাৎ ক্ষীণপাপস্য বৈ ক্রমাৎ।
শুদ্ধেহন্তঃকরণে বিষ্ণুস্তস্থৌ জ্ঞানময়েঽচ্যুতঃ।।৩
(বিষ্ণুপুরাণ:১.২০.১-৩)
"পরাশর বললেন-হে দ্বিজ! শ্রীভগবান বিষ্ণুকে এইরূপে আপনা হইতে অভিন্ন ভাবতে ভাবতে নিতান্ত তন্ময়ত্ব প্রাপ্ত হইয়া প্রহ্লাদ নিজেকে অচ্যুত থেকে অভিন্ন মনে করেছিলেন। সেই সময়ে তিনি নিজের স্বতন্ত্রতা বিস্মৃত হয়ে বিষ্ণুময় হয়ে গিয়েছিলেন। বিষ্ণু ব্যতীত অন্য কিছুই জানতে পারেন নাই এবং আমিই অব্যয় অনন্ত পরমাত্মা এইরূপে চিন্তা করিয়াছিলেন। এইরূপ ভাবনাযোগে ক্রমে নিষ্পাপ (সমস্ত কর্ম্মবাসনারহিত) হলে, তাঁর জ্ঞানময় শুদ্ধ অন্তঃকরণে অচ্যুত বিষ্ণু স্থিত হয়ে গিয়েছিল।"
বিষয়টির উদাহরণ আমরা বেদের সংহিতাতেই শুধু নয়, বেদের উপনিষদ নামক আধ্যাত্মিক অংশেও সুস্পষ্টভাবে পাই। প্রহ্লাদের মত ত্রিশঙ্কু ঋষি আত্মতত্ত্ব লাভ করে ব্রহ্মের সাথে একাকার হয়ে যান। সেই অভেদ অবস্থায় তিনি ঘোষণা করেন, যে তিনিই এ জগৎ সংসারের প্রবর্তক এবং পর্বতশৃঙ্গের মত সমুন্নত তাঁর কীর্তি।
অহং বৃক্ষস্য রেরিবা। কীর্তিঃ পৃষ্ঠং গিরেরিব।
ঊর্ধ্ব পবিত্রো বাজিনীব স্বমৃতমস্মি।
দ্রবিণং সবর্চসম্। সুমেধা অমৃতোঽক্ষিতঃ।
ইতি ত্রিশঙ্কোর্বেদানুবচনম্।।
(তৈত্তিরীয় উপনিষদ: ১.১০.১)
"আমিই এ জগৎ সংসারের প্রবর্তক। পর্বতশৃঙ্গের মতো সমুন্নত আমার কীর্তি।আমি পরমব্রহ্মে আত্মভাবাপন্ন হয়ে পবিত্র হয়েছি। সূর্যে যেমন অমৃত, আমিও তেমন শোভন অমৃত। আমি দীপ্তিমান ব্রহ্মরূপ ধন, আমি সুমেধাসম্পন্ন, আমি অমৃত এবং আমিই অক্ষয়"-ত্রিশঙ্কু নামক ঋষি আত্মতত্ত্ব লাভ করে এ ব্রহ্মতত্ত্ব প্রকাশিত করেছিলেন।"
নদী যেমন সহস্র সহস্র গ্রাম, নগর পরিভ্রমণ করে সমুদ্রের বুকেই আশ্রয় নেয়। সমুদ্রের সাথে মিলিত হয়ে পরিশেষে সমুদ্রের সাথে একাকার হয়ে যায়। তখন নদীর জলের সাথে সমুদ্রের জলের আর কোন ভেদরেখা টানা যায় না। তেমনি সনাতন ধর্মে মৃত্যু পরবর্তীতে কোন অনন্ত স্বর্গের বা অনন্ত নরকের কথা বলা হয়নি। শাস্ত্রে স্বর্গ এবং নরক রয়েছে। কিন্তু সেই লোভনীয় স্বর্গকেই পরম পুরুষার্থ ঘোষণা করে স্বর্গকে মাহাত্ম্যপূর্ণ করা হয়নি। ধর্মে স্বর্গ হলো আত্মার জন্মজন্মান্তরে পথরেখায় সাময়িক সুখভোগের একটি স্থান। পুণ্যকর্ম ক্ষয় হয়ে গেলে আত্মা আবার জগতে জন্ম নিয়ে জন্মজন্মান্তরের আবর্তে ঘুরতে থাকে। এ আবর্তন শেষ হয় তখনি যখন সে মুক্ত হতে পারে। আত্মা নিষ্পাপ অপাপবিদ্ধ হলেই তবে তার পথপরিক্রমা শেষ হয়। বিষয়টি কঠ উপনিষদে ধর্মরাজ যম নচিকেতাকে বলেছেন।
যথােদকং শুদ্ধে শুদ্ধমাসিক্তং তাদৃগেব ভবতি।
এবং মুনেৰ্বিজানত আত্মা ভবতি গৌতম।
(কঠ উপনিষদ:২.১.১৫ )
"হে গৌতম (নচিকেতা), শুদ্ধ জলের মধ্যে যেমন শুদ্ধ জল ফেলা হলে তা মিলেমিশে একাকার হয়ে যায়; ঠিক তেমনি জ্ঞানবান আত্মজ্ঞ ঋষির আত্মাও একই অবস্থা প্রাপ্ত হয়। অর্থাৎ তিনি ব্রহ্মের সাথে যুক্ত হয়ে ব্রহ্মভাব প্রাপ্ত হয়ে অভেদ হয়ে যান।"
যতক্ষণ আমারা জীবন্মুক্ত হয়ে অদ্বৈতসিদ্ধ না হতে পারবো, ততক্ষণই আমরা জগতের সকল কিছুই বহু দেখে প্রতারিত হব। কিন্তু যখন এই বহু চলে গিয়ে আত্মায় অদ্বৈত অভেদজ্ঞানের সিদ্ধি হবে ঠিক তখনই আমাদের হৃদয়ের জন্ম জন্মান্তরের ঘন অন্ধকার কেটে যাবে। একটি প্রদীপ সহস্র সহস্র বছরের অন্ধকার কক্ষকে নিমেষেই আলোকিত করতে পারে। অন্ধকার বিদূরিত করার প্রদীপের শিখার মতই আমরাও অজ্ঞানের অন্ধকারে বিভ্রান্ত হতেই থাকবো। যতক্ষণ আমাদের মধ্যে অদ্বৈততত্ত্বের বোধ না হয়। যেখানেই অদ্বৈত, সেখানেই সমগ্র।পক্ষান্তরে যেখানেই খণ্ডিত, সেখানেই বহুত্ব।
সহকারী অধ্যাপক,সংস্কৃত বিভাগ,চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।
সভাপতি, সনাতন বিদ্যার্থী সংসদ।
মন্তব্যগুলো দেখুনমন্তব্যগুলো লুকান🙁